২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কৃষিতেও নারীদের রঙিন স্বপ্ন

বেড পদ্ধতিতে পানিতে সবজি চাষ - ছবি : নয়া দিগন্ত

কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেছেন গ্রামীন নারীরা। জমি পরিচর্যা ছাড়াও উৎপাদনসহ প্রায় সব পর্যায়ে এখন নারীরা সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করছেন। এতে দেশে উৎপাদন বাড়ছে। বাজার অর্থনীতি পুরো মাত্রা পুরুষদের হাতে নিয়ন্ত্রণে থাকায় কৃষিতে নারীরা তেমন কোনো মূল্যায়ন পাচ্ছের না। যদিও দেশে পালিত হয় আন্তজার্তিক গ্রামীন নারী দিবস। কৃষিতে তাদের মূল্যায়ন বার বার অন্তরায় থেকে যাচ্ছে।

গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার ঝড়াবর্ষা গ্রামে সাহানার বিয়ে হয় কৃষক আলমগীরের সাথে। বিয়ে র দু’বছর পর প্রথম মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। কৃষক আলমগীরের একার আয়ের টাকা দিয়ে সংসার চলে না। তাই সাহানা বাড়ির পাশে অন্যের পড়ে থাকা জমিতে শাক-সবজির চাষ করে । পরে সেই জমির মালিক সেখানে পুকুর খনন করেন।

জেলার যমুনার নদের কোল ঘেষে এ দম্পতির বাড়ি। একদিন বেসরকারি সংস্থা থেকে এক নারীকর্মী এসে পানির উপর সবজির চাষের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন এলাকায়। সেই প্রশিক্ষণে সাহানাও অংশ নেন। প্রথমে তার মাথায় কোনোভাবেই আসেনি যে পানির উপর ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ সম্ভব। শুরুতে হিমশিম খেলেও তিনি এখন ভাসমান পদ্ধতি সফল হয়েছেন। পানির উপর বেডসিট তৈরি করে সবজি চাষ করা সম্ভব।

শুধু সাহানা নন ঝড়াবর্ষা গ্রামের অনেক নারীই গৃহস্থালির কাজের পাশপাশি গবাদি পশু ও হাঁস মুরগি পালন, মৎস্য শস্য উৎপাদন, মৎস্য চাষ, বনায়ন সবজি চাষ ইত্যাদি কাজে পুরুষদের সমান অবদান রাখছেন। নারীরা নদীর কোল ঘেষে কচুরিপনা আর শেওলা দিয়ে ধাপ তৈরি বিভিন্ন ধরনের সবজির আবাদ করছেন। গাইবান্ধা জেলার সদর, সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদী ব্রাহ্মপুত্র,যমুনা ও তিস্তা নদী। এসব নদের অনেক বিল-ঝিলে সারাবছর পানি জমে থাকে। জমানো পানির উপর বেড তৈরি করে শীতকালীন শাক-সবজি শাক করছেন জেলা কয়েক শ’ নারী কৃষক। এ ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষে খরচ কম কিন্তু আয় বেশি হয়। এ পদ্ধতিতে চাষাবাদে রঙিন স্বপ্ন দেখছেন তারা।

জেলার সাঘাটা উপজেলার ঘুড়িসহ ইউনিয়নের যমুনা নদের গাঁ ঘেষে ঝড়াবর্ষা বিল। এ বিলের পানির উপর ভাসছে কয়েকটি শাক-সবজির বেড। দুর থেকে বোঝায় যায় না পশ্চিমে বাতাসে কী দুলছে। দেখে মনে হয় পানিতে ভাসমান লাল, নীল রঙের পানি শাক (কলমি শাক)। বাস্তবে এগুলো লাল শাক, পাটশাক, পুঁইশাক। বর্তমানে এ বিলে ভাসমান বেডে সবজি চাষে সফলতা পেয়েছেন অনেক প্রান্তিক নারী কৃষক। জেলা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে এ চাষের জনপ্রিয়তা।

চাষীরা জানান, প্রথম দিকে আশ্চর্য হয়েছিলেন পানির উপর এ চাষাবাদ সম্ভব না। সন্দীহান থেকে পরীক্ষামূলকভাবে তারা চাষাবাদ শুরু করেন। পরে এ চাষে সফলতা আসায় ভাসমান বেডে সবজি চাষে উৎসাহিত হচ্ছেন এলাকার অনেক নারী।

সরেজমিনে সাঘাটা উপজেলায় দেখা যায়, রাস্তার পাশেই ঝাড়াবর্ষা বিল। এই বিলে ভাসমান বেডে সবজি চাষ করা হয়েছে। পরপর ভাসমান আটটি বেড। তাতে কলমি শাক, লালশাক, পুইশাকসহ বিভিন্ন রকমের সবজি। কলাগাছের উপর কচুরিপানা পঁচিয়ে বেড তৈরি কার হয়েছে। প্রতিটি বেডে বীজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়াতে সবজির লতাপাতা ছড়িয়ে ঝাড় হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেখা যায় অসময়ের বৃষ্টি ও বন্যার কারণে খাল-বিল নিচু জমি তলিয়ে যায়। সেসব জমির সবজি নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষতির থেকে রক্ষা পেতে সাঘাটা উপজেলার ঝাড়াবর্ষা বিল, বিষ পুকুর বিল ও গলাকাটা বিলে পরীক্ষামূলকভাবে ভাসমান সবজি চাষ চালু করছে একটি বেসরকারি এনজিও।

একটি বেডে তিন থেকে চার বার লাল শাক, একবার পুঁইশাক, ডাটাশাক চাষ করা হচ্ছে। প্রথমে জমে থাকা পানির উপরে কলা গাছের ভেলা তৈরি করা হয়। তারপর ভেলার উপর কচুরিপনা আর শেওলা রেখে দেয়া হয় মাস খানেক। পরে কচুরিপনা ও শেওলা পঁচার পর উপরে মাটি দেয়। মাটি শুকিয়ে গেলে তার উপর বীজ বপন করে।

নারী কৃষক শরিফা বেগম জানান, ‘বেসরকারি এক এনজিওর আপা হামাও পড়ে থাকা ডোবাগুলো শাক-সবজি চাষ করতে বলেন। প্রথমে করবের চামনি। কষ্ট করা খালি ফাও হবে। পানির মধ্য বিচি পড়লে সেগুলো জালাবে ক্যামনে। একদিন নদীত থেকে অনেকগুলো কুচুরি পানা নিয়ে আসে জড়ো করে একটেনে করনু। পরে তার মিচ্ছি আনা মাটি দিয়ে কয়েক দিন শুকানো। তার উপর বিজিগুলো ছিটে দিনু । কয়েক দিন পর দেখনু বিজি গুলো কোমা জালাইছে।’

তিনি জানান, ‘এরকম করে প্রথম শুরু হয়। পরে মোর দেখা দেখি আরো কয়েকজন এগুলো করলো। এখন মই ভালোই আছম। খাবারও পাম, বাজারত বিকে আসম’।

নাছিমা বেগম বলেন, ভাসমান পদ্ধতি সবজি শাক করছি। সংসারের প্রয়োজন মিটিয়ে ও অতিরিক্ত সবজি বাজারে বিক্রি করছি। সাথে সাথে আর্থিকভাবে লাভমান হচ্ছেন তিনি। সবজি চাষি বিলকিস বেগম জানান, ‘হামার ঘরে সবজি চাষ দেখিয়া গ্রামের সবাই করবের চাবার নাগছে। হামরা খুব খুশি। এমাসে হাজার বারো শ‘ টাকার শাক বেঁচচি’।

উদয়ন স্বাবলম্বীর মমতা খাতুন বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের পথে অন্যতম একটি অর্জন হচ্ছে গ্রামীন নারীর বহুমাত্রিক ভূমিকা। তাদের কাজের এই স্বীকৃতি গ্রাম উন্নয়নের পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত করে। নারীকে বাদ দিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির অগ্রগতি সম্ভব নয়।


আরো সংবাদ



premium cement