১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাবার ঘানিশিল্পকে ৫০ বছর ধরে আঁকড়ে আছেন দু’ভাই

বাবার ঐতিহ্যবাহী ঘানিশিল্প ৫০ বছর আঁকড়ে আছেন শামসুল হক ও সলিম উদ্দীন - ছবি : নয়া দিগন্ত

জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঘানিশিল্পকে আজো আঁকড়ে ধরে আছেন, পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী উপজেলার আপন দুই ভাই। কঠোর পরিশ্রমী দু’ভাই হলেন শামসুল হক (৬৭) ও সলিম উদ্দীন (৬৫)।

বাপ-দাদার পৈতৃক পেশাকে জীবনের শেষ বয়সে এসেও পরিবর্তন করেননি আপন এ দু’ভাই।

অটোয়ারী উপজেলার তোড়িয়া ইউনিয়নের সুখ্যাতি গ্রামে তাদের বাস। তারা ওই গ্রামের মৃত দবির উদ্দিনের ছেলে। আধুনিক আর ডিজিটাল যুগে এসেও আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি র্দীঘ ৫০ বছরের জীবনযুদ্ধে নিজেদের পেশা হিসেবে টিকিয়ে রেখেছেন।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই শিল্প হারিয়ে গেলেও লড়াকু সৈনিকের মতো এই পেশার ঘানি টেনেই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে যাচ্ছেন প্রৌঢ় এ দুই ভাই।

শামসুল হক জানান, তিন ভাই-বোনের মধ্যে আমি বড়। আমার বয়স যখন ১৭ বছর, তখন বাবা মারা যান। তারপর কয়েক বছর পরে মাও মারা যান। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর অভাবের সংসারের হাল ধরতে হয় দু’ভাইকে। সেদিন কোনো কূল-কিনারা খুঁজে না পেয়ে বাবার রেখে যাওয়া পেশা ঘানিটাকে বেছে নিয়েছি। ঘানি টানার পাশাপাশি জমিতে কৃষিকাজও করেছি। এভাবে টাকা উপার্জন করে ছোটবোনকে বিয়ে দিয়েছি।

তিনি বলেন, এই করে চলতো আমাদের সংসার। এখন আমার পরিবারে ৫ জন ছেলে-মেয়ে। সবাইকে বিয়ে দিয়েছি। ছেলেরা কৃষিকাজের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোনোমতে জীবন-যাপন করছে। নাতি-নাতনিরা স্কুল-মাদরাসায় পড়াশুনা করছে।

সলিম উদ্দীন জানান, তখনকার দিনে ঘানির সরিষা তেলের চাহিদা খুব বেশি থাকায় বড় ভাই (শামসুল হক) বাবার রেখে যাওয়া ঘানিটা চালাতো আর আমি পৃথকভাবে কাঠের ঘানি (গাছ) স্থাপন করি। এমনকি এখনো ঘানির গাছ দুটো চলমান রয়েছে।

এদিকে বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির সরিষার তেল আসায়, ঘানির খাঁটি সরিষা তেলের চাহিদা অনেকটা কমে গেছে। তাই বর্তমানে ঘানি থেকে যে তেল উৎপাদন হয় তা নিয়ে আটোয়ারী উপজেলার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ফকিরগঞ্জ, তোড়িয়া ও বারঘাটি বাজারে অস্থায়ী ভিত্তিতে মাটিতে দোকান বসিয়ে দু’ভাই পাশাপাশি বসে এখনো ঘানির খাঁটি সরিষার তেল ও খৈল বিক্রি করেন।

তিনি আরো জানান, বর্তমানে চাহিদা কম থাকায় দুইদিন পরপর ২০ কেজি সরিষার ঘানি টানা হয়।‌ ২০ কেজি সরিষার দাম ১৬০০ টাকা। ২০ কেজি সরিষা থেকে ৬ কেজি তেল আসে। প্রতি কেজি খাঁটি সরিষার তেল ৩০০ টাকা দরে বিক্রি করি। তেলের পাশাপাশি ২০ কেজি সরিষা থেকে ১৪ কেজি খৈল আসে। ৫০ টাকা কেজি দরে খৈল বিক্রি হয়। ৬ কেজি তেল বিক্রি হয় ১ হাজার ৮০০ টাকা। ১৪ কেজি খৈল বিক্রি হয় ৭০০ টাকা। তেল ও খৈল মিলে ২ হাজার ৫০০ টাকা।

২০ কেজি সরিষার ঘানি টেনে মাত্র ৯০০ টাকা আয় করেন সলিম উদ্দীন। বড় ভাই শামসুল হকও করেন সমপরিমাণ আয়। ২০ কেজি সরিষার ঘানি টানতে সময় লাগে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। গড়ে প্রতি মাসে ১৪ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করেন।

আগে ঘানির খাঁটি সরিষার তেল কেনার জন্য দূর-দূরান্তর থেকে মানুষজন বাড়িতে ভিড় করতো। আগে চাহিদা বেশি থাকায় প্রতিদিন ৩০ কেজি থেকে ১ মন সরিষার ঘানি টানা হতো। এখন চাহিদা কম হওয়ায় দুইদিন পরপর ২০ কেজি সরিষার ঘানি টানা হচ্ছে।

র্দীঘ ৫০ বছর ঘানিশিল্পের আয় দিয়ে তেমন কিছুই করতে পারেননি শামসুল ও সলিম দুই ভাই। তবে এই ঘানি থেকে যে টাকা আয় হতো তা জমিয়ে জমিয়ে ছেলে-মেয়েদেরকে কমবেশি লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছেন।

শুধু সলিম উদ্দীনের পরিবারে ৬ জন ছেলে-মেয়ের মধ্যে ছোট ছেলে মোশাররফ হোসেন আটোয়ারী মির্জা গোলাম হাফিজ ডিগ্রী কলেজে স্নাতক (বিএ) ১ম বর্ষে অধ্যয়নরত।

মোশাররফ জানান, এ শিল্প যেন আমার বাবা ও চাচার রক্তের প্রতিটি কণায় মিশে আছে। প্রতিদিন সকালে দেখি গরুর সাথে ঘানি টানছেন বাবা ও চাচা। এই তেল বিক্রির টাকায় আমাকে লেখাপড়া করাছেন।

প্রতিবেশী হবিবর রহমান জানান, দু’জনে কর্মঠ এবং খুবই সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ। এই বয়সে এখনো কৃষিকাজের পাশাপাশি দু’ভাই গরু দিয়ে কাঠের ঘানি টেনে সরিষার তেল তৈরি করে আসছেন। এটা এক বিরল দৃষ্টান্ত।


আরো সংবাদ



premium cement