২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বড়াইগ্রামে স্কুলশিক্ষিকা শেফালী’র ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স ও তার স্বপ্ন

বড়াইগ্রামে স্কুলশিক্ষিকা শেফালী’র ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স ও তার স্বপ্ন - ছবি : নয়া দিগন্ত

শেফালী খাতুন (৩৪)। পেশায় স্কুলশিক্ষিকা। দেশসেবার পাশাপাশি মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন তার দু’চোখ জুড়ে। তাই তিলে তিলে জমানো নিজের পুঁজির তিন লাখ টাকা দিয়ে একটি রিকন্ডিশন অ্যাম্বুলেন্স কিনে বিনা ভাড়ায় প্রত্যন্ত এলাকার আটটি গ্রামের দরিদ্র অসহায় রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানোর সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, গত এক বছর ধরে নিজের প্রতি মাসের বেতনের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় করছেন এ্যাম্বুলেন্স চালকের ভাড়া ও জ্বালানির পেছনে।

তবে একটি মাত্র পুরাতন অ্যাম্বুলেন্সে সব রোগীকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে সেবা দিতে পারছেন না। তাই একটি ভালোমানের অ্যাম্বুলেন্সের স্বপ্ন দেখেন তিনি। কিন্তু ২০-২২ লাখ টাকা খরচ করে নিজে আরেকটি অ্যাম্বুলেন্স কেনার সাধ্য নেই তার। কোনো দানশীল ব্যাক্তি বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি সহায়তার হাত বাড়িয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স কিনে দেন, তবে ওই অ্যাম্বুলেন্সেও রোগীদের ফ্রি সেবা দিতে যাবতীয় খরচ বহন করবেন তিনি।

মানবিক স্কুলশিক্ষিকা শেফালী খাতুন উপজেলার নগর ইউনিয়নের দোগাছী গ্রামের সেনা সদস্য ময়লাল হোসেনের স্ত্রী ও মেরিগাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা।

জানা যায়, প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় প্রতিনিয়তই জরুরি রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছানো নিয়ে দুর্ভোগের নীরব স্বাক্ষী তিনি। যথাসময়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারায় রোগীর নির্মম মৃত্যুতে স্বজনদের আর্তনাদ তার হৃদয়েও তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। তাই তিনি একটি অ্যাম্বুলেন্সের কেনার সংকল্প করেন। তারপর ধীরে ধীরে ৬ বছর যাবৎ বেতনের কিছু কিছু টাকা সঞ্চয় করে অবশেষে ২০২০ সালের শুরুতে প্রায় তিন লাখ টাকায় কিনেছেন একটি রিকন্ডিশন অ্যাম্বুলেন্স।

গত এক বছরে তিনি শুধু চালকের একবেলা খাবারের বিনিময়ে বিনা ভাড়ায় এলাকাবাসীকে এ অ্যাম্বুলেন্স সেবা দিয়ে আসছেন। প্রতি মাসে চালকের বেতন ও জ্বালানি খরচ বাবদ কমপক্ষে ১৪-১৫ হাজার টাকা নিজের বেতন থেকেই মিটিয়ে চলেছেন তিনি। এছাড়া এটির মেরামতসহ যাবতীয় খরচও তিনি বহন করেন। এতে বিনা পয়সায় সেবা পাচ্ছে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা দোগাছী, মশিন্দা, দিঘলকান্দী, লক্ষীচামারী, মনপিরিত, মেরীগাছা, চুলকাটিয়া, কুজাইলসহ আশেপাশের ৮-১০ টি গ্রামের মানুষেরা।

এ পর্যন্ত ফ্রি এ্যাম্বুলেন্সে প্রায় দেড় শতাধিক রোগীকে জরুরিভাবে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়াসহ বেশ কয়েকটি লাশ বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। গত করোনা মহামারীর ৫-৬ মাস উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অনুরোধে শেফালী খাতুনের অ্যাম্বুলেন্স নিয়মিত বড়াইগ্রাম হাসপাতালে সংগৃহিত সম্ভাব্য করোনা রোগীদের নমুনা নাটোরে সিভিল সার্জন অফিসে পৌঁছে দিয়ে দেশ সেবার স্বাক্ষর রেখেছে।
বর্তমানে তিনি রোগীদের বড়াইগ্রাম হাসপাতাল ও বনপাড়াসহ জরুরি অবস্থায় নাটোর সদর হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছে দেন। তবে মাঝে মাঝেই কিছু রোগীদেরকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বা সিরাজগঞ্জের এনায়েত খাজা ইউনুস মেমোরিয়াল হাসপাতালসহ দূরের স্থানে নিতে হয়। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সটি পুরাতন হওয়ায় তিনি এসব রোগীদেরকে সেসব হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন না। তাছাড়া বেশির ভাগ সময়েই একই সাথে ২-৩ জন রোগীর কাছ থেকে কল আসে। ওই সময় একজনের বেশি রোগীকে সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। এতে দরিদ্র রোগীরা পড়েন চরম বিপাকে ।

স্কুলশিক্ষিকা শেফালী খাতুন বলেন, কোনো রোগীর স্বজন যখন কল করেন যে তার রোগীকে জরুরিভাবে রাজশাহী নেয়া দরকার বা স্থানীয় হাসপাতালে পৌঁছে দেয়ার পর চিকিৎসক যখন রাজশাহী বা সিরাজগঞ্জ রেফার্ড করেন তখন আমার পুরনো অ্যাম্বুলেন্সে তাকে পৌঁছে দিতে পারি না। আবার একাধিক রোগীর কল এলে একজনকে সেবা দিতে পারি, অন্যদের পারি না। অসুখে কাতর একজন রোগীকে না বলাটা যে কত কষ্টের তা বলে বোঝাতে পারবো না। অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা দিতে না পারার কারণে যদি কোনো রোগী মারা যায় তখন সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। তখন মানসিক যন্ত্রণায় ঘুমাতে পর্যন্ত পারি না।

তিনি বলেন, গ্রামের দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ দেখে তাদের জন্য কিছু একটা করার চিন্তা থেকেই দিনে দিনে জমানো টাকায় এ উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু একটি অ্যাম্বুলেন্সে অনেক সময় আটটি গ্রামের মানুষকে সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। আবার অনেক সময় অন্য ইউনিয়নের মানুষও কল দেয়, কিন্তু তাদের সেবা দিতে পারি না। দেশে অনেক বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের কেউ কেউ অনেক টাকা দান করেন। এমন কেউ যদি আমাকে আরেকটা অ্যাম্বুলেন্স কিনে দেন, তাহলে আমি আমার স্বল্প আয় থেকে সেটার চালকের বেতনসহ সব খরচ বহন করে অসহায় মানুষের সেবা দিতে চাই।

স্থানীয় ইউপি সদস্য জমির উদ্দিন বলেন, ‘উপজেলা সদর ও হাসপাতাল থেকে দূরের এলাকা হওয়ায় গরীব মানুষের পক্ষে চিকিৎসা ব্যায় মেটানো ও অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া মেটানো দুঃসাধ্য। এই পরিস্থিতিতে শেফালী ম্যাডামের ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সেবাটি মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, বিনা খরচে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাচ্ছে যা হতদরিদ্র মানুষের জন্য অনেক বড় পাওয়া। তবে যদি আরেকটা ভালো অ্যাম্বুলেন্স হয়, তাহলে রোগীদেরকে রাজশাহী-সিরাজগঞ্জ বা ঢাকা পর্যন্ত সেবা দেয়া যেত। তাতে যথাসময়ে চিকিৎসা সেবা পেয়ে অনেক রোগীর প্রাণ বেঁচে যেত।


আরো সংবাদ



premium cement