২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সাহাবাদের নবীপ্রেমের স্বরূপ

মদিনা শরিফ - ছবি : সংগৃহীত

সাহাবাদের নবীপ্রেম ছিল দৃষ্টান্তহীন। নবী সা:কে সাহাবারা যেভাবে ভালোবাসতেন তার কোনো নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর পাওয়া যাবে না। আমরা এখানে পাঠকদের সামনে সাহাবাদের নবীপ্রেমের দু-একটি ঘটনা পেশ করছি।

ক. আসেম ইবন ওমর বলেন : একবার রাসূল সা: তাঁর সাহাবিদের এক দলকে এক কাজে পাঠালেন, তাদের মধ্যে যাইদ ইবন দাসানাও ছিলেন। যাইদ ইবন দাসানা এ সময় কাফেরদের হাতে বন্দী হলেন। অতঃপর তাকে মক্কায় নিয়ে যাওয়া হলো। তখন সাফাওয়ান ইবন উমাইয়্যা তাকে তার নিস্তাস নামীয় এক গোলামকে দিয়ে মক্কার হেরমের বাইরে তানীম নামক স্থানে হত্যা করার জন্য নিয়ে গেল। এমতাবস্থায় তাকে হত্যা করার জন্য মক্কাবাসীর অনেকেই জমায়েত হলো। তাদের মধ্যে আবু সুফিয়ান ইবন হারবও ছিল। যখন তাকে হত্যার জন্য নিয়ে গেল, তখন আবু সুফিয়ান বলল, ‘যাইদ তোমাকে আমি আল্লাহর নামে বলছি, তুমি কি ভালোবাসবে যে, এ মুহূর্তে মুহাম্মদ আমাদের কাছে তোমার অবস্থায় থাকুক এবং মুহাম্মদের মাথাটি উড়িয়ে দেয়া হবে। আর তুমি তোমার পরিবারের কাছে থাকবে? তখন যাইদ জবাব দিলো, আল্লাহর কসম আমি চাইব না যে, আমি বর্তমানে যেখানে আছি সেখানে মুহাম্মদ সা: থাকুক, আর তাঁর গায়ে একটি কাঁটাও বিদ্ধ হোক, আর আমি আমার পরিবারের মধ্যে থাকি। তখন আবু সুফিয়ান বলল, আমি আমার জীবনে মুহাম্মদকে তাঁর সাথীরা যেরূপ ভালোবাসে সেরূপ কোনো মানুষ অপর কোনো মানুষকে ভালোবাসে তা আর দেখিনি। এ কথার পর নিস্তাস তাকে হত্যা করল। [মা’রিফাতুস সাহাবা, খ. ৮,পৃ.২৭৮, হাদিস নং-২৬৩৪]

দেখুন একজন সাহাবির রাসূলকে ভালোবাসার নজির। তিনি মনে মনে কল্পনাও করতে পারতেন না যে, রাসূল সা:-কে কোনো রকমের কষ্ট দেয়া হচ্ছে।
খ. মুহাম্মদ ইবন সা’দ ইবন আবু ওয়াক্কাস থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : আনছারী বনি যুবিয়ান গোত্রের এক মহিলা উহুদ যুদ্ধের দিন মুসলমানদের পরাজয়ের কথা শুনে উহুদের দিকে যাচ্ছিলেন। পথে তাকে জানানো হলো যে, তার স্বামী ও ভাই যুদ্ধে শাহাদৎ বরণ করেছেন। এ সংবাদ শুনে মহিলা কোনো ভ্রƒক্ষেপ করলেন না। তিনি চলতে থাকলেন সামনে উহুদের দিকে। আর লোকদের জিজ্ঞেস করতে থাকলেন, রাসূল সা:-এর কী অবস্থা? রাসূল সা:-এর কী হয়েছে? লোকেরা জবাব দিলো, রাসূল সা: ভালো আছেন। অবশেষে মহিলা উহুদের ময়দানে পৌঁছে লোকদের উদ্দেশে বললেন, আমাকে মহানবীকে দেখতে দিন। তখন লোকেরা মহানবীর দিকে ইঙ্গিত করে দেখিয়ে দিলেন। যখন মহিলা মহানবী সা:-কে দেখলেন তখন বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি জীবিত থাকলে সব বিপদই সহজ হয়ে যায়। [বায়হাকি, দালায়েলুন নাবুওয়্যা,খ. ৩, পৃ.৩০২]

গ. সা’দ ইবন রাবীর মা উম্মে সা’দ বলেন : আমি উম্মে আমারার কাছে একদিন গেলাম। তাকে গিয়ে বললাম, খালা আমাকে আপনার যুদ্ধের বর্ণনা দিন। তখন তিনি বললেন, আমি দিনের প্রথম দিকে বাড়ি থেকে বের হলাম। দেখতে থাকলাম মানুষজন কী করছে। তখন আমার সাথে একটি পাত্র ছিল যাতে কিছু পানি ছিল। অবশেষে আমি রাসূল সা: পর্যন্ত পৌঁছলাম। তখন তিনি তাঁর সাহাবাদের সাথে ছিলেন। তখন যুদ্ধের বিজয় বাতাস মুসলমানদের দিকে। অতঃপর মুসলমানরা যখন পরাজিত হলো; তখন আমি রাসূল সা:-এর দিকে এগিয়ে গেলাম। তখন আমি নিজেই যুদ্ধ করতে আরম্ভ করলাম, মহানবীর ওপর আসা আঘাত তরবারি দ্বারা প্রতিহত করছিলাম। তীর নিক্ষেপ করছিলাম। অবশেষে আমি নিজেই আহত হলাম। রাবী বলেন : তখন আমি তাঁর পিঠে একটি গভীর ক্ষত দেখতে পেলাম। তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম তোমাকে এ আঘাত কে করে ছিল? তিনি জবাব দিলেন ইবন কায়েমা, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করুন। যখন লোকেরা রাসূল সা:-কে ছেড়ে পালাচ্ছিল, তখন সে এগিয়ে এসে বলতে থাকল, আমাকে মুহাম্মদকে দেখিয়ে দিন। সে বাঁচলে আমি বাঁচব না। তখন আমি মুসআব ইবন ওমাইর এবং রাসূল সা:-এর সাথে থাকা কিছু সাহাবি এগিয়ে গেলাম তাকে বাধা দিতে। তখন সে আমাকে এ আঘাতটি করেছিল। আমিও তাকে এ অবস্থায় কয়েকটি আঘাত করেছিলাম। তবে তার গায়ে তখন দু’টি লৌহ বর্ম থাকায় তাকে হত্যা করা গেল না।

ঘ. ইবন ইসহাকের বর্ণনা থেকে জানা যায়, উহুদ যুদ্ধের দিন একপর্যায়ে রাসূল সা: কাফেরদের খনন করা এক গর্তে পড়ে গেলেন। তখন দু’জন সাহাবি তাঁকে টেনে তুললেন। তারপর একটি টিলার ওপর তাঁকে নিয়ে গেলেন। এমতাবস্থায় তিন দিক থেকে কাফেরদের তীরবৃষ্টি আসতে থাকল। তখন সাহাবি আবু দাজানা মহানবীকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যাতে তাঁর শরীরে একটিও তীর বিদ্ধ হতে না পারে। আর কাফেরদের তীরবৃষ্টি আবু দাজানার পিঠে বিদ্ধ হচ্ছিল। তাঁর পিঠ ঝাঁঝরা হয়ে গেল। অবশেষে তিনি শাহাদৎ বরণ করলেন। আর মুসলমানরা প্রায় পরাজিত হলো। [তাহজিবু সীরাতে ইবন হিশাম,পৃ.২৫০]

ঙ. আয়শা থেকে বর্ণিত। নবী সা: একবার কিছু আনছারী ও মুহাজিরদের সাথে ছিলেন। তখন একটি উট এসে মহানবী সা:কে সিজদা করল। তখন রাসূলের সাহাবারা বললেন, গাছ-গাছালি ও উট আপনাকে সিজদা করে। অথচ আমরাই আপনাকে সিজদা করার বেশি হকদার। (কারণ আমাদেরকে আপনার আনুগত্য করার আদেশ দেয়া হয়েছে) তখন মহানবী সা: বললেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রভুর ইবাদত করো; আর তোমাদের ভাইকে সম্মান করো। আমি কাউকে অপর কাউকে সিজদা করার আদেশ করলে নারীদেরকে তাদের স্বামীদের সিজদা করতে আদেশ করতাম।’ [আহমদ : ২৩৩২১, ইবনে মাজাহ : ১৮৪২; শোয়াইব আরনূত হাদিসটির সনদ দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন

এ হাদিসের ‘তোমাদের ভাইকে সম্মান করো’ বাক্য থেকে বোঝা যায় যে, রাসূল সা:কে তাজিম ও সম্মান করা মুমিনদের কর্তব্য। তবে সে সম্মান ও তাজিম কখনো সিজদার মাধ্যমে হতে পারে না। কারণ সিজদা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশে করা যায়। তাছাড়া রাসূল সা: নিজে তাঁকে সম্মান করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন।
ইবন আব্বাস থেকে বর্ণিত। তিনি ওমর রা:-কে মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেন আমি নবী সা:-কে বলতে শুনেছি যে, ‘তোমরা আমার এমন প্রশংসা করো না যেরূপ খ্রিষ্টানরা ঈসা ইবনে মরিয়মের করেছে। নিশ্চয় আমি হলাম আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল বলে অভিহিত করো।’
এ হাদিসে লক্ষণীয় বিষয় হলো খ্রিষ্টানরা ঈসা আ:-এর প্রশংসা করতে গিয়ে তাকে যেমন খোদার পুত্র খোদা বানিয়েছে মুসলমানরা যেন মহানবীর প্রশংসা করতে গিয়ে সেরূপ কর্মকাণ্ড না করে। তাকে যেন খোদা না বানিয়ে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল বলেই অভিহিত করেন।

আলী ইবনে হোসাইন থেকে বর্ণিত। তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন : তোমরা আমাদের ইসলামের ভালোবাসার রীতিতে ভালোবাসো। কারণ রাসূল সা: বলেছেন, তোমরা আমাকে আমার প্রাপ্য হকের উপরে উত্থিত করো না। কারণ আল্লাহ তায়ালা আমাকে রাসূল বানাবার আগে তাঁর বান্দা বানিয়েছেন।’

কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় নবীকে যেভাবে শ্রদ্ধা করার কথা সেভাবে শ্রদ্ধা করেনি সবাই। বিষেশত বর্তমান সময়ে অনেকে নবীকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করছে। মহানবীর শানে এমন সব কথা বলছে যা গালাগালের পর্যায়ে পড়ে। এর পরেও তারা নিজেদের মুসলমান বলেই মনে করছে। অথচ রাসূলকে গালাগাল করা ও তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করা ইসলামের দৃষ্টিতে একটি বড় ধরনের অপরাধ। এ অপরাধের জন্য পরকালে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামি হতে হয়। কারণ : ইসলামের শুরুতে মুনাফিকরা রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করত। তাদের এ ঠাট্টা-বিদ্রƒপের জন্য তাদেরকে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামি হতে হবে বলে আল্লাহ জানান। আল্লাহ বলেন : ‘আর তাদের মধ্যে এমন লোক আছে, যারা নবীকে কষ্ট দেয় এবং বলে, ‘তিনি (সব বিষয়ে) শ্রবণকারী’। বলো, তোমাদের জন্য যা কল্যাণের তা শ্রবণকারী। তিনি আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখেন এবং মুমিনদের বিশ্বাস করেন, আর তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার তাদের জন্য তিনি রহমত এবং যারা আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়, তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আজাব। তারা তোমাদের কাছে আল্লাহর কসম করে, যাতে তোমাদের সন্তুষ্ট করতে পারে, আল্লাহ ও তার রাসূল অধিক হকদার যে, তারা তাকে সন্তুষ্ট করবে, যদি তারা ঈমানদার হয়ে থাকে। তারা কি জানে না, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে, তবে তার জন্য অবশ্যই জাহান্নাম, তাতে সে চিরকাল থাকবে। এটা মহালাঞ্ছনা। মুনাফিকরা ভয় করে যে, তাদের বিষয়ে এমন একটি সূরা অবতীর্ণ হবে, যা তাদের অন্তরের বিষয়গুলো জানিয়ে দেবে। বলো, ‘তোমরা উপহাস করতে থাকো। নিশ্চয় আল্লাহ বের করবেন, তোমরা যা ভয় করছ।’

মুনাফিকরা কিভাবে আল্লাহ, আল্লাহর আয়াত ও আল্লাহর রাসূলের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করছিল তা এ আয়াতে স্পষ্ট নয়। তবে মুফাস্সিরগণ তা উল্লেখ করেছেন। আল্লামা কুরতুবি বলেন : আল্লামা তাবারি প্রমুখ মুফাসসিরগণ কাতাদাহ থেকে বর্ণনা করে বলেছেন, ‘যখন রাসূল সা: তাবুকের যুদ্ধের জন্য যাত্রা করছিলেন তখন মুনাফিকদের একদল তার আগে আগে চলছিল। তখন তারা বলছিল দেখো এ লোকটির দিকে সে নাকি সিরিয়ার কেল্লা ও রোমানদের কেল্লাগুলো দখল করে নেবে। এমতাবস্থায় তারা যা বলাবলি করছিল এবং যা মনের অভ্যন্তরে গোপন রেখেছিল সে সম্পর্কে আল্লাহ নবীকে অভিহিত করেন। তখন মহানবী সা: বললেন, তোমরা যাত্রী দলকে থামাও। তারপর তাদের কাছে আসলেন, তারপর বললেন, তোমরা এমন এমন কথা বলছিলে? তখন তারা শপথ করে বলল, ‘আমরা তো খেল-তামাশা করছিলাম। আমরা তা প্রত্যয়সহকারে বলিনি।

আলোচ্য আয়াতসমূহে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল ও আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শন এর বিরোধিতা করা, তাদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করা, মারাত্মক কুফরি; যার পরিণামে বিদ্রƒপকারীকে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। আর দুনিয়াতে তাদের হত্যা করার বিধান রয়েছে। রাসূল সা:কে গালাগাল করা প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে বলা হয় :

ক. আবু বর্যা আসøামী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : এক লোক আবু বকরের সাথে কর্কশ বা রূঢ় ব্যবহার করল। তখন আমি বললাম, হে রাসূলুল্লাহর খলিফা! আমি কি লোকটিকে হত্যা করব না? তখন তিনি বললেন, তা কেবল যারা নবী সা:-কে গালাগাল করে তাদেরই করা যায়।

খ. আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : ‘নবী সা: ছাড়া অন্য কাউকে গালমন্দ করার জন্য কাউকে হত্যা করা যায় না।
এতদুভয় বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, রাসূল সা: ছাড়া অন্য কাউকে গালাগাল করা অপরাধ হলেও; তার জন্য কাউকে হত্যা করা যাবে না। তবে তাদের তাজিরি শাস্তি প্রদান করা যাবে।

গ. আলী ইবন আবু তালেব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নবীদেরকে গালাগাল করে তাকে হত্যা করা হবে। আর যে আমার সাহাবাদের গালাগাল করে তাকে বেত্রাঘাত করা হবে।

এসব হাদিস থেকে জানা যায়, কোনো মুসলমান নবী সা:-কে গালাগাল করলে সে মুসলমান থাকে না। সে এ অপরাধের কারণে মুরতাদ হয়ে যায়। তাই তার এ অপরাধের শাস্তি হিসেবে তাকে হত্যা করতে হবে। আর অন্য কোনো মুসলমানকে গালাগাল করলে তাকে হত্যা নয়; বরং তাজিরী শাস্তি হিসেবে বেত্রাঘাত করতে হবে।
লেখক : ইসলামিক স্কলার ও প্রফেসর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া


আরো সংবাদ



premium cement