২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পালনকর্তা প্রদত্ত সম্মান

পালনকর্তা প্রদত্ত সম্মান - সাইফুল্লাহ হিমেল - ফাইল ছবি

‘মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব’ কথাটি আমরা হরহামেশাই বলে থাকি। যা শতভাগ সত্য। আল্লাহ মানুষকে সেরা জীব হিসেবে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে রেখেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি বনি আদমকে মর্যাদা দিয়েছি এবং তাদের জলে-স্থলে সওয়ারি দান করেছি, তাদের পাক-পবিত্র জিনিস থেকে রিজিক দিয়েছি এবং নিজের বহু সৃষ্টির ওপর তাদের সুস্পষ্ট প্রাধান্য দিয়েছি।’ (সূরা বনি ইসরাঈল : ৭০) অর্থাৎ এটা প্রকাশ্য দিবালোকের মতো সত্য যে, মানব জাতিকে পৃথিবী ও তার যাবতীয় বস্তুর ওপর কর্তৃত্ব কোনো জিন, ফেরেশতা বা গ্রহ-নক্ষত্র দান করেনি। একইভাবে কোনো নবী বা অলি তাঁর নিজ নিজ সম্প্রদায়কে এ কর্তৃত্ব দান করেননি। এই কর্তৃত্ব দান করেছেন নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ। এহেন মর্যাদা লাভের পরেও মানুষ আল্লাহর পরিবর্তে তাঁর সৃষ্টির সামনে মাথা অবনত করবে, মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় বোকামি ও মূর্খতা আর কী হতে পারে?

আসুন আমরা কুরআনের আলোকে আরো একটু জানার চেষ্টা করি আল্লাহ কিভাবে মানুষকে সম্মানিত করেছেন। আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট জগতের সব কিছুর জন্য নিয়ম বাতলে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি এই নিয়মকে দুই ভাগ করেছেন। একটি হলো প্রকৃতির জন্য। অন্যটি মানুষের জন্য। প্রকৃতি আল্লাহর নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য। আল্লাহ যেভাবে আইন করে দিয়েছেন আকাশ, বাতাস, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, গাছ-পালা ইত্যাদি ঠিক সেভাবেই আল্লাহর নিয়ম মেনে চলে। প্রকৃতির কোনো সৃষ্টিই আল্লাহর নিয়মের একফোঁটা হেরফের করতে পারে না।

অন্য দিকে আল্লাহ মানুষের জন্য যে আইন দিয়েছন তা মানতে মানুষকে বাধ্য করেননি। গাছ-পালা, চন্দ্র-সূর্য যেভাবে আল্লাহর নিয়ম মানতে বাধ্য মানুষ সেভাবে বাধ্য নয়। সে মানতেও পারে নাও মানতে পারে। এটা মানুষের ইচ্ছাধীন। আর কাউকে পছন্দ করার স্বাধীনতা দেয়া মানে তাকে সম্মানিত করা। আমরা জানি, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যায় ভর্তি পরীক্ষায় যে পরীক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে থাকেন তাকে সংশ্লিষ্ট ইউনিটের যেকোনো বিষয় পছন্দ করতে বলা হয়। আর যে মেধাতালিকায় শেষে থাকে তাকে বলা হয় তোমার জন্য একটি নির্ধারিত বিষয় আছে। অন্য কোনো বিষয় পছন্দ করার সুযোগ তোমার নেই। সুতরাং স্বাধীনভাবে পছন্দ করার অধিকার দেয়া একটা সম্মানের বিষয়।

আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাকে রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছি। এরপর হয় সে শোকরগোজার হবে নয়তো হবে কুফরের পথ অনুসরণকারী।’ (সূরা দাহ্র : ৩) অর্থাৎ আমি তাকে শুধু জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধি দিয়েই ছেড়ে দেইনি। বরং এগুলো দেয়ার সাথে সাথে তাকে পথও দেখিয়েছি যাতে সে জানতে পারে শোকরিয়ার পথ কোনটি এবং কুফরির পথ কোনটি। এরপর যে পথই সে অবলম্বন করুক না কেন তার জন্য সে নিজেই দায়ী। এ বিষয়টিই সূরা বালাদের ১০ নম্বর আয়াতে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ‘আমি তাকে দু’টি পথ (অর্থাৎ ভালো ও মন্দ পথ) স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছি।’ সূরা শামসে ৭ ও ৮ নং আয়াতে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে : ‘শপথ (মানুষের) প্রবৃত্তির আর সে সত্তার যিনি তাকে (সব রকম বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ শক্তি দিয়ে শক্তিশালী) ঠিকমতো গঠন করেছেন। আর পাপাচার ও তাকওয়া-পরহেজগারির অনুভূতি দু’টোই তার ওপর ইলহাম করেছেন।’ এসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সামনে রেখে বিচার করলে এবং পৃথিবীতে মানুষের হিদায়াতের জন্য মহান আল্লাহ যেসব ব্যবস্থার কথা কুরআনে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন তাও সামনে রাখলে বুঝা যায় যে, এ আয়াতে পথ দেখানোর যে কথা বলা হয়েছে তার দ্বারা পথপ্রদর্শনের কোনো একটি মাত্র পন্থা ও উপায় বুঝানো হয়নি। বরং এর দ্বারা অনেক পন্থা ও উপায়ের কথা বলা হয়েছে যার কোনো সীমা পরিসীমা নেই।

কুরআনের উপরিউক্ত বক্তব্যে বোঝা যায় যে, এখানে আল্লাহর আইন মানার ব্যাপারে মানুষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। প্রকৃতির মতো আল্লাহর আইন মানতে মানুষকে বাধ্য করা হয়নি। অথচ আল্লাহ হলেন তিনি যিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। কোনো কিছুর ইচ্ছে করলে আল্লাহর একটি মাত্র কথার সাথে সাথে তা হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি যখন কোনো কিছুর ইচ্ছা করেন তখন তাঁর কাজ হয় কেবল এতটুকু যে, তিনি তাকে হুকুম দেন, হয়ে যাও এবং তা হয়ে যায়। পবিত্র তিনি যার হাতে রয়েছে প্রত্যেকটি জিনিসের পূর্ণ কর্তৃত্ব এবং তাঁরই দিকে তোমাদের ফিরে যেতে হবে।’ (সূরা ইয়াসিন : ৮২-৮৩)। এখানে এমনভাবে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ আদেশ করলে তা এমন আদেশ হয় যে, এক মুহূর্তও দেরি হয় না। আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকে এতটাই সম্মান দিলেন যে, তিনি এমন ক্ষমতধর স্র্রষ্টা হয়েও তাঁর সৃষ্ট মানুষকে হুকুম অমান্য করার স্বাধীনতা দিলেন। এটা মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তার জন্য সম্মানের বিষয়। তবে মানুষকে শুধু স্বাধীনতাই দেয়া হয়নি। প্রদত্ত স্বাধীনতার হিসাবও আল্লাহ নেবেন। সুতরাং সাবধান!

প্রশ্ন, আল্লাহ কেন মানুষকে এই স্বাধীনতা দিলেন? কারণ মানুষ হলো তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সেরা। আর প্রত্যেক কারিগর তার সৃষ্ট জিনিসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেতে চান। তাই আল্লাহ মানুষকে ভালোমন্দ বিচারের শক্তি দেয়ার সাথে সাথে স্বাধীনতা দিয়ে প্রমাণ করেছেন মানুষ সৃষ্টির সেরা। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। বর্তমান বিশ্বে রোবটের কার্যক্ষমতা নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক কৌতূহল রয়েছে। বিশ্বে অনেক প্রকার রোবট রয়েছে। রোবটের শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করা হয় তার কার্যক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ যে রোবট নিজে নিজে যত বেশি কাজ করতে পারে সেই রোবট তত বেশি শক্তিশালী। ঠিক আল্লাহও মানুষকে সব সৃষ্টির চেয়ে বেশি কার্যক্ষমতা দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে রেখেছেন।

আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সবচেয়ে সুন্দর করে।’ ( সূরা তীন : ৪)। মানুষের দেহের প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকালে বোঝা যাবে আল্লাহ মানুষকে কত সুন্দর এবং যৌক্তিক আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। চোখ স্থাপন করেছেন উপর নিচে দুটো হার দিয়ে। যদি দু’টি হার বেষ্টিত না হতো তাহলে সামান্য আঘাতেই নরম চোখ দু’টি আহত হতো। এভাবে মানুষকে আল্লাহ সবচেয়ে সুন্দর ও যৌক্তিক আকৃতিতে সৃষ্টি করে সম্মানিত করেছেন।

এ ছাড়া আল্লাহ প্রত্যেক আদম সন্তানকে আলাদা আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন। যাতে কারো সাথে কারো মিল নাই। যেমন হাতের আঙুলের ছাপ, চেহারা, কণ্ঠ এগুলো পৃথিবীর সব মানুষের আলাদা আলাদা। একজনের কণ্ঠের সাথে অন্যজনের কণ্ঠের মিল নাই। একইভাবে আঙুলের ছাপ ও চেহারাতেও কারো সাথে কারো মিল নেই। এটাও মানুষের জন্য একটা সম্মান।

লেখক : সাংবাদিক।


আরো সংবাদ



premium cement