২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মসজিদে মসজিদে সাহায্যপ্রার্থী, একটি প্রস্তাবনা

মসজিদের একটি সাধারণ দৃশ্য - ফাইল ছবি

রাজধানীর মালিবাগ জামিয়ার মসজিদে প্রতিদিনই নিয়ম করে এক দু'জন ব্যক্তি আসেন সাহায্যের জন্য। একেক দিন একেকজন। ইমাম সাহেবের সালাম ফেরানোর সাথে সাথে তারা দাঁড়িয়ে যান। বলেন, বাবা, মা কিংবা পরিবারের কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত। সবাইকে সাহায্য করার আবেদন জানান তারা।

কিছু দিন আগে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় ফেরার পথে হিজাব পরা এক নারী বাসে ওঠে যাত্রীদের হাতে চিরকুট ধরিয়ে দিচ্ছিলেন। সেখানেও এজাতীয় আবেদন লেখা ছিল। মহিলার বাবা নাকি ইন্তেকাল করেছেন আরো আগে রোড অ্যাক্সিডেন্টে। মা ক্যান্সার আক্রান্ত। পরিবারে পুরুষ কেউ নেই। তাই তিনিই পথে নেমেছেন সাহায্যের জন্য। বিষয়টি আমার মানতে কষ্ট হচ্ছিল। তাই তাকে একটু কৌশলে ধরলাম।

বললাম, আপনার বিস্তারিত পরিচয় বলেন। আমাদের একটি সামাজিক সংগঠন আছে। সেখান থেকে আপনার জন্য আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করে দেব। যা ভেবেছিলাম তাই। তিনি তার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হলেন। এমনকি তার পরিচিত কোনো পুরুষ মানুষের নম্বরও তিনি দিতে পারলেন না। যাত্রীরা সবাই আমার জিজ্ঞাসাবাদ মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। একপর্যায়ে বলল, তাকে ছেড়ে দিন। বোঝাই যাচ্ছে, তিনি ধান্ধাবাজ। প্রতারণা করছেন সবার সাথে। একপর্যায়ে তাকে ছেড়ে দিলাম।

দু'দিন আগে রাজধানীর পুরান বাজার থেকে মালিবাগে আসার পথে ছোট এক মেয়ে, বয়স বেশি হলে আট বছর হবে। তার মাথায়ও হিজাব। চেহারা মায়াবী। সেও মানুষের হাতে একই আবেদনের চিরকুট বিতরণ করে সাহায্য চাইছিল। সত্যি বলছি, আমার চোখ দিয়ে তখন দু’ফোটা পানি পড়েছিল। আফসোস ও প্রবল দুঃখ হলো। সত্যিই কি ওই মেয়ের বাবা ক্যান্সার আক্রান্ত? নাকি অন্য কেউ তাকে এই জঘন্য পথে নামিয়েছে? আল্লাহতায়ালাই ভালো জানেন।

মাদরাসায় ফিরে সহপাঠীদের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করে জানতে পারলাম, ওই মেয়েকে প্রায়ই সাহায্য চাইতে একই জায়গায় দেখা যায়।

আমার মনে হয়, ঢাকার প্রায় সব মসজিদে এভাবে কিছু লোক সাহায্যের জন্য দাঁড়ান। কেউ নও-মুসলিম পরিচয়ে। আবার কেউ নানা সমস্যার অজুহাতে। যাদের বেশিরভাগই থাকেন প্রতারক। তারা প্রতারণা করেন সরলমনা মুসলমানদের সাথে। এই প্রতারকদের কেউ কেউ অমুসলিম হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। তারা বেছে নেয় মসজিদ-মাদরাসাকে। কারণ, এসব জায়গায় সবাই সাহায্য করে। সবাই সওয়াবের আশা করে। কেউ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে না। ফলে ভালো ইনকামও হয়।

ধর্মকে পুঁজি করে এভাবে আর কত দিন চলতে দেয়া যায়! এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সমাজে পড়ার আশঙ্কা নেই কি?

এক দু'জন মানুষ সত্যিকারে সমস্যাগ্রস্ত থাকতেই পারেন। তাই বলে প্রতি ওয়াক্ত নামাজে একজন করে হাজির হলে বিষয়টি অন্যরকম মনে হওয়া স্বাভাবিক।

ইসলাম ধর্মে ভিক্ষাবৃত্তি অত্যন্ত জঘন্য কাজ। এর প্রতি মহানবী সা. মানুষদেরকে নিরুৎসাহিত করেছেন। নবীজি সা. বলেছেন, আল্লাহ তায়ালার কাছে হালাল কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বা রাগের উদ্রেক সৃষ্টিকারী কাজ হলো স্ত্রীকে তালাক দেয়া ও ভিক্ষাবৃত্তি করা।

হাদিসের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কিতাব সহিহ বোখারী শরিফে আছে, নবীজি সা. বলেছেন, তোমাদের কেউ দড়ি নিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে যাবে এবং লাকড়ি জমা করে পিঠে বোঝা বয়ে এনে তা বিক্রি করবে। আর এমনিভাবে আল্লাহ তার প্রয়োজন মিটিয়ে দেবেন। এ ব্যবস্থা তার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা, করুণা ও লাঞ্ছনা পাওয়ার চেয়ে অনেক ভালো।

এক সাহাবী নবীজি সা.- এর কাছে ভিক্ষা চাইতে এলে তাকে ভিক্ষা না দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের উপায় বাতলে দেন।

সাহাবায়ে কেরাম অনেক গরিব হওয়া সত্ত্বেও কখনো ভিক্ষার পথ বেছে নেননি। ইসলামের শিক্ষা এটাই। কেউ ভিক্ষা করবে না। সবাই মেহনত করবে, এটা ইসলামের দাবি। কেউ একেবারে মুসিবতগ্রস্ত হলে তাকে সামাজ ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সাহায্য করা হবে। তবুও সে ভিক্ষা করতে পারবে না। বাংলাদেশের আইনেও ভিক্ষা করা নিষিদ্ধ। তবে, এই আইনের বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হয় না।

অন্যান্য জায়গা থেকে ভিক্ষুকদের আনাগোনা মসজিদে বেশি। জুমার নামাজ শেষে এসব লোকদের লাইন লেগে যায় ভিক্ষার জন্য। এ যেন এক ভয়ঙ্কর মহামারী। এই ভিক্ষার পথ বন্ধে এখনই আমাদের উদ্যোগী হওয়া দরকার। এতে যেমন দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, তেমনি নষ্ট হচ্ছে ধর্মেরও ভাবমূর্তি।

মসজিদে কেউ সাহায্যের জন্য এলে তাকে আগে মসজিদের ইমাম সাহেব বা দায়িত্বশীল কারো সাথে কথা বলার নিয়ম করুন। যেন ইচ্ছে হলেই কেউ ভিক্ষার জন্য দাঁড়াতে না পারে। লোকটি যদি সত্যিই মুসিবতগ্রস্ত হয়, তাহলে ইমাম সাহেব বা দায়িত্বশীলরা উদ্যোগী হয়ে তাকে সাহায্য করুন। আর যদি লোকটি প্রতারক হয়, তাহলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নিন।

লেখক : তরুণ আলেম ও সংবাদকর্মী


আরো সংবাদ



premium cement