২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

উত্তরে বন্যা : বাড়ছে দুর্ভোগ, ভাঙছে জনপদ-পাউবোর স্থাপনা, দুর্গতদের পাশে নেই কেউ

উত্তরে বন্যা : বাড়ছে দুর্ভোগ, ভাঙছে জনপদ-পাউবোর স্থাপনা, দুর্গতদের পাশে নেই কেউ - ছবি : নয়া দিগন্ত

গাজলডোবার সব কটি গেট খুলে দেয়া এবং পাহাড়ি ঢল ও ভারি বর্ষণে তিস্তার ১৫২ কিলোমিটার এবং ধরলা ও ব্রক্ষপুত্র এলাকার ৩৬০ কিলোমিটার এলাকার চরাঞ্চল ছাড়াও নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দি। মহা দূর্ভোগে দিন কাটছে তাদের। দূর্গতদের পাশে নেউ সরকারি-বেসরকারি তরফের কেউ। কষ্টে কাটছে জীবন তাদের। হাজার হাজার হেক্টর জমির বাদাম, ভুট্রা, পাট, আমনের চারা, উঠতি বোরোধান, শাক সবজিসহ বিভিন্ন ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। কয়েক হাজার পুকুর তলিয়ে ভেসে গেছে মাছ। কুড়িগ্রামে পাউবোর টি বাঁধে ধরেছে ভাঙ্গন। গাইবান্ধায় বাঁধের ওপর দিয়ে যাচ্ছে পানি। রোববার বেলা সাড়ে তিনটায় তিস্তায় পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সর্তকীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, রোববার বিকেলে তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং রংপুরের কাউনিয়ার তিস্তা ব্রীজ পয়েন্টে ১৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ডালিয়া ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে। অন্যদিকে ব্রক্ষ্মপুত্র নদের ফুলছড়ি পয়েন্টে ৫৫ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ২৪ সেন্টিমিটার, ধরলার কুলাঘাট পয়েন্টে ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ নয়া দিগন্তকে জানান, গজলডোবার সবকটি গেট খুলে দেয়া এবং পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানিতে উজানে উজানে ভয়াবহ রকম পানি বৃদ্ধি পায়।

পানি বৃদ্ধির কারণে রংপুর অঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র, যমুনেশ্বরী, টাঙ্গন, পুনর্ভবা, ইছামতি, কুশিয়ারা নদীর চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। এ ছাড়া তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে চলে যাওয়ায় নদী তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানের বাঁধে আঘাত করছে। ফলে বাঁধগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। কুড়িগ্রামে টি বাঁধে ভাঙ্গন ধরেছে। সেখানে মেরামত কাজ চলছে।

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত বড় কোনো স্থাপনায় ভাঙ্গন ধরেনি। মাঠে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা আছেন। কোথাও বড় ধরনের ভাঙ্গন দেখা দিলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, উপজেলা নির্বাহী অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ এবং সরেজমিনে পাওয়া তথ্যে মতে, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যায় নীলফামারীর ডোমার, ডালিয়া, জলঢাকা, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, লালমনিরহাটের সদর, আদিতমারী, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ি, ভুরুঙ্গামারী, গাইবান্ধার সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার চরাঞ্চলে পানি ঢুকেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে এরকম পরিস্থিতিতে এই ৪ জেলার চরাঞ্চলের ২১০টি গ্রামে বন্যার পানি ঢুকে ও প্রায় ২ লাখ মানুষ প্লাবিত হয়। প্রাপ্ত তথ্যে প্রকাশ, পানি বাড়ায় নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ী, টেপাখড়িবাড়ী, খালিশাচাঁপানী, ঝুনাগাছচাঁপানী, ডাউয়াবাড়ি, গোলমুন্ডা, শৌলমারী, কৈমারীসহ ১০ ইউনিয়নের তিস্তা অববাহিকার ১৫টি চর ও গ্রামের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ওই সকল এলাকায় বসবাসকারীদের নিরপদে উঁচু স্থানে সরে থাকার জন্য বলা হয়েছে।

তিস্তার চরাঞ্চলের বাদামক্ষেত ও আমন ধানের বীজতলা হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে রয়েছে। আমন ধানের বীজতলার পাশাপাশি বাদামের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যার কারণে বিভিন্ন পুকুরের মাছ বের হওয়ার ফলে মৎস্য চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

এদিকে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রংপুরের গঙ্গাচড়ার ৭টি, কাউনিয়ার ৪টি এবং পীরগাছার ২টি ইউনিয়নের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে কয়েকশ পুকুর ও মৎস খামারের মাছ। পানিবন্দি পরিবারগুলো ছোট শিশু, বৃদ্ধ ও গরু, ছাগল, হাস-মুরগী নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। আত্মীয় স্বজনদের দেয়া ও শুকনো খাবারই একমাত্র ভরসা পানিবন্দিদের। বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। টয়লেট করা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। ইতোমধ্যেই আলমবিদিতর ইউনিয়নের ব্যাংকপাড়া, সাউথপাড়া, হাজিপাড়া, কোলকোন্দ ইউনিয়নের চর চিলাপাক, লক্ষিটারী ইউনিয়নের গান্নারপাড়, মহিপুর, গজঘণ্টা ইউনিয়নের ছালাপাক, মর্নেয়ার চর মর্নেয়া, কাউনিয়ার বালাপাড়ার পাঞ্জরভাঙ্গা, নিজপাড়া, গাজিরহাট, টেপামধুপুরের তালুক ইশদা, কালিরহাট, তাম্বুলপুরের চর তাম্বুলপুর, ছাওলার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে গেছে।

এছাড়াও পানি বাড়ায় লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, সিংগিমারী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, কাকিনা, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, পলাশী, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুন্ডা, ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। চরম বিপাকে পড়েছেন বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী আর শিশুরা। চরাঞ্চলের রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা। গৃহপালিত পশু-পাখি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বন্যাকবলিত এলাকার কৃষকরা। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে শত শত পুকুরের মাছ। বন্যার কারণে উঁচু বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েকটি পরিবার। ডুবে গেছে উঠতি ফসল বাদাম, ভুট্টাসহ নানান জাতের সবজি। বন্যার সঙ্গে সদর উপজেলার চর গোকুন্ডা গ্রামে ২৫টি বাড়ি তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙন আতঙ্কে পড়েছেন বামতীরের কয়েক হাজার মানুষ।

লালমনিরহাট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলী হায়দার জানান, পানিবন্দি ৮ হাজার পরিবারের জন্য ৬৮ দশমিক ৬৬ মেট্রিকটন জিআর চাল এবং ৬ লাখ ২৬ হাজার ২০০ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ৪১ পরিবারকে জনপ্রতি ২০ কেজি করে চাল ও ঘর মেরামত বাবদ নগদ ৭ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ফুলছড়ি-গাইবান্ধা আঞ্চলিক মহাসড়কের ওপর এখন হাঁটু পানি। সৈয়দপুর ঘাট এলাকায় গত বছর পানির তোড়ে ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করে বালাসীঘাটের ওয়াপদা বাঁধের পূর্ব এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ পাঁচ গ্রামের অন্তত দুই হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বানের পানিতে তলিয়ে গেছে গাইবান্ধা-বালাসী সড়ক। ঝুঁকির মুখে ওয়াপদা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। বাঁধের বিভিন্ন অংশে ইঁদুরের গর্তসহ দেখা দিয়েছে ফাঁটল। পানির স্রোতে বিভিন্ন পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বসতবাড়িতে বন্যার পানি ওঠায় গবাদিপশু নিয়ে অনেকে বিপাকে পড়েছেন।

অন্যদিকে ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া, খাটিয়ামারী ইউনিয়নের বেশির ভাগ এলাকা ও বালাসী ঘাট এলাকার ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। যমুনা নদীবেষ্টিত সাঘাটা উপজেলার হলদিয়া, পালপাড়া, চিনিরপটল, চকপাড়া, পবনতাইড়, থৈকরপাড়া, বাশহাটা, মুন্সিরহাট, গোবিন্দি, নলছিয়াসহ বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়াও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চণ্ডিপুর, কাপাসিয়া, তারাপুর, বেলকা, হরিপুর ও শ্রীপুর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে কুড়িগ্রামে ২৫টি ইউনিয়নের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার জমির আউশ, পাট, ভুট্টা, কাউন, চিনা ও শাকসবজির ক্ষেত। বাড়ির চারপাশে লাগানো সবজি ক্ষেতও পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়াও ল্যাট্রিন ডুবে যাওয়ায় বিপদে পড়েছে নারী ও শিশুরা। পানিবন্দি উঁচু ভিটার বাসিন্দারা একটু স্থতিতে থাকলেও নিচু ভিটার বাসিন্দারা নৌকা ও চৌকির উপর আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্র ও স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে। প্লাবনের সাথে নদী ভাঙনের মুখে পড়েছে উলিপুর উপজেলার হাতিয়া, থেতরাই, বুড়াবুড়ি ও বেগমগঞ্জ, রৌমারীর কর্ত্তিমারী, চিলমারীর নয়ারহাট, কুড়িগ্রাম সদরের মোগলবাসা ও সারডোব এলাকা। গত এক সপ্তাহের ভাঙনে বিভিন্ন উপজেলা মিলিয়ে প্রায় ৩ শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে গেছে।

কুড়িগ্রামের ডিসি মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, ভাঙন কবলিতদের সরিয়ে আনতে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন। এছাড়াও ভাঙন কবলিত উপজেলাগুলোতে ৩০২ টন চাল ও ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনার কেএম তারিকুল ইসলাম বলেছেন, পানিবৃদ্ধি ও ভাঙন অধ্যুষিত এলাকার ডিসি, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া আছে। তারা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত আছে। প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সেগুলো বিতরণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের কড়া নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement