২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর

বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর - ছবি : নয়া দিগন্ত

মাটির ঘর, যা ছিল গ্রাম বাংলার উত্তম বাসস্থান। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে সে ঘর। দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার কোথাও দেখা মেলে না মাটির ঘর।

উপজেলার পৌর এলাকার কাঁটাবাড়ী, গৌরীপাড়া, সুজাপুর, চাঁদপাড়া, চকচকা, বারকোনাসহ উপজেলার প্রায় প্রত্যেকটি ইউনিয়ানে চোখে পড়ার মতো ছিল মাটির ঘর। ধনী-গরিব সকলেরই থাকতো এই ঘর। শীতকালে যেমন গরম অনুভব হতো তেমনি গ্রীষ্মকালেও মাটির ঘর থাকতো ঠাণ্ডা-শীতলতার অনভূতি। খুব সহজেই তৈরি করা যেতো এই ঘর।

অল্প খরচেই তৈরি হতো এসব ঘর। কৃষাণ-কৃষাণী ও তাদের ছেলে-মেয়েরা মিলেই অল্প কয়েক দিনেই এই ঘর তৈরি করত। যে মাটি দিয়ে ঘর তৈরি করা হতো সেই মাটিতে কোদাল দিয়ে ভালো করে কুপিয়ে ঝুর-ঝুরে করে নেয়া হতো। তারপর তার সাথে পরিমাণ মতো পানি মিশিয়ে থকথকে কাদা করে নেয়া হতো। তারঃপর সেই মাটি দিয়ে তৈরি করা হতো মাটির ঘর।

অল্প-অল্প করে মাটি বসিয়ে ৬ ফুট থেকে ৭ ফুট উচ্চতার পূর্ণাঙ্গ ঘর তৈরি করতে সময় লাগতো এক মাসেরও বেশি। ঘর তৈরী শেষ হলে তার উপর ছাউনি হিসেবে ব্যবহার হতো ধানের খড়। খড় দিয়ে এমনভাবে ছাউনি দেয়া যেন ঝড়-বৃষ্টি কোনো আঘাতেই তেমন একটা ক্ষতি করতে পারতো না। শিবনগর, দৌলতপুর ও রাজারামপুর ইউনিয়ান এলাকায় মাটির ঘরে আলাদা বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যেত। যারা একটু প্রভাবশালী তাদের বাড়ি ছিল মাটির তৈরী  দু’তালা বাড়ি। এখনো এই সকল এলাকায় কারো কারো শত বছরের মাটির তৈরী দু‘তলা বাড়ি লক্ষ্য করা যায়। মাটির ঘর অনুসন্ধান করতে গিয়ে শিবনগর ইউনিয়নের মহেশপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আক্কাছ আলী জানান ৬/৭টি ইটের ঘর হওয়া সত্বেও তিনি বাব-দাদার আমলের দোতলা মাটির ঘরটি ভেঙে ফেলতে পারেন না। উপরোন্ত তিনি নিজেই এই মাটির ঘরে এখনও বসবাস করছেন।

খয়েরবাড়ী ইউনিয়ানের বারাইপাড়া গ্রামে মো: জোবালুর রহামনের বাড়ি এখনো শত বছরের পুরনো দোতালা মাটির ঘর দেখা যায়। কথা হয় তার সাথে। ঐ বাড়ির গৃহকত্রী জানান, এই বাড়ি তাদের পূর্ব-পুরুষদের আমলে তৈরি। যে আমলে এই বাড়িটি তৈরি করা হয়েছে তখনকার সময়ে এই রকম দোতালা মাটির বাড়ি জমিদারীর একটি নমুনা ছিল। যার প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক থাকতো তরাই দোতালা বাড়ি বানাতো বলে জানান গৃহকত্রী।

ফুলবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আদিবাসি সাঁওতাল জনগোষ্ঠীদের মাঝে এখন ছোট ছোট মাটির ঘর দেখা যায়। অবশ্য এখন যাদের মাটির ঘর রয়েছে সেটা দরিদ্র্যতার ছাপ। সাঁওতালদের মাটির ঘরে বসবাস করাটা তাদের নিজস্ব একটি সংস্কৃতি হিসেবে মনে করা হয়। অনেক টাকা পয়সা থাকা সত্বেও কোনো কোনো সাঁওতাল আদিবাসী তাদের মাটির ঘর পরির্বতন করেনি। তেমনি দেখা যায় ফুলবাড়ী উপজেলার মালিপাড়া গ্রামের বিমল মণ্ডলে বাড়িতে এখনো রয়েছে মাটির ঘর। একাধিক পাকা দালান থাকা সত্বেও তার পাশেই রয়েছে মাটির ঘর। মাটির ঘরকে তারা কখনো খাটো চোখে দেখেন না। শুধু বিমল মণ্ডলই নন, এখনো অনেক হিন্দু পরিবারেও রয়েছে মাটির ঘর। তবে পরিমাণে সেটা খুবই কম। মুসলমানদের মাটির বাড়ি খুব একটা চোখে পড়ার মতো নয়। পরিবারিক আয় কম থাকলেও বাঁশের বেড়া, টিন অথবা ইট দিয়ে তৈরী ঘরে এখানকার মানুষ বসবাস করে থাকে। যাদের সাধ্য কম তারাও অন্তত চেষ্টা করে বাড়িটি সুন্দর করে তৈরি করার।

ফুলবাড়ী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মিল্টন জানান, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এক সময় প্রায় বাড়িতেই মাটির ঘর ছিল। তখনকার সময়ে ধনী-গরিব কোনো ভেদাভেদ ছিল না। তাছাড়া মাটির ঘরে আলাদা স্বস্থি ছিল। বর্তমানে মানুষের আধুনিক জীবন যাপনের ইচ্ছা ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া মাটির বাড়ি-ঘর ভেঙে ইটের বাড়ি-ঘর তৈড়িতে ঝুঁকে পড়েছেন।


আরো সংবাদ



premium cement