২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জনকল্যাণে নতুন দিগন্ত ক্যাশ ওয়াকফ

জনকল্যাণে নতুন দিগন্ত ক্যাশ ওয়াকফ - মোহাম্মদ মিজানুর রহমান - ফাইল ছবি

‘ওয়াকফ’ ইসলামী অর্থব্যবস্থার কল্যাণমুখী বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্যের অন্যতম নিদর্শন। কেবল ধর্মীয় কারণ নয়; ওয়াকফের আর্থ-সমাজিক গুরুত্বও অপরিসীম। দরিদ্র ও অসহায় মানুষের কল্যাণ সাধনের পাশাপাশি ব্যক্তি, পরিবার ও সর্বসাধারণের কল্যাণেও ওয়াকফের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। সময়ের প্রেক্ষাপটে স্থায়ী সম্পদ ওয়াকফ করার পাশাপাশি ক্যাশ ওয়াকফ করার বিষয়টিও চালু হয়েছে। যদিও বিষয়টি একেবারে নতুন কিছু নয় তবুও আমাদের দেশে এর প্রচার-প্রসার এখনো সীমিত পর্যায়ে রয়েছে যার সম্ভাবনা নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ রয়েছে।

ক্যাশ ওয়াকফ সাধারণত ইসলামী ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। ধনবান ব্যক্তিরা এসব প্রতিষ্ঠানসমূহে মুদারাবা চুক্তির ভিত্তিতে ক্যাশ ওয়াকফ হিসাব খুলে চিরস্থায়ী দান হিসেবে ক্যাশ অর্থ জমা করেন। জমাকারী এই অর্থ স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে নিজের মালিকানা থেকে মুক্ত করে আল্লাহর সম্পদ ঘোষণা করে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জনকল্যাণে উৎসর্গ করে যা কখনো উত্তোলনযোগ্য নয়। এটি চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় জমা হিসেবে থেকে যায়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ওই বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ গ্রাহকের পছন্দ বা নির্দেশ মোতাবেক শরিয়াহ্ সম্মত খাতে ব্যয়-বণ্টন করে। কোনো ব্যক্তি ইচ্ছা করলে তাঁর সম্পদের একটি অংশ এমনকি সব সম্পদও ক্যাশ ওয়াকফ করতে পারেন।

সাধারণ ওয়াকফের মতো ক্যাশ ওয়াকফও ব্যক্তি ও সমাজের যেকোনো কল্যাণমূলক কাজের জন্য করা যায়। কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্যও ওয়াকফ করা যায়। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি ধনী-দরিদ্র যা-ই হোন না কেন ওয়াকফ ব্যবস্থা থেকে উপকার গ্রহণে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এমনকি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছা করলে নিজের জন্য এবং নিজের সন্তানদের জন্যও ক্যাশ ওয়াকফ করতে পারেন। আবার সন্তানদের সাথে নাতি-নাতনী বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্যকেও যুক্ত করতে পারেন। আবার একই সাথে পরিবার-পরিজনের কল্যাণ এবং সমাজের কল্যাণ উভয় উদ্দেশ্যেও ক্যাশ ওয়াকফ করতে পারেন।

কোনো ব্যক্তি জীবদ্দশায় তার কিছু সম্পদ বা সমুদয় সম্পদ ক্যাশ ওয়াকফ করার ক্ষেত্রে তিনি এমন শর্তও দিতে পারেন যে, তিনি যত দিন জীবিত থাকবেন তত দিন তিনি নিজে এই ক্যাশ ওয়াকফের আয় গ্রহণ করবেন। তার মৃত্যুর পর তার সন্তানরা এবং পরে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম যুগ যুগ ধরে এই ওয়াকফকৃত সম্পদের উপকারভোগী হতে পারবেন। আর যদি সন্তানাদি না থাকে তাহলে তার মৃত্যুর পর ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওয়াকফ পরিচালনা কমিটির অথবা সরকারের ওয়াকফ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সমাজের দুস্থ ও দরিদ্র লোকদের মধ্যে এর মুনাফা বিতরণ করা যাবে। এর ফলে শত শত বছর ধরে তার এ সম্পদের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকবে এবং তিনি অনন্তকাল যাবত এ দানের সওয়াব পেতে থাকবেন।

দুনিয়াজুড়ে ক্যাশ ওয়াকফের পরিধি দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও তুরস্কে ক্যাশ ওয়াকফ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মতো ক্যাশ ওয়াকফ ডিপোজিট প্রোডাক্ট চালু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি:, শাহ্্জালাল ইসলামী ব্যাংক লি:, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংকসহ অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বা উইন্ডোধারী ব্যাংকে ক্যাশ ওয়াকফ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। বর্তমানে বিশে^ ক্যাশ ওয়াকফের পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা, যার আকার এক লাখ কোটি টাকা বা তার বেশি পরিমাণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। (সূত্র : দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৩ জুলাই, ২০২০)। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ক্যাশ ওয়াকফের পরিমাণ প্রায় ১৮০ কোটি টাকা হলেও বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো যদি নতুন উদ্যমে একটি ক্যাশ ওয়াকফ আন্দোলন শুরু করে, তাহলে কেবল বাংলাদেশেই ক্যাশ ওয়াকফের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
মূলত ইসলামের শুরুতে ক্যাশ ওয়াকফ ছিল না। কেননা তখন স্থায়ী সম্পদ যেমন জমি, বাড়ি ইত্যাদি ওয়াকফ করা হতো। কিন্তু এখন বিভিন্ন দেশ ও সমাজে স্থায়ী সম্পদের অপ্রতুলতা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া লোকজন এখন অনেক ক্ষেত্রেই স্থায়ী সম্পদ ক্রয় না করে নগদ অর্থ জমা করছে, বিনিয়োগ করছে এবং নগদ জমাকৃত অর্থ থেকে লাভ অর্জন করছে। তাছাড়া অনেক সম্পদশালী ব্যক্তিরা রয়েছেন যাদের কাছে বিপুল নগদ অর্থ রয়েছে যা তারা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রাখছেন। তাদের অনেকেই সদকায়ে জারিয়া ও জনকল্যাণমূলক কাজ করতে আগ্রহী। তারা কামনা করেন যে, তাদের সম্পদ থেকে যেন মসজিদ, মাদ্্রাসা, ইয়াতিমখানা, দাতব্য সংস্থা, গবেষণামূলক সংস্থা, হাসপাতাল, সমাজকল্যাণ সংস্থা, ইসলাম প্রচার সংস্থা, পাবলিক লাইব্রেরি, মানবাধিকার সংস্থা, নিরপেক্ষ গণমাধ্যম ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান উপকৃত হতে পারে, আবার অনেকে তাদের সন্তান-সন্তুতি ও আগামী প্রজন্মের আর্থিক নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তিত যে, তারা পরবর্তীতে তাদের রেখে যাওয়া সম্পদ রক্ষা করতে সক্ষম হবেন কি না। তারা আরো কামনা করেন যে, তাদের অর্থসম্পদ যেন অন্তকাল পর্যন্ত সুরক্ষিত থাকে এবং তা থেকে তাদের সন্তানদের কল্যাণ ও জনকল্যাণ উভয়টিই নিশ্চিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে স্থায়ী সম্পদ ওয়াকফ করার পাশাপাশি ক্যাশ ওয়াকফের প্রয়েজনীয়তা দেখা দেয়।

ইসলামিক স্কলার ও ফকিহগণ মনে করেন, নগদ অর্থ বা ক্যাশও একটি সম্পদ। সুতরাং নগদ অর্থ বা ক্যাশও ওয়াকফ করা যাবে। ফতোওয়ায়ে শামী ও আহসানুল ফতোওয়া গ্রন্থে দিনার (স্বর্ণ মুদ্রা) ও দিরহাম (রৌপ্য মুদ্রা) ওয়াকফ করা জায়েজ আছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে।

আমাদের দেশের বিত্তশালীরা নিজেদের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ কেবল এক-দুই-তিন সন্তানের জন্য রেখে যান। এসব বিত্তশালী একজন কিংবা দু’জন ছেলেমেয়ের জন্য শত শত কোটি টাকার সম্পদ না রেখে অর্ধেক বা চার ভাগের এক ভাগ অর্থ ওয়াকফ করে দিতেন তাহলে এর চেয়ে অনেক কল্যাণকর হতো। আমাদের দেশের বিত্তশালীরা যদি এভাবে ওয়াকফ করতেন, তাহলে একদিকে তারা কিয়ামত পর্যন্ত সদকায়ে জারিয়া বা স্থায়ী সদকার সওয়াব পেতেন অন্য দিকে দেশের সব সামাজিক ও কল্যাণমূলক সংস্থা-সংগঠনের অর্থায়নে কোনো সমস্যা থাকত না এবং মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়, হাসúাতাল অর্থায়নেও কোনো সমস্যা থাকত না। এটি দারিদ্র্য বিমোচনেও বিরাট ভূমিকা রাখতে পারত।

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের নতুন উদ্যমে একটি ক্যাশ ওয়াকফ আন্দোলন শুরু হওয়া এখন সময়ের দাবি। ধনবান মুসলিমদের যদি ওয়াকফ, ক্যাশ ওয়াকফ এই পরিভাষার সাথে পরিচয় করানো যায় এবং ক্যাশ ওয়াকফের গুরুত্ব ও উপকারিতা এবং মানব কল্যাণে ওয়াকফের ভূমিকার বিষয়টি নতুনভাবে উপস্থাপন করা যায় তাহলে এটি দেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। ইসলামী ব্যাংকগুলো এই লক্ষ্যে নতুন উদ্যমে অগ্রসর হতে পারে এবং ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারে। ক্যাশ ওয়াকফ ডিপোজিট শরিয়তসম্মত উপায়ে বিনিয়োগ করে লব্ধ আয় যেন উপকারভোগীদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে দেয়া হয় এই লক্ষ্যে প্রতিটি ইসলামিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একটি দক্ষ ‘ক্যাশ ওয়াকফ পরিচালনা কমিটি’ থাকা বাঞ্ছনীয় যেখানে ব্যাংকের শরিয়াহ্্ সুপারভাইজরি কমিটির ফকিহ্্ সদস্যবৃন্দ ও বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানও এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ক্যাশ ওয়াকফ হতে অর্জিত আয় দ্বারা উদ্যোক্তা উন্নয়ন, জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি, কারিগরি শিক্ষা প্রদান এবং বিশেষ করে এতিম, অসহায় ও গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার্জনের ব্যবস্থা করা যায়। পরিবার পুনর্বাসন, শিক্ষা-সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা, কিংবা অন্যান্য যেকোনো কল্যাণ ও সেবামূলক খাতে ক্যাশ ওয়াকফের মুনাফা বণ্টন বা ব্যয় করা যায়। ওয়াকিফ এসব উদ্দেশ্যে কিংবা শরিয়াহসম্মত অন্য যেকোনো খাতের জন্য ক্যাশ ওয়াকফ গড়ে তোলার অধিকার রাখেন। তাছাড়া, ক্যাশ ওয়াকফ আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য প্রত্যেক এলাকায় ফাউন্ডেশন গঠন করা যেতে পারে।

একটি সুচিন্তিত ও গঠনমূলক ক্যাশ ওয়াকফ আন্দোলন দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী ও কল্যাণমুখী সমাজ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

লেখক : তুলনামূলক ফিক্হ দাওয়াহ্ ও ইসলামী ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ,
শরিয়াহ্ প্রদর্শক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লি.।
 


আরো সংবাদ



premium cement