১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তিস্তা বাঁচাতে রংপুর বিভাগজুড়ে ৫ মিনিটের নজীরবিহীন স্তব্ধতা

- ছবি : নয়া দিগন্ত

প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিস্তা নদী খনন মহাপরিকল্পনার জন্য চলতি বাজেটে বরাদ্দের দাবিতে যে যেখানে ছিলেন সেখানেই ৫ মিনিট দাঁড়িয়ে নজীরবিহীন স্তব্ধতায় কর্মসূচি পালন করলেন রংপুর বিভাগের মানুষ।

বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে ১১টা ৫ মিনিট পর্যন্ত এই স্তব্ধ কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে আয়োজক ও ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, এবার তিস্তা খনন শুরু না হলে রংপুর অঞ্চলের ২ কোটি মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মরবে। বিপন্ন হবে পরিবেশ-প্রকৃতি। স্তব্ধ হয়ে যাবে জীবন-জীবিকা।

বৃহস্পতিবার রংপুর বিভাগের মানুষের জন্য ছিল অন্যরকম একটি দিন। দাবি আদায়ের জন্য স্তব্ধ হয়েগিয়েছিলেন তারা। পদ্মা সেতুর মতো নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা খনন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে চলতি বাজেটে বরাদ্দের জন্য স্তব্ধ কর্মসূচির আয়োজন করে তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ। কণ্ঠে জাতীয় সংগীত। হাতে লাল সবুজের পতাকার সাথে দাবি আদায়ের প্লাকার্ড। ঠিক বেলা ১১টায় নগর ভবনের নামনে সড়কে দাড়িয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন করেন পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা ও রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। সাথে ছিলেন পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী, সাধারণ সম্পাদক সফিয়ার রহমান, জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা সদস্য সচিব হাজি আব্দুর রাজ্জাক, মহানগর সহ সভাপতি লোকমান হোসেন, জাহিদুল ইসলামসহ স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যরা।

একই সময়ে রংপুর মহানগরীর সি ও বাজার, মেডিক্যাল মোড়, বাংলাদেশ ব্যাংক মোড়, বঙ্গবন্ধু চত্বর, কাচারি বাজার, টাউনহলের সামন, সিটি বাজার, পায়রা চত্বর, জাহাজ কোম্পানি মোড়, প্রেসক্লাব, শাপলা চত্বর, খামার মোড়, লালবাগ, পার্কের মোড়, মডার্ন মোড়, দর্শনা, টার্মিনাল এবং সাতমাথায় পরিষদের নেতা এবং জাতীয় পার্টি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা স্তব্ধ কর্মসূচির আনুষ্ঠানিকতা পালন হয়। একই সাথে রংপুর বিভাগের লালমনিরহাট কুড়িগ্রাম নীলফামারী গাইবান্ধা জেলা সদর ছাড়াও প্রত্যেকটি উপজেলায় গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এবং তিস্তার দুই তীরের ৩১০ কিলোমিটার এলাকার বিভিন্ন হাটবাজারে স্তব্ধ কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় দাবি আদায়ে ৫ মিনিট স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল পুরো রংপুর বিভাগ। বেলা ১১টা থেকে ১১টা ৫ মিনিট পর্যন্ত যে যেখানেই ছিলেন, সেখানেই দাঁড়িয়ে যান। থেমে যায় যানবাহনের চাকা। দোকানপাটে বেচাবিক্রির ছিল বন্ধ।

নগর ভবনের সামনে কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলে বয়োবৃদ্ধ আমজাদ হোসেন। তার কণ্ঠে তিস্তা নদীকে বাঁচানো গেলে নতুভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে উন্নয়নের স্বপ্ন । তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, ‘আমরা নদীকে বাঁচার জন্য আসছি। নদীতে পানি নাই, নদী খুড়লে আমাদের ঘড়বাড়ি বাঁচবে, আমরা বাঁচবো। আমরা উৎপাদন করতে পারবো। দেশের উন্নয়ন হবে।’

শুধু বয়োবৃদ্ধ আমজাদ হোসেন নয়, কর্মসূচিতে যোগ দেয়া সবার কণ্ঠেই একই কথা। কারণ অসময়ে বানের জল, আর প্রয়োজনের সময় ধুধু বালুর চর, এই হলো তিস্তার বর্তমান নাম। এরই মধ্যে তিস্তা নিঃস্ব করেছে ৫ জেলার লাখ লাখ মানুষকে। জীবন-জীবিকা নিয়ে উদ্বিগ্ন তিস্তা পাড়ের মানুষ তাই চলতি বাজেটেই চান তিস্তা খনন মহাপরিকল্পা বাস্তবায়ন।

কর্মসূচিতে অংশ নেয়া গঙ্গাচড়ার গজঘণ্টা এলাকার বাসিন্দা শাহ আলম জানান, ‘তিস্তা কোনো পানি নাই। রংপুরের মানুষ হাহাকার অবস্থায় আছে। ঘড়বাড়ি, স্কুল কলেজ মাদরাসা ভেঙ্গে যাইতেছে। আমাদের একটাই দাবি, তিস্তা খনন করে আমাদের বাঁচানো হোক।’

অংশগ্রহণকারী কাউনিয়ার গনাই এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম জানান, ‘তিস্তা কোনো পানি নাই, নদী এখন শুকনা, গাড়ি চলে নদীর ওপর দিয়া। এই পানি চাই আমরা। কারণ যখনই বন্যা হয়, তখন ভাসি যায়। আর যখন পানির দরকার, তখন শুকনা হয়। চাউলের দাম, আটার দাম সব গুলারই দাম বাড়ি যায়। এই পানির ব্যবস্থা করি দিলে হামরা তিস্তা পাড়ের মানুষ নিজে আবাদ করি খাবার পাইনো হয়।’

অংশগ্রহণকারী সাজেদুল ইসলাম জানান, ‘তিস্তার কারণে লাখ লাখ লোক বাস্তহারা। হাজার হাজার গ্রাম নাই। এই জন্য তিস্তা খননের দাবি জানাতে আমি পীরগাছার তাম্বুলপুর থেকে এসেছি।’

আরেক অংশগ্রহণকারী সাজেদুল ইসলাম জানান, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের একটাই চাওয়া সেটা হলো, এই বাজেটেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তিস্তা মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ করবেন। কারণ এই প্রকল্পটি তার। তাহলে আমরা তিস্তা পারের মানুষ কষ্ট থেকে লাঘোব পাবো। দুঃখ মোচন হবে আমাদের। তিস্তাপারে একটা অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে। আবার আমরা খেয়ে পরে বাঁচতে পারবো।’

দাবিতে কর্মসূচির সাথে একাত্ম হয়েছিলেন সু-শাসনের জন্য নাগরিক-সুজন, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠন। তাদেরও দাবি, এই বাজেটেই বরাদ্দ; তা না হলে আন্দোলন।

কর্মসূচিতে একাত্মতা জানিয়ে নেতাকর্মীদের নিয়ে অংশ নেন রংপুর মহানগর ছাত্র সমাজের সভাপতি ইয়াসিন আরাফাত আসিফ। তিনি জানান, ‘ তিস্তা মহাপরিকল্পনা রংপুর অঞ্চলের সকল শিক্ষার্থীদেরও প্রাণের দাবি। নিজ দায়িত্বে তাই সাধারণ মানুষসহ শিক্ষার্থীরা ৫ মিনিটের জন্য স্তব্ধ করেছে রংপুরকে। যদি এই বাজেটে বরাদ্দ না দেয়া হয় তাহলে আমরা আর হাজার হাজার মিনিট রংপুর বিভাগ স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য প্রস্তুত আছি।’

অংশ নিয়েছিলেন রংপুর জেলা ছাত্রসমাজের সভাপতি আরিফুল ইসলাম আরিফ তার কয়েক শ’ কর্মীসহ। তিনিও জানান, ‘ ভূগর্ভস্থ পানি আরো গভীরে চলে যাচ্ছে। এতে রংপুর অঞ্চলে মরুভূমির দিকে যাচ্ছে। আমরা চাই, এই বাজেটেই তিস্তা খননের জন্য মহাপরিকল্পনার অর্থ বরাদ্দ দেয়া হোক। যদি না দেয়া হয় তাহলে আমরা তিস্তা পাড়ের মানুষের সকল আন্দোলনে সব সময় সক্রিয় অংশগ্রহণ করবো।’

অংষগ্রহণকারী বাংলার চোখ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানবীর হোসেন আশরাফী। তিনি জানান, আমরা মনে করি। তিস্তা মহাপরিকল্পনার জন্য যদি এই বাজেটেই বরাদ্দ দেয়া হয়, তাহলে এই অঞ্চলের অর্থনীতির উন্নয়ন হবে। এই অঞ্চলের মানুষের অভাব অনটন দূর হবে। তাই আমার চাই বরাদ্দ। ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার বাজেটে মাত্র সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ খুব বড় কিছু নয়। যদি না দেয়া হয় তাহলে আমরা স্বেচ্ছাসেবীরা আগামী দিনের সব আন্দোলনে একাত্ম হয়ে মাঠে থাকবো।

রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সদস্য সচিব হাজী আব্দুর রাজ্জাক জানান, আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই স্তব্ধ কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা আমাদের হৃদয়ের কথা স্তব্ধ হয়ে জানালাম। আশা করি তিনি আমাদের কথা শুনবেন। তিস্তাকে বাঁচাবেন। তাহলে আমরা বাঁচবো। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠিকে গেছে। যদি বরাদ্দ দেয়া না হয়, তাহলে আন্দোলন ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই।

কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন রংপুর মহানগর সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জু জানান, ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিজস্ব অর্থায়নে এই বাজেটে বরাদ্দ করার দাবি এই অঞ্চলের সব মানুষের দাবি। কিন্তু এটা দীর্ঘদিন থেকে ঝুলে আছে। আমরা আশা করি এই বাজেটেই এর বরাদ্দ হওয়ার মোক্ষম সময়। সরকার আন্তরিক হবেন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে। যদি এই বাজেটে বরাদ্দ দেয়া না হয়, তাহলে আমরা কঠিনতর কর্মসূচিতে যাবো।

এদিকে চীন-ভারত নয়, পদ্মা সেতুর মতো নিজস্ব অর্থায়নে এই বাজেটেই তিস্তা খনন মহাপরিকল্পনার জন্য বরাদ্দ চান কর্মসূচির আয়োজক তিস্তা বাঁচাও নদী বাচাও সংগ্রাম পরিষদ নেতারা। না হলে জীবন-জীবিকা স্তব্ধ হওয়ার আগে যত বড় আন্দোলনের প্রয়োজন, তা করার ঘোষণা তাদের।

তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী জানান, ‘আমাদের স্তব্ধকর্মসূচিতে লাখ লাখ মানুষ স্বতস্ফুর্তভাবে দাড়িয়ে গেছে। তেল মাথায় তেল আর ন্যাড়া মাথায় বাড়ি এই নীতি পরিহার করে রংপুর অঞ্চলের উন্নয়ন বৈষম্য ঘোচানোর জন্য এই বাজেটেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে বরাদ্দ দিতে হবে। যদি দেয়া না হয়, তাহলে রংপুরের উন্নয়ন বঞ্চিত মানুষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেমন যুদ্ধ করেছিল, উত্তর বাংলার মানুষ তদ্রুপ আন্দোলন করবে। আগামী দিকে প্রয়োজনে আমরা অবরোধ হরতালের মতো কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো।’

পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা ও স্তব্ধ কর্মসূচির উদ্বোধক রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা জানান, ‘তিস্তা মহাপকিল্পনার জন্য এই বাজেটে বরাদ্দ দেয়ার জন্য আমরা স্তব্ধ কর্মসুচির মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানান দিলাম। এটা এখন গণদাবিতে রুপান্তরিত হয়েছে। যদি বরাদ্দ না হয়, তাহলে এই দাবি আর দাবিতে থাকতে না। বড় আন্দোলন রুপ নেবে। দলমত নির্বিশেষে রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলার মানুষ এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যতধরণের আন্দোলন করা প্রয়োজন সেটা আমরা করবো। কারণ এটা আমাদের বাঁচামরা, জীবন-জীবিকা বাঁচানোর দাবি।’

মহাপরিকল্পনা ছাড়াও ভারত কর্তৃক উজানে নেয়া দুই খাল খননের প্রক্রিয়াবন্ধসহ তিস্তাকে ঘিরে ৬ দফা দাবি বাস্তবায়নের কথা উঠে আসে স্তব্ধ কর্মসূচিতে।


আরো সংবাদ



premium cement
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিসিডিপি গঠন করা হবে : পরিবেশমন্ত্রী অননুমোদিত জমি ভরাট কার্যক্রমের সন্ধান পেলে দ্রুত ব্যবস্থার নির্দেশ ভূমিমন্ত্রীর ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক ব্যক্তিকে গলা কেটে হত্যা ইসরাইলকে পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাতের ব্যাপারে সতর্ক করলো আইআরজিসি সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ১২৮তম প্রয়াণ দিবসে স্মরণ সভা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের শূন্য পদ দ্রুত পূরণের নির্দেশ ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে ঝুলন্ত নারীর লাশ উদ্ধার মধুর প্রতিশোধে সিটিকে বিদায় করে সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদ রাজশাহীতে ভুয়া তিন সেনা সদস্য গ্রেফতার ডেঙ্গুতে আরো একজনের মৃত্যু, আক্রান্ত ২৩

সকল