২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ঈদ-উল-আজহা ও প্রার্থনা

ঈদ-উল-আজহা ও প্রার্থনা - ছবি : সংগৃহীত

ঈদ শব্দের অর্থ আনন্দ ও আজহা শব্দটি যেহেতু জবেহ হতে উৎপত্তি তাই এর অর্থ কোরবানি। কোরবানি অর্থ ত্যাগ বা উৎসর্গ। ঈদ-উল-আহহা’র অর্থ ত্যাগের আনন্দ।

কোরবানের উৎপত্তি
কোরবানি সম্বন্ধে জানতে হলে কোরআনের তফসীরে বর্ণিত ঘটনা আলোচনা সাপেক্ষ। আল্লাহতায়ালা তাঁর বন্ধু ইব্রাহিমকে (আ:) বেশ কয়েকবার পরীক্ষা করেছিলেন। কোনো অপরাধের সাজা হিসেবে কিংবা অজ্ঞতা, যোগ্যতা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে ছিল না, বরং পূর্ণতার স্তরে পৌঁছানোর জন্যই করেছিলেন।

আল্লাহর ভালোবাসায় তিনি এতটা পরিপূর্ণ ছিলেন, আল্লাহর নির্দেশ পাওয়া মাত্রই তিনি পরিবার পরিজনসহ স্বগোত্রে মাতৃভূমিকে হাসিমুখে ত্যাগ করে সিরিয়ায় গমন করলেন। আল্লাহর কাছ থেকে আবারো নির্দেশ এলো বিবি হাজেরা (আ:) ও তাঁর দুগ্ধপোষ্য শিশু হযরত ইসমাইলকে (আ:) সঙ্গে নিয়ে এখান থেকেও যাতে করে অন্যত্র গমন করেন। আল্লাহর নির্দেশে জিব্রাইল (আ:) তাদের নিয়ে রওনা হলেন। পথিমধ্যে কোনো শস্য-শ্যামলা বনানী এলেই হযরত ইব্রাহিম (আ:) বলতেন- “এখানে অবস্থান করা হোক।” জিব্রাইল (আ:) বলতেন, “ এখানে অবস্থানের নির্দেশ নেই। গন্তব্যস্থল সামনেই রয়েছে।”

চলতে চলতে শুষ্ক পাহাড় ও উত্তপ্ত বালুকাময় প্রান্তরে এসে গেলে সেখানেই তাদের থামিয়ে দেয়া হলো। আল্লাহর বন্ধু স্বীয় পালনকর্তার ভালোবাসায় মত্ত হয়ে এই জনশূন্য তৃণলতাহীন প্রান্তরেই বসবাস শুরু করলেন।

পরীক্ষার এখানেই শেষ হলো না। তাঁকে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিলেন “বিবি হাজেরা ও তোমার শিশুকে এখানে রেখেই সিরিয়ায় ফিরে যাও!” নির্দেশ পাওয়া মাত্র বিবি হাজেরাকে (আ:) বললেন “ আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী আমি যাচ্ছি।” তাঁকে চলে যেতে দেখে কয়েকবার ডেকে অবশেষে কাতরকন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন- “আপনি এই জনমানবহীন প্রান্তরে আমাদের একা ফেলে রেখে কোথায় যাচ্ছেন? ইব্রাহিমকে (আ:) নির্বিকার থাকতে দেখে বললেন, “আপনি কি আল্লাহর কোনো নির্দেশ পেয়েছেন? উত্তরে তিনি বললেন, “হ্যাঁ”। বিবি খুশি হয়ে বললেন, “যান, যিনি আপনাকে চলে যেতে বলেছেন তিনি আমাদেরকে ধ্বংস হতে দেবেন না।”

সাফা ও মারওয়া পাহাড়
অতঃপর সেই জনমানবহীন প্রান্তরে শিশু ইসমাঈলকে (আ:) নিয়ে বসবাস করতে শুরু করলেন। প্রচণ্ড পানির পিপাসা পেলে শিশুকে উন্মুক্ত প্রান্তরে বসিয়ে রেখে পানির খোঁজে সাফা ও মারওয়া পাহাড় সাতবার উঠানামা করলেন। কিন্তু কোথাও পানির চিহ্ন মাত্র পেলেন না। পানির কোনো চিহ্ন না পেয়ে শিশুর কাছে ফিরে এলেন। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সাফা ও মারওয়া পাহাড় দুটির মাঝখানে সাতবার দৌড়ানো কিয়ামত পর্যন্ত ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য হজের বিধি বিধানে অত্যাবশকীয় করা হয়েছে। বিবি হাজেরা এ অবস্থায় হতাশ হয়ে গেলে আল্লাহর নির্দেশে জিব্রাইল (আ:) এলেন এবং শুষ্ক মরুভূমিতে পানির একটি ঝর্ণাধারা বইয়ে দিলেন।

ঝর্ণাধারা জমজম
এই ঝর্ণাধারার নামই ‘জমজম’। পানির সন্ধান পেয়ে নানা প্রাণীর পাশাপাশি মানুষেরও আগমন হলো। মক্কায় জনপদের ভিত্তি রচিত হলো। জীবন ধারনের জন্য আসবাবপত্র সংগৃহীত হয়ে গেল। সময় গড়িয়ে চলে। ইসমাঈল (আ:) কাজকর্মের উপযুক্ত হয়ে উঠলেন। ইব্রাহিম (আ:) আল্লাহর নির্দেশ পেলে মাঝে মধ্যে তাদের এসে দেখে যেতেন।

স্বপ্নে এক রাতে পুত্র ইসমাঈলকে উৎসর্গ করতে দেখলেন : আবারো আল্লাহতায়ালা তাঁর বন্ধুকে পরীক্ষা নিতে চাইলেন। বালক ইসমাঈল দীনহীন অবস্থায় বড় হচ্ছিলেন। বাবার স্নেহ ভালোবাসা থেকেও অনেকটা বঞ্চিত ছিলেন। ইব্রাহিম (আ:) আল্লাহ হতে স্বপ্নে নির্দেশ পেলেন -“এ ছেলেকে আপন হাতে কোরবানি করো।”

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “বালক যখন পিতার কাজে কিছু সাহায্য সহযোগিতা করার উপযুক্ত হলো তখন ইব্রাহিম (আ:) বালককে বললেন, ‘হে বৎস আমি স্বপ্নে তোমাকে কোরবানি করতে দেখেছি। এখন বলো তোমার কী অভিপ্রায়? পিতৃভক্ত বালক আরজ করলেন, ‘পিতা আপনি যে আদেশ পেয়েছেন তা পালন করুন! ইনশাআল্লাহ আমাকেও এ ব্যাপারে আপনি সুদৃঢ় পাবেন।”

পিতা ইব্রাহিম (আ:) প্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে (আ:) মিনার প্রান্তরে কোরবানি করার উদ্দেশ্যে নিয়ে গেলেন। কোরবানি করার সমস্ত প্রস্ততি শেষ হলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হলেন। আল্লাহ তাঁকে একটি দুম্বা কোরবানি করার নির্দেশ দিলেন। এই রীতিটাই পরে ভবিষ্যতের জন্য একটা চিরন্তন রীতিতে পরিণতি লাভ করে। এইসব ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে যাদের সামর্থ আছে তাদের সামর্থ অনুযায়ী ছাগল, দুম্বা, গরু, উট, মহিষ প্রভৃতি কোরবানি করার বিধান ঘোষণা করা হয়। কোরবানি করার এই অনুষ্ঠান বা উৎসবকে আমরা ঈদুল আজহা বা ত্যাগের উৎসব বলে থাকি।

কোরবানি উপলক্ষে আল্লাহর বাণী
কোরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন “আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত ও রক্ত বরং পৌছায় তোমাদের তাক্ওয়া।”
তাক্ওয়া আরবি শব্দ। এক আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা বাস্তব জীবনের প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে সত্যের পথে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকাই তাক্ওয়া।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, “যারা বিশ্বাসী তারা আল্লাহর সাথে কোনো শরিক করে না এবং তাঁর সন্তুষ্টির জন্য তাঁকে সর্বদা মেনে চলে, এবং সেটাই ‘তাক্ওয়া’।”

কোরবানির মূল উদ্দেশ্য
নিজের পাশবিক প্রবৃত্তি, অসৎ উদ্দেশ্য ও হীনমন্যতাকে কোরবানি করা এবং নিজের চরিত্র ও কুপ্রবৃত্তিকে সংশোধন করার মধ্যেই রয়েছে কোরবানির মূল উদ্দেশ্য। প্রতিবেশী ও স্বজনদের মধ্যে কোরবানির গোশত বিতরণের মধ্যে রয়েছে অপরের প্রতি সহমর্মিতার শিক্ষা। এই উৎসব উদযাপনের মধ্যে রয়েছে আমাদের জন্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। সঠিকভাবে পশুর চামড়া সংরক্ষণ ও বিপননের মাধ্যমে কিংবা তা রফতানির ব্যবস্থা করলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। এই চামড়ার সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে জুতা, ব্যাগ প্রভৃতি উৎপাদনের জন্য চামড়া শিল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে অনেক বেকার ও যারা ছদ্ম বেকার সমস্যায় ভুগছেন তাদের কর্মসংস্থান করা সম্ভবপর হবে। তাছাড়া, গোশতের সাথে সম্পর্কিত অন্য উপাদানগুলোর (মশলাজাত পন্য) চাহিদা বাড়ার কারণে এসব বাজারও চাঙ্গা হয়ে থাকে।

আল্লাহর শাস্তির প্রত্যক্ষ প্রমাণ ও প্রার্থনা
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, আল্লাহ তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এই মানবকূলকে যথেষ্ট ভালোবাসেন। কোরবানের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও আত্মচেতনা জাগ্রত করার প্রেরণা ‘তাক্ওয়া’ শব্দটির মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। মানুষকে সঠিক পথে চালনা করার জন্য আল্লাহ যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন, কিন্তু আমাদের শেষ নবী হযরত মুহম্মদের (সা.) আগমনের পর আর কোনো নবীর পৃথিবীতে আগমন ঘটবে না। কোরআনে দেখানো সঠিক পথে চললেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব। আল্লাহর আইন অমান্যকারী তথা আল্লাহর বিধান অস্বীকারকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। মানুষ যখন চরমভাবে আল্লাহকে অমান্য করা শুরু করে তখনই তিনি ‘আযাব’ পাঠান। আল্লাহ বলেন-“আমি ধ্বংস করিয়াছি কত জনপদ। এগুলির বাসিন্দা ছিল জালিম। এইসব জনপদ তাহাদের ঘরের ছাদসহ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হইয়াছিল এবং কত কূপ পরিত্যাক্ত হইয়াছিল এবং কত সুদৃঢ় প্রাসাদও।”

বর্তমানে তার নিদর্শন দেখতে পাই ইতালির পম্পেই নগরীতে। এটি একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত রোমান ছোট্ট নগর। ৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভিসুভিয়াস পর্বতের আগ্নেয়গিরির দু'দিন ব্যাপী সর্বনাশা অগ্নুৎপাতে পম্পেই নগরী সম্পূর্ণ পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। ৬০ ফুট উঁচু ছাই এবং ঝামা পাথরের নিচে শহরটি চাপা পড়ে। ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মাটির নিচ থেকে শহরটিকে পৃথিবীর আলোতে নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ। এটা দেখে বা জেনেও যদি আমাদের অনেকের শিক্ষা হতো তবে ভবিষ্যতে আল্লাহ কর্তৃক দেয়া আজাব হতে রেহাই পেতাম। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন। আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলে আমরা যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হই। তার জন্য আসুন আমরা সবাই সেই প্রার্থনাই করি।


আরো সংবাদ



premium cement