২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বগুড়ায় আলু বীজ সঙ্কট, সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় চাষীরা

বগুড়ায় আলু বীজ সঙ্কট, সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় চাষীরা -

বগুড়ায় আলু বীজের সঙ্কট চলছে। চাহিদার তুলনায় বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ডেভলপমেন্ট করপোরেশন (বিএডিসি) সরবরাহ করছে মাত্র পাঁচ ভাগ। তাই চড়া দামে বীজ কিনে বপন করতে হচ্ছে বলে চাষীদের অভিযোগ। ফলে আলু চাষে আগ্রহ থাকলেও বীজের অভাবে অনেক চাষী এখনো বসে সময় পাড় করছে। প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কাছে চাষীরা অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে বলে তাদের অভিযোগ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২০-২০২১ রবি মওসুমে বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এই চার জেলায় এক লাখ এক হাজার ৬২০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। এর মধ্যে বগুড়া জেলায় ৫৭ হাজার ৭০ হেক্টর, জয়পুরহাটে ৪০ হাজার পাঁচ শ' হেক্টর, পাবনায় ৯৮০ হেক্টর ও সিরাজগঞ্জে তিন হাজার ৭০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের টার্গেট রয়েছে । প্রতি হেক্টরে বীজের প্রয়োজন এক দশমিক ৪০ টন। এবার আলুর দাম বাজারে বেশি হওয়ায় লাভের আশায় চাষীরা ব্যাপকভাবে আলু চাষে ঝুঁকে পড়েছে। তাই লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে বগুড়া জেলায় কমপক্ষে তিন হাজার হেক্টরে বেশি আবাদের প্রস্তুতি নিয়েছেন চাষীরা। এভাবে অন্যান্য জেলাতেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে আলু চাষের প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু এরই মধ্যে আলু বীজ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কারণ সরকারি সংস্থা বিএডিসি মাত্র পাঁচ ভাগ বীজ সরবরাহ করে। বাকি ৯৫ ভাগ চাষীরা নিজেরা বা বেসরকারিভাবে মেটানো হয়। এবার চাষ বেশি হওয়ায় বীজ সঙ্কট আরো তীব্র হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অসাধু ব্যবসায়ী ও ডিলারদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট ইচ্ছেমতো দামে আলু বীজ বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি বস্তা বীজ আলু ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা বেশিতে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

শেরপুর উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, চলতি মওসুমে ওই উপজেলায় দুই হাজার ৬২৫ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে বীজ দরকার প্রায় দেড় টন। সে অনুযায়ী বীজের প্রয়োজন তিন হাজার ৯৪ মেট্রিক টন। কিন্তু বরাদ্দ মিলেছে মাত্র এক হাজার ৪০০ টন যা অর্ধেকের কম। আর এসব বীজ বিক্রির জন্য প্রায় ৪৫ জন ডিলার রয়েছেন। এরমধ্যে ডিএডিসির ১৮ জন, বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের আটজন ও অন্যান্য কোম্পানির ১৯ জন।

উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়নের আলু চাষি দুলাল হোসেন, শাহ আলম, ফারুক হোসেন, আব্দুস সাত্তারসহ একাধিক ভুক্তভোগী চাষী অভিযোগ করেছেন , ব্র্যাকের ৪০কেজি ওজনের বীজ আলুর বস্তা বি-গ্রেড দুই হাজার ৮০টাকা ও এ-গ্রেড ২হাজার ২০০টাকা বিক্রি করার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৪০০ থেকে দুই হাজার ৮০০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি বস্তায় ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা বেশি। এরপরও চাহিদা অনুযায়ী মিলছে না বীজ। তারা আরো জানান, গেল মওসুমে বাজারে ভালো দাম পেয়ে কৃষক এবার আলু চাষে ঝুঁকে পড়লেও বেশি দামে বীজ কেনার কারণে একর প্রতি আট থকে ১০ হাজার টাকা বেশি খরচ পড়ছে। উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে। তাই আগামীতে আলুর ন্যায্যমূল্য না পেলে কৃষক ক্ষতির মুখে পড়বেন বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।

এসব কৃষকের দাবি, বীজ কোম্পানির একটি চক্রের সঙ্গে ডিলার-ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে আগাম বুকিংয়ের নামে বীজ বাণিজ্য করছে। এমনকি বেশি দামে আলু বীজ বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। অথচ বিএডিসিসহ বেসরকারি কোম্পানির বিভিন্ন ডিলাররা বীজ বিক্রির ওপর কমিশন পান। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দফতরে তেমন কোনো মনিটরিং না থাকার সুযোগ নিয়ে মুনাফাখোর ওই চক্রটি পরিকল্পিতভাবে বাজারে আলু বীজের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করেছে। এমনকি কোম্পানির নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি টাকা নিয়ে বীজ বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ করেন তারা। তবে কৃষকদের এসব অভিযোগ ডিলাররা স্বীকার করেছেন।
ব্র্যাকের বীজ ডিলার মোঃ রফিকুল ইসলাম বীজ সঙ্কটের কথা জানিয়ে বলেন, চাহিদা অনুযায়ী এ উপজেলায় বীজের বরাদ্দ নেই। বরং বরাদ্দ আরো কমেছে। তাই এবার শেষ পর্যন্ত আলু বীজের সঙ্কট থেকে যাবে।

বীজের দাম বাড়ার পেছনে সাব-ডিলারদের দায়ি করে তিনি বলেন, প্রত্যেক বীজ ডিলার আবার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সাব ডিলার (বীজ বিক্রেতা) নিয়োগ দিয়েছেন। তারা আগাম টাকা ও বুকিং দিয়ে আলু বীজ নিচ্ছেন। মূলত তারাই কোম্পানির নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি টাকা নিচ্ছেন বলে জানান।

বিএডিসি ও ব্র্যাকের আরেক ডিলার ফিরোজ উদ্দীন মাস্টার বলেন, সবেমাত্র আলু লাগানো শুরু হয়েছে। সবাই একসঙ্গে আলু লাগানোর কারণে আলু বীজের চাহিদা বেড়ে গেছে। কিন্তু সে তুলনায় সরবরাহ কম পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া যেসব কৃষক আগাম বুকিং দিয়েছেন তারা আগে বীজ পাচ্ছেন। বিগত বছরগুলোতে তাদের লোকসান গুণতে হয়েছে। তবে এবার একটু লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছেন বলে স্বীকার করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আকতার বলেন, এখানে বীজের সংকট নেই। সময়মত সব কৃষকই বীজ পাবেন। তাই বীজের কারণে আলু চাষ ব্যাহত হবে না। ডিলাররা নির্ধারিত দামের বাইরে বীজ বিক্রি করতে পারবেন না। নইলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপ-পরিচালক বেলাল হোসেন বলেছেন, বীজের দাম বিএডিসি নির্ধারণ করে দেয় । এখানে কৃষি বিভাগের করনীয় নেই। এবছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমপক্ষে তিন হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আলু চাষ হচ্ছে। ইতোমধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ জমিতে বীজ বপন শেষ হয়েছে। বর্তমানে আলুর দাম বেশি হওয়ায় কৃষকরা আলু চাষ বেশি করছেন। তাই বীজের চাহিদা বেড়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement