২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কুশুম্বা মসজিদ পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে

কুশুম্বা মসজিদ পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে - ছবি- সংগৃহীত

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পুরাকীর্তির অন্যতম কুশুম্বা মসজিদ। নওগাঁ জেলার মান্দায় অবস্থিত এই মসজিদটি দর্শনীয় স্থাপনা হিসেবে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। মোঘল শাসনামলে নির্মিত এ মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। বাংলাদেশের পাঁচ টাকার কাগজের নোটে এ মসজিদের ছবি মুদ্রিত আছে, যা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জিয়ার শাসনামলে চালু করা হয়।

প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলার ভ্রমণপিপাসুদের পাশাপাশি বিদেশী পর্যটকরা প্রায় সময় মসজিদটি একনজর দেখতে ছুটে আসে। বিশেষ করে বছরের দুই ঈদে প্রচুর দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে ওঠে এ মসজিদ
প্রাঙ্গণ। মসজিদকে কেন্দ্র করে ১৫-১৬ বছর ধরে এখানে গড়ে উঠেছে খাবার দোকানসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। যার মাধ্যমে স্থানীয়দের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বেড়েছে। অবশ্য বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের কারণে গত এক বছরে এখানে দর্শনার্থীর সংখ্যা কমে গেছে।

নওগাঁ শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার ও রাজশাহী সিটি থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরত্বে মান্দা উপজেলার নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের পশ্চিম পাশে কুশুম্বা গ্রামে এ মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটি স্থানীয়দের কাছে কালাপাহাড় নামেও পরিচিত।

দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি কল্প-কাহিনীর অন্ত নেই। ৩০-৩৫ বছর আগেও দাদা, দাদী ও মায়েদের মুখে গল্প শোনা যেত, জিনেরা না কি এক রাতেই এটি নির্মাণ করেছে। পাথরের লাঠির সাহায্যে জিনেরা মসজিদের সব
পাথর ও মালামাল বহন বা তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে। আর এ লাঠি মসজিদ থেকে একটু দক্ষিণ-পূর্ব দিকে জমিতে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ এক সময় বিশ্বাসও করতেরন এসব কাহিনী। তবে এর কোনো ভিত্তি নেই।

প্রবেশমুখে বসানো রয়েছে একটি ফলক। ফলকের লিপিবদ্ধ তথ্য অনুযায়ী এ মসজিদের নির্মাণকাল ৯৬৬ হিজরি মোতাবেক ১৫৫৮-১৫৬৯ খ্রিষ্টাব্দ। মোঘল সম্রাট সুলতান গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহের রাজত্বকালে সুলতান সোলায়মান নামের একজন শাসক এ মসজিদটি নির্মাণ করেন।

১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মসজিদের তিনটি গম্বুজ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে তা প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর সংস্কার করে। এরপর ২০১৭ সালে মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বর্তমানে সরকারের উপসচিব মো:
নুরুজ্জামানের সরাসরি হস্তক্ষেপ, পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টায় মসজিদটিকে নতুন করে সাজাতে ও আর্কষণীয় করে তুলতে উদ্যোগ নেয়া হয়। এ সময় মসজিদের চতুর্দিকে ও পূর্ব পাশে অবস্থিত দিঘির পাড়ে ফুলের বাগান
নির্মাণ ও আলোকসজ্জার কাজ করা হয়। এ ছাড়া দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রামাগার, নারী-পুরুষের জন্য পৃথক শৌচাগার নির্মাণ শুরু হয়। তবে এ কাজ বন্ধ হয়ে যায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বদলি হয়ে যাওয়ার পরে।

কালো পাথরে নির্মিত এ মসজিদটি প্রায় ৪৬১ বছরের আগের। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ দশমিন ৫ ফুট ও প্রস্থ প্রায় ৪৪ দশমিক ৫ ফুট। মসজিদটিতে তিনটি করে দুই সারিতে মোট ছয়টি আর্কষণীয় গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের গায়ে রয়েছে মনোরম লতাপাতার নানা নকশা।

মসজিদে প্রবেশপথের ওপর ফলকে আরবি ভাষায় একটি ফলক লেখা রয়েছে। এর পূর্ব দিকে তিনটি ও উত্তর-দক্ষিণে একটি প্রবেশপথ রয়েছে।

মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণের স্তম্ভের ওপর একটি উঁচু আসনও রয়েছে। ধারণা করা হয়, এ আসনে বসেই তৎকালীন কাজী-বিচারকরা এলাকার সবরকম বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।

মসজিদে মোট মিহরাব রয়েছে তিনটি। যার সবগুলো কালো পাথরের তৈরি। মিহরাবে আঙ্গুরগুচ্ছ ও লতা-পাতার নকশা খোদিত করা রয়েছে।

মসজিদের কেন্দ্রীয় মিহরাবটি পশ্চিম দিকের দেয়ালের থেকে আলাদা। পশ্চিম দেয়ালের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ও মাঝের প্রবেশপথ বরাবর দু’টি মিহরাব রয়েছে। যা মেঝের সমান্তরাল। উত্তর-পশ্চিম কোণের মিহরাবটি শুধু একটি উঁচু স্তম্ভে বসানো। এ ছাড়া মসজিদে নারীদের নামাজ আদায়ের পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে।

মসজিদের সামনে রয়েছে বিশাল আকৃতির দীঘি। দীঘির আয়তন প্রায় ৭৭ বিঘা। এর দৈর্ঘ্য এক হাজার ২৫০ ফুট ও প্রস্থ ৯০০ ফুট। দীঘিটি সুগভীর ও এর পানি স্বচ্ছ।

কথিত আছে, ‘দীঘির তলদেশে পারদ মিশ্রিত থাকায় পানিতে কচুরিপানা বা অন্য কোনো আগাছা জন্মাতে পারে না’।

এ দীঘিতে নামার জন্য দু’টি দৃষ্টিনন্দন সিঁড়ি রয়েছে। এ দীঘির শীতল পানিতে অজু করেন মুসুল্লিরা। আর দর্শনার্থীরা হাতমুখ ধুয়ে দূর করেন ক্লান্তি। এ ছাড়া স্থানীয় বাসিন্দারা এখানে গোসলও করে থাকেন।

মসজিদের উত্তর পাশে রয়েছে বিশাল আকৃতির একটি তেঁতুল গাছ। শতাব্দী প্রাচীণ এ তেঁতুল গাছের প্রকৃত বয়স আসলে কত, তা কারো জানা নেই। ধারণা করা হয়, এটির বয়স প্রায় পাঁচ শ’ বছর। তেঁতুল গাছটি কালের সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে। গাছটির নিচে ছায়ায় অনেকে বসে আরাম করেন।

এ দিকে মসজিদে যাওয়ার প্রায় ৫০০ ফুট আগে রাস্তার ডানপাশে বাক্স আকৃতির একটি কালো পাথর আছে। কথিত আছে, ‘জনৈক কৃষক হালচাষের সময় জমিতে এ পাথরটি খুঁজে পান। এ সময় নাঙ্গলের
ফলার আঘাতে কিছুটা ভেঙেও যায়। পাথরটি জমি থেকে তুলে এনে রাস্তার পাশে রাখা হয়। উদ্ধারকৃত পাথরের গায়ে আরবিতে লেখা রয়েছে, ‘আল মালিকু মা হুমম মোকাররমা আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ বিন সৈয়দ আশরাফ আল হোসেন।’ অর্থাৎ শাসক, পরাক্রমশালী ও সম্মানের অধিকারী সৈয়দ আশরাফ আল হোসেনের ছেলে আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ। এ থেকে বোঝা যায় পাথর খণ্ডটি মোঘল সম্রাট হোসেন শাহের স্মৃতিবিজড়িত।

এ ছাড়া কুশুম্বা মসজিদের পশ্চিম পাশে প্রায় ২০০ মিটার দূরে কালের সাক্ষী হিসেবে রয়েছে আরো একটি ছোট্ট দীঘি। এটি সোনাদীঘি নামে পরিচিত। অনেক দর্শনার্থী এ দীঘির বিষয়টি খুব কমই জানেন। ফলে তারা সোনাদীঘি না দেখেই মসজিদ ও দীঘি দেখেই ফিরে যান।

কথিত আছে, ‘সুলতান আলাউদ্দীন হোসাইন শাহের সোনা নামের এক আদরের মেয়ে ছিলেন। অকালে তার মৃত্যু হলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন সুলতান। তিনি মেয়ের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতেই সোনাদীঘি খনন করিয়েছিলেন’। বর্তমানে এটির তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি।

মান্দা কুশুম্বা মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম বলেন, ছুটির দিন প্রায় ১২-১৩ হাজার মানুষ আসতো এখানে। করোনার কারণে বর্তমানে দর্শনার্থীর আনাগোনা কমে গেছে। মসজিদের চারপাশে ও দীঘিতে নামার সিঁড়িতে টাইলস বসিয়ে ও লাইটিং করে দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। সরকারি বরাদ্দে গেস্ট হাউজের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, কমিটি থেকে মসজিদের পাশে অজুখানা, নারী-পুরুষের আলাদা শৌচাগারসহ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করার চেষ্টা করেছিলাম। তা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাজ হওয়ায় আমাদের কাজটি বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement