২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রংপুরে নর্দান প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেল থেকে বের করে দেয়া হলো ৩২ নেপালী শিক্ষার্থীকে

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের ডিজিকে ঘেরাও করে মালিকদের বিচার ও মাইগ্রেশনের দাবি
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে তাকে ঘেরাও করে দাবি বাস্তবায়নের কথা বলেন নর্দান প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা। - ছবি : নয়া দিগন্ত

একডেমিক নবায়ন, বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন ছাড়াই পত্রিকায় ভুয়া বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীর কাছে থেকে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে মালিকদের বিচার এবং চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণে মাইগ্রেশন নিশ্চিত করার দাবিতে সোমবার দশম দিনের মতো আন্দোলন করেছেন রংপুরের নর্দান প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা। এসময় তারা রংপুর মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে তাকে ঘেরাও করে দাবি বাস্তবায়নের কথা বলেন। এর আগে রোববার রাতে কলেজ কর্তৃপক্ষের ভাড়া করা হোস্টেল থেকে ৩২৩ নেপালী শিক্ষার্থীকে বের করে দেয়ায় তারা থানায় গিয়ে অবস্থান নেন।

দাবি আদায়ের টানা দশম দিনের কর্মসূটিতে সোমবার সকাল ১০টা থেকে নর্দান প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের ক্যাম্পাস থেকে তিন শতাধিক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয়ের সামনে এসে জড়ো হন। সেখানে তারা তাদের দাবির পক্ষে বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন। একইসাথে তারা রংপুর সফররত স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: এএইচএম এনায়েত হোসেনের কাছে একটি স্মারকলিপিও দেন।

মহাপরিচালকের সাথে দেখা করতে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা। দুই ঘণ্টা পর বেলা সোয়া ১২টায় মহাপরিচালক চলে যাওয়ার সময় শিক্ষার্থীরা তাকে আটকে মাইগ্রেশনের দাবি জানান। কিন্তু তিনি তাদের কোনো কথা না শুনেই দ্রুতগতিতে গাড়িতে উঠে অধ্যক্ষের কার্যালয় ত্যাগ করেন। এসময় হতাশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। তারা মাটিতে শুয়ে মাইগ্রেশনের দাবি জানান। এরমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন আবু রায়হান সরকার ও উম্মে ফাতিমা নামের দুই শিক্ষার্থী। তাদেরকে হাসাপাতালে ভর্তি করা হয়।

এসময় সেখানে উপস্থিত মহাপরিচালক স্মারকলিপি পাওয়ার কথা জানিয়ে সাংবাদিকদের জানান, বিষয়টি বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে দেখে তারপর বলতে হবে। এর আগে কিছুই বলা যাবে না। তার এই বক্তব্যে সেখানে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ করে দেয়ার দাবি জানান। পরে তারা ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন।

এদিকে রোববার রাত সাড়ে ১০ আন্দোলনরত নর্দান প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের নেপালী ৩২ শিক্ষার্থীকে রোববার রাতে হোস্টেল থেকে বের করে দেয়া হয়। পুলিশ জানিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ ভাড়া বাসার টাকা পরিশোধ না করায় তাদের বের করে দিয়েছে বাসার মালিক। আর শিক্ষার্থীরা বলছেন, হোস্টেলের টাকা অনেক আগেই পরিশোধ করেছেন তারা।

কোতয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুর রশিদ জানান, মহানগরীর মেডিক্যাল পূর্বগেট এলাকায় অবস্থিত নর্দান প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজটিতে বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনের ভুয়া তথ্য দিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করার কারণে এখন ইন্টার্ন করতে পারছেন না সেখানকার ৩৪ শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও প্রায় আড়াই শতাধিক বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় গত ১০ দিন থেকে সেখানে লাগাতার আন্দোলন চলছে।

এরই মধ্যে আন্দোলনকারী ৩২ নেপাল শিক্ষার্থীকে রোববার রাত সাড়ে ১০টায় কর্তৃপক্ষের ভাড়া করা নগরীর হাজিপাড়ার ১৯/৩ নং বাড়ি কাম হোস্টেল থেকে বের করে দেয় মালিক নুরুল হক। বিপাকেপড়া বিদেশী শিক্ষার্থীরা দেড়ঘণ্টা কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থান করে রাত সাড়ে ১২টায় থানায় এসে লিখিত অভিযোগ করেন। লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আমরা ভাড়া বাসার মালিককে থানায় ডেকে এনে রাতেই আবাসিক সমস্যা সমাধান করি। এবং পুলিশের সহযোগিতায় তাদেরকে গভীররাতে আবারো তুলে দিয়ে আসি। আর নবায়ন, রেজিস্ট্রেশন ও অনুমোদনের বিষয়টি আমরা মালিকপক্ষের সাথে আলোচনা করছি।

নেপালী শিক্ষার্থীদের বের করে দেয়া হোস্টেলের ভাড়া বাসার মালিক নুরুল হক জানান, গত সাত মাস থেকে বাসার ভাড়া পাচ্ছি না। ব্যাংক লোন খেলাপী হয়ে যাচ্ছে। মালিকপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেও ভাড়া পাচ্ছি না। একারণে শিক্ষার্থীদের বের করে দেয়া হয়েছে। মালিকপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে আহসান হাবিব সবুজ নামের এক ব্যক্তির ফোন এবং পুলিশ ডেকে এনে আমাকে আবারো শিক্ষার্থীদের তুলে নিতে বলা হয়েছে। সেটি আমি করেছি। আমি আমার ভাড়ার টাকা চাই।’ প্রতি মাসে ৬৫ হাজার টাকা ভাড়া বলেও জানান তিনি।

এদিকে নেপালী কৃষ্ণ মাল্য ও যাদপ জানান, ‘হোস্টেল ফিসহ আমরা সমস্ত টাকা আগেই কর্তৃপক্ষকে দিয়েছি। কিন্তু তারা বাসার মালিককে টাকা না দেয়ায় এই পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। এই বাসার মালিক এর আগেও ইলেকট্রিক লাইন কেটে দিয়েছে। পানির লাইন কেটে দিয়েছে। এমনটি পড়াশুনা করা অবস্থাতেও এই কাজ দুটি তিনি করেছেন। নেপালী শিক্ষার্থী হিসেবে এটাতে আমরা খুব কষ্ট পেয়েছি। আমাদেরকে বের করে দেয়া হলে আমরা বিষয়টি প্রথমে নেপালে অ্যাম্বাসিতে জানাই। পরে পুলিশ স্টেশনে গিয়ে পুলিশের সহযোগিতা নেই।’

নেপালী এই দুই শিক্ষার্থীর আরো অভিযোগ, হোস্টলে থেকে বের করে দেয়ার পর শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ও থানায় অবস্থানকালেই কলেজ কর্তৃপক্ষের সবুজ নামের এক প্রতিনিধি এসে শিক্ষার্থীদের ছবি তোলেন এবং ভয়ভীতি দেখানোর চেষ্টা করেন।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত আহসান হাবিব সবুজ বলেন, আমি কলেজের ছাত্র শাখার সহকারী। বিদেশীদের বের বের দেয়ার খবর পেয়ে মালিকপক্ষের হয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছি। কাউকে হুমকি দেইনি। তবে ছবি তুলেছি।

এ ব্যাপারে কলেজটির ব্যবস্থাপনা কমিটির পরিচালক আফজাল হোসেন জানান, ‘গত বছর ডিসেম্বর মাসে আমরা ২০১৩-১৪ থেকে অদ্যবধি একাডেমিক অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে নির্ধারিত ফি দিয়ে আবেদন করেছি। কিন্তু তারা ক্যাম্পাসে আসেনি এবং অনুমোদন দেয়নি। সেকারণে এই অসুবিধা সৃষ্টি হয়ছে। একাডেমিক অনুমোদন হলেই অটো বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন হবে। তখন শিক্ষার্থীরা ইন্টার্ন করতে পারবেন।’

তিনি দাবি করেন, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত কলেজটিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন আছে।

এছাড়াও তিনি জানান, ‘ভাড়া বাড়ির মালিককে কয়েকদিন আগে ৩ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। বাকি টাকা মার্চের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নেপালী শিক্ষার্থীদের বের করে দিয়ে অপরাধ করেছে। রাতেই শিক্ষার্থীদের হোস্টেলে ফিরিয়ে না নিলে আমরা তার বিরুদ্ধে মামলা করতাম।’

প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও শর্ত পূর্ণ না করায় কলেজটির একাডেমিক নবায়ন ও বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয় ১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন বাতিল হয় পরের বছর। এরপরই চতুরতার আশ্রয় নিয়ে হাইকোর্টে রিট করে পত্রিকায় অনুমোদন থাকার মিথ্যা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গত সেশন পর্যন্ত ভর্তি করায় কলেজটি। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি শত কোটি টাকার ওপরে পকেটস্থ করে বলে জানান শিক্ষার্থীরা।


আরো সংবাদ



premium cement