২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিয়ে, দাম্পত্যজীবন ও ভালোবাসা

বিয়ে, দাম্পত্যজীবন ও ভালোবাসা - মুফতি ইমদাদুল হক ফয়েজী - ফাইল ছবি

বিয়ে মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একট অধ্যায়। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিধান ও ইবাদতও বটে। অচেনা, অদেখা, অপরিচিত বিপরীত লিঙ্গের দু’জন মানুষ যে বন্ধনের মাধ্যমে একে অন্যকে উপভোগ করার অপূর্ব সুযোগ ও বৈধতা লাভ করেন তাই বিয়ে (আকদ)।

কখনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি, কথাবার্তা হয়নি, কোনো প্রকার ধারণা নেই, কল্পনাও নেই এমন দু’জন নারী-পুরুষ মহান প্রভুর ইচ্ছায় এবং অমোঘ নীতিতে একে অন্যকে এ বন্ধনের মাধ্যমে বরণ করেন, সর্বোচ্চ আপন করে নেন। প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মমতা, হৃদ্যতা-আন্তরিকতা, প্রীতি-শ্রদ্ধা ইত্যাদি আকর্ষণীয় সব গুণ ও নিরেট আন্তরিকতায় একে অন্যের একান্ত আপনজন হয়ে যান।

এমনকি বিয়ে পরবর্তী জীবনে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে এতটা ঘনিষ্ঠ হন যে, তাদের উভয়ে একে অন্যের সর্বস্ব প্রিয়তম আর প্রিয়তমা হয়ে যান। এটি পড়ন্ত বয়সে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও অবশিষ্ট থাকে। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই পবিত্র, অকৃত্রিম ও প্রেমময় এ সম্পর্ক সৃষ্ট করে দেন। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আরো এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাকো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতি সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে’ (সূরা রুম : ২১)।

দেখুন, আয়াতে স্বামীদের জন্য স্ত্রীদের শান্তির আশ্রয়স্থল বলা হয়েছে। মুফাসসিরিনে কেরাম বলেছেন, এখানে ‘শান্তি’ দ্বারা মানসিক প্রশান্তি বুঝানো হয়েছে। বলা বাহুল্য, অন্তরের প্রশান্তি থেকে বড় কোনো সুখ-সম্পদ নেই। উপর্যুক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ‘ভালোবাসা’ (মাওয়াদ্দাহ) শব্দ ব্যবহার করে স্বামী-স্ত্রীর প্রারম্ভিক জীবন থেকে শুরু করে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত উভয়ের পূর্ণ সত্তায় যে অতুলনীয় প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা-দুর্বলতা মিশে থাকে সেটি বুঝিয়েছেন। পরে আবার ‘সম্প্রীতি’ (রাহমাহ) শব্দ ব্যবহার করে স্বামী-স্ত্রীর জৌলুসহীন বার্ধক্যকালীন জীবনে তাদের মাঝে একে অন্যের প্রতি যে অসীম মায়া-মমতা, প্রীতি-মহানুভবতা- সোজা কথায় একে অন্যকে বুঝার, কাছে রাখার ও সর্বোচ্চ আপন করার যে শক্তি, জ্ঞান ও যোগ্যতা দরকার তার সবই যে উভয়ের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় সৃষ্টি হয়ে যায়, আল্লাহ তায়ালা সে কথাটিই সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত করেছেন।

আল্লাহ তায়ালা আরো ইরশাদ করেন, ‘তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ’ (সূরা বাকারাহ : ১৮৭)। আমরা সবাই জানি, পোশাক-পরিচ্ছদ পরলে তা শরীরের সাথে লেগে থাকে, জড়িয়ে থাকে। এ ছাড়া পোশাক ব্যবহারের কোনো বিকল্প পন্থা নেই। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সবসময় পোশাকের মতোই, তারা জীবনের যাবতীয় সুখ-দুঃখে কখনো একে অন্যের থেকে পৃথক হবেন না বরং; আমৃত্যু জড়িয়ে থাকবেন এবং স্বপ্নীল, প্রাণবন্ত জীবন উপভোগ করবেন। পোশাকের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি শরীরের দোষ-ত্রুটি, রোগবালাই ঢেকে রাখে। আয়াতের অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রী পোশাকের মতো তাদের পারস্পরিক সব ত্রুটি-বিচ্যুতি, ভুল বোঝাবুঝি ইত্যাদি সব অনাকাক্সিক্ষত ও ব্যক্তিগত বিষয় নীরবে ঢেকে রাখবেন। পোশাকের মধ্যে আরো অনেক কল্যাণ ও উপকারিতা নিহিত থাকে। যেমন: শালীনতা, আভিজাত্য, আত্মমর্যাদা, রুচিশীলতা ইত্যাদি। সুতরাং প্রতীয়মান হয়, স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের জন্য এসব গুণ অর্জনে পোশাকের ভূমিকা পালন করবেন। সুন্দর ও নির্মল গুণাবলি অর্জনে একে অন্যকে প্রেরণা-উৎসাহ দেবেন, শক্তি-সাহস জোগাবেন, সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবেন। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত একান্ত শুভাকাক্সক্ষী ও পরমপ্রিয় বন্ধু হিসেবে একে অন্যকে জড়িয়ে থাকবেন।

বিয়ে মানবজীবনে আরো অনেক মর্যাদাপূর্ণ কল্যাণ ও মঙ্গল অর্জনে সহায়ক হয় এবং সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। বিয়ে বৈধ দাম্পত্য জীবন নির্মাণের একমাত্র পন্থা, সব প্রকার প্রশান্তি লাভের অন্যতম সহায়ক, আত্মীয়তা বৃদ্ধির সোপান, সন্তান লাভ ও বংশবৃদ্ধির একমাত্র বৈধ পদ্ধতি, পারিবারিক ও সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক তথা জীবনের প্রতিটি ধাপ ও অধ্যায়ে সমৃদ্ধি লাভের সিঁড়ি, সৎ ও পুণ্যকাজের যোগানদাতা, আদর্শ ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক মাধুর্যতা এবং নৈতিকতার প্রশিক্ষক, অপবিত্রতা ও কলুষতামুক্ত থাকার সুচিকিৎসা ও প্রতিষেধক, পাপাচারের প্রতিবন্ধক, লজ্জা ও আত্মনির্ভরশীলতা এবং আত্মমর্যাদা অর্জনের পথনির্দেশক, দয়া-অনুগ্রহ-ভালোবাসা ও পরোপকারী হওয়ার আদর্শ সিলেবাস এবং একটি আদর্শ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের অন্যতম উপাদান। সর্বোপরি, বিয়ে জীবনের সব প্রকার অপূর্ণতা-দারিদ্র্যতা দূর করে এবং জীবনকে ঐশ্বর্যময়, সৌন্দর্যমণ্ডিত ও সুখময় করে তোলে। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা তোমাদের মধ্যকার অবিবাহিত নারী-পুরুষ ও সৎকর্মশীল দাস-দাসীদের বিয়ে দাও। তারা যদি দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে প্রাচুর্যপূর্ণ করে দেবেন, আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা নূর : ৩২)

লেখক : সহকারী শিক্ষক, শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা, সিলেট


আরো সংবাদ



premium cement