২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রংপুরে বিএনপির গণসমাবেশ আজ, পথে পথে বাধা

রংপুরে বিএনপির গণসমাবেশ আজ, পথে পথে বাধা - ছবি : নয়া দিগন্ত

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং চলমান আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে পাঁচজন নেতাকর্মীর নিহতের প্রতিবাদে রংপুরে বিভাগীয় গণসমাবেশ আজ। সমাবেশের আগে ডাকা ৩৬ ঘণ্টার ধর্মঘটকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সমাবেশে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষের জমায়েতের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি নেতারা। তাদের দাবি এই ধর্মঘট গণসমাবেশে কোনো ধরনের বিঘ্ন ঘটাতে পারবে না বরং জনসমাগম ধারণার চেয়েও আরো অনেক বেশি হবে। এরই মধ্যে পথে পথে বাধা, পুলিশের চেক পোস্ট, তল্লাশি ডিঙিয়ে গণসমাবেশে যোগ দিতে তিনদিন আগে থেকে রংপুরে আসা শুরু করেছেন বিভাগের বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীরা। শুক্রবার রাতেই সমাবেশস্থল কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠ কানায় কানায় ভরে যায়। তাঁবু টানিয়ে নেতাকর্মীরা মাঠেই রাত যাপন করেন। রাতভর স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত থাকে মাঠ।

ধর্মঘটে দুর্ভোগ : পরিবহন ধর্মঘটে দুর্ভোগের সীমা পরিসীমা নেই রংপুর বিভাগজুড়ে। বিশেষ করে চাকরিপ্রার্থী ও রোগীরা পড়েছেন মহা বিপাকে। ভেঙে ভেঙে গন্তব্যে যাওয়ার কারণে সময় নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বাড়তি টাকাও খরচ হচ্ছে যাত্রীদের। মালামাল পরিবহন নিয়েও ভোগান্তিতে আছেন ব্যবসায়ীরা। শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টায় রংপুর মহানগরীর মডার্ন মোড়ে দাঁড়িয়েছিলেন গাইবান্ধার ফুলছড়ির রফিজ আল হক। অসুস্থ হওয়ায় ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। ছাড়পত্র দেয়ায় ক্লিনিক থেকে বের হয়ে বাড়ি যাওয়ার পথে আড়াই ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা ছিল তার। রফিজালের মতো পীরগঞ্জের সাতবারগা এলাকার আদুরী বেগম ইউট্রাসের অপারেশন শেষে বাড়ি যাওয়ার পথে মডার্ন মোড়ে গিয়ে এভাবেই ভোগান্তিতে পড়েন। বাড়তি টাকা ও সময়ে অপচয় হচ্ছে তাদের। নগরীর কামারপাড়া ঢাকা কোচ স্টান্ড এবং কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালেও ছিল একই অবস্থা। ঢাকায় শনিবার যাদের পরীক্ষা ছিল তারাও চিন্তিত ছিলেন। ভেঙে ভেঙে অটোতে করে বগুড়া পর্যন্ত যাওয়ার প্রস্তুতি দেখা গেছে তাদের মধ্যে। নারী যাত্রীদের দুর্ভোগ ছিল চোখে পড়ার মতো।

বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও গণসমাবেশ আয়োজক কমিটির সমন্বয়ক আসাদুল হাবিব দুলু জানান, আমরা আগে থেকেই জানতাম সমাবেশের আগে সরকার এ ধরনের একটি ধর্মঘট দেবে। আমাদের নেতাকর্মীরা এ ধর্মঘটকে পাত্তা দিচ্ছে না। ইতোমধ্যে বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী রংপুরে চলে এসেছে। গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকলেও হেঁটে, সাঁতরিয়ে অথবা সাইকেল চালিয়ে হলেও সমাবেশে আসবে। রংপুরের এই সমাবেশে রেকর্ডসংখ্যক লোকের উপস্থিতি হবে উল্লেখ করে তিনি জানান মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই সমাবেশে আসছে তাই কোনো ধরনের অপকৌশল করে জনস্রোত আটকে রাখা যাবে না।

পথে পাথে বাধা : সমাবেশে আসার পথে রাস্তায় আওয়ামী লীগের হামলা ও পুলিশের বাধার অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। গণসমাবেশ বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা: এজেডএম জাহিদ হোসেন অভিযোগ করে বলেন, পুরো বিভাগের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে। হুমকি ধামকি দিচ্ছে। পুলিশের সাথে আওয়ামী লীগের লোকজনও বাধা দিচ্ছে। রেলওয়ে স্টেশনেও পুলিশ বাধা দিচ্ছে। ছাত্রাবাস এবং নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক তল্লাশি চালাচ্ছে। যতই অপতৎপরতা চালানো হোক না কেন সব রংপুরে শনিবারের জনসমাবেশে মানুষের জোয়ার উঠবে। এরই মধ্যে সব বাধা ভেঙে সমাবেশস্থল ভরে গেছে।

পূর্বের অভিজ্ঞতা থাকায় এক দিন আগেই গণসমাবেশে যোগ দিয়েছেন কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার সাবেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান। তার মতোই দেড় শ’ মেইল পেরিয়ে তিন দিন আগে এসেছেন লালমনিরহাটের পাটগ্রামের তিনবিঘা করিডোরের জহুরুল হক। একই কারণে দিনাজপুরের বিরল থেকে এসেছেন সাগর। তাদের মতো উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে এরই মধ্যে সমাবেশস্থলে যোগ দিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। শুধু পুরুষরা নন নারী নেতাকর্মীরাও এসেছেন আগাম। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত পুরো নগরী। রাতে মাঠেই থাকবেন আগাম আসা নেতাকর্মীরা। খাবারের সঙ্কটের শঙ্কায় সাথে এনেছেন চিঁড়া মুড়ি গুড়।

গাইবান্ধা জেলা মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক মৌসুমি বেগম তমা জানান, ‘আমি আড়াই শ’ মহিলা নিয়ে মাঠে এসেছি। মাঠেই থাকব। তবুও খালেদা জিয়াকে মুক্ত করবই ইনশাআল্লাহ।’

রংপুর নগরীর কালেক্টরেট ঈদগাহ ময়দানে শনিবার বিকেলে বিএনপির ধারবাহিক চতুর্থ বিভাগীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতারা উপস্থিত থাকবেন।

রংপুরে গণসমাবেশের আগের দিন বিএনপির বিরুদ্ধে উসকানি দেয়ার অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করেছে আওয়ামী লীগ। এ সময় বিএনপির নেতাকর্মীরা তাদের ব্যানার ফেস্টুন সরিয়ে সমাবেশের ব্যানার লাগিয়েছে বলে অভিযোগ তোলা হয়। তবে অভিযোগের পাল্টা জবাব দিয়েছে বিএনপি। দলের ভাইস চেয়ারম্যান ডাক্তার এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, রংপুরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ তাদের বিলবোর্ড ঢেকে বিএনপির সমাবেশের বিলবোর্ড লাগানোর যে মিথ্যা অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করেছে তা একেবারেই ভিত্তিহীন।

তিনি বলেন, ‘আমরা ঠিকাদারি কোম্পানির কাছ থেকে বিলবোর্ড লাগানোর জন্য ভাড়া নিয়েছি। যদি তাদের কিছু বলার থাকে তাহলে সেই কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করুক।’ তিনি আরো বলেন, সমাবেশের দিন আগে বাস ট্রাকসহ যে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে তা সরকারেরই একটি নীলনকশা এবং তা বাস্তবায়ন করেছে মোটর মালিক সমিতি। তবে সকল বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে আগামী কালের সমাবেশে জনস্রোত ঘটবে এবং রংপুরের সমাবেশ থেকেই সরকার পতনের আন্দোলনের নতুন মাত্রা যোগ হবে বলেও জানান তিনি।

রাজশাহী থেকে রংপুরগামী বাস চলাচল বন্ধ ঘোষণা
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে এবার রাজশাহী থেকে রংপুরগামী বাস চলাচল আগামী দু’দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নাশকতার আশঙ্কায় রংপুর, বগুড়ার পর এবার রাজশাহী থেকেও বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন পরিবহন নেতারা। ফলে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে রাজশাহী থেকে রংপুর রুটের কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। এর আগে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজশাহী থেকে সবশেষ বাস রংপুরের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে।

রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মতিউল হক গণমাধ্যমকে বলেন, বিএনপির সমাবেশটা মূল বিষয় নয়। মূলত রংপুরের অভ্যন্তরীণ কারণে দু’দিনের পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। সেখানে কোনো বাস চলবে না। তাই অন্য জেলা থেকেও বাস যাবে না। রংপুর বাস মালিকদের পক্ষ থেকে তাদেরও রংপুরে বাস না পাঠাতে বলেছেন। তাই তারা এ দু’দিন বাস বন্ধ রাখবেন।

ট্রেনে রংপুরে যাচ্ছে নীলফামারীর বিএনপির নেতাকর্মীরা
নীলফামারী প্রতিনিধি জানায়, রংপুরে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের আগে দুই দিনের পরিবহন ধর্মঘট থাকায় ট্রেনে করে রংপুরে যাচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। শুক্রবার সকাল থেকেই নীলফামারীর ডোমার উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা রেলস্টেশনে জড়ো হতে থাকেন। নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে ভরে যায় চিলাহাটি ও ডোমার রেল স্টেশনের প্লাটফর্ম। ট্রেনের কক্ষে জায়গা না থাকায় শুক্রবার তিতুমীর ও সীমান্ত ট্রেনে নেতাকর্মীরা ঝুলে-দাঁড়িয়ে রংপুর সমাবেশে যোগ দিতে ডোমার ছাড়েন। শনিবার রংপুরে যেতে বাধা আসতে পারে তাই আগে ভাগেই রংপুরে যাচ্ছেন নেতাকর্মীরা।

শুক্রবার বিকেলে তিতুমীর ট্রেনে উপজেলা বিএনপির সভাপতি রেয়াজুল ইসলাম কালু ও সাধারণ সম্পাদক আখতারুজ্জামান সুমনের নেতৃত্বে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের প্রায় দুই হাজার নেতাকর্মী রংপুরের উদ্দেশে রওনা দেন।

যুবনেতা লোকমান হোসেন লাভলু বলেন, শনিবারের মহাসমাবেশের আগে পরিবহন ধর্মঘট থাকায় আমরা এক দিন আগেই রংপুরে গিয়ে অবস্থান নিবো। শনিবার রংপুরে যেতে বাধা আসতে পারে তাই নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে আমরা সমাবেশের উদ্দেশে ডোমার ছাড়লাম।

উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আখতারুজ্জামান সুমন বলেন, ডোমার, ডিমলা ও নীলফামারীর কোনো বাস বা মাইক্রোবাস আমাদের কাছে ভাড়া দিচ্ছে না। আমরা পরিবহন মালিক ও নেতাদের সাথে আলোচনা করেছি, তারা আমাদের জানান গাড়ি ভাড়া দেয়া যাবে না উপরের চাপ রয়েছে। তাই সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে আমরা প্রায় তিন হাজার নেতাকর্মী ট্রেনেই করেই রংপুর যাচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা পার্বতীপুরে নেমে রংপুর যাওয়ার কোনো যানবাহন না পেলে হেঁটেই রংপুরে যাবো। উপজেলা বিএনপির সভাপতি রেয়াজুল ইসলাম কালু বলেন, শনিবারের বিএনপির যে মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে সেই সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে আমরা সমাবেশের এক দিন আগেই রংপুর যাচ্ছি। সরকার যতই বাধা দিক এই সমাবেশ হবে স্মরণকালে সর্ববৃহৎ সমাবেশ।

গাইবান্ধা (গোবিন্দগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, রংপুরে বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে রংপুর বিভাগে পরিবহন ধর্মঘটে গোবিন্দগঞ্জসহ রংপুর বিভাগে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে করে জনসাধারণ মারাত্মক দুর্ভোগে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন রোগীরা।

সরেজমিন গোবিন্দগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা যায়, রোগীরা রংপুর মেডিক্যাল কলেজে যাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ডে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। অসুস্থ রোগী বাছিরন বেগম (৫৬) জানান, সকাল সাড়ে ৯টা থেকে রংপুর মেডিক্যালে যাওয়ার জন্য ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের গোবিন্দগঞ্জ থানা মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আরেক রোগী নুরুল ইসলামও সকাল ১০টায় থানা মোড়ে এসেছেন। বাস না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন তারা।

জনসাধারণের অভিযোগ, অনেকেই ধর্মঘটের কথা না জানার ফলে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়িয়ে আছেন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। কিন্তু বাস পাচ্ছেন না। এভাবেই চরম দুর্ভোগে পড়েছে রোগীসহ সাধারণ মানুষ।

এ দিকে হঠাৎ করে রংপুর জেলা মোটর মালিক সমিতি সকাল ৬টা থেকে ৩৬ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে। ফলে গোবিন্দগঞ্জসহ রংপুর বিভাগে দূরপাল্লার বাসসহ সবধরনের গণপরিবহন শুক্রবার ভোর থেকেই চলাচল বন্ধ রয়েছে।

জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার গোবিন্দগঞ্জ দিয়ে যেতে হয় উত্তরের আট জেলায়। ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের থানা মোড়ে সকাল থেকেই উত্তরের পরিবহনের চাপে যানজট লেগেই থাকে। কিন্তু গতকাল ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। সকালেই পরিবহন ছিল অনেক কম। মহাসড়ক ছিল ফাঁকা। ফলে অটোভ্যান রিকশার দখলে ছিল ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক।


আরো সংবাদ



premium cement