১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বন্ধ স্কুল সচল দেখিয়ে সরকারি বরাদ্দ আত্মসাত

বন্ধ স্কুল সচল দেখিয়ে সরকারি বরাদ্দ আত্মসাত - ছবি : নয়া দিগন্ত

বগুড়ার ধুনটে ১০ বছর ধরে বন্ধ স্কুল চালু দেখিয়ে শিক্ষা বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের কারসাজিতে এখনো সরকারি অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। অসৎ কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে যোগসাজশে ছয়জন শিক্ষক ও কর্মচারীকে সম্প্রতি সরকারের করোনা প্রণোদনার টাকা দেয়া হয়েছে এবং অন্য স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের এই স্কুলের শিক্ষার্থী দেখিয়ে উপবৃত্তির টাকা তুলে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। সর্বশেষ বন্ধ স্কুলের অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি নবায়নের চেষ্টা চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ধুনট উপজেলার নিমগাছী ইউনিয়নের নিমগাছী গ্রামে ১৯৯৮ সালে স্থানীয় দানশীলদের উদ্যোগে নিমগাছী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ২০০১ সালে অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও এমপিওভূক্ত না হতে পেরে ২০১০ সালে স্কুলটির পাঠদানসহ সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

ওই সময় স্কুল পরিচালনায় দেলোয়ার হোসেন দুলুর নেতৃত্বে এডহক কমিটি বলবৎ ছিল এবং ২০০০ সালে নিয়োগ বৈধকরনের সময় সাতজন শিক্ষক ও কর্মচারী কর্মরত ছিলেন। এরপর ওই স্কুলঘর কতিপয় ব্যক্তি কিন্ডারগার্টেন (কেজি) হিসেবে ব্যবহার করে। ওইসব ব্যক্তি ২০১২ সালে (স্কুল বন্ধকালীন) পরিচালনা কমিটির কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে রেজুলেশন সৃষ্টি করে তৎকালীন সভাপতি দেলোয়ার হোসে দুলু ও প্রতিষ্ঠাতা দাতা সদস্য মোশারফ হোসেন স্বপনকে না জানিয়ে স্থানীয় মামুনুর রশিদকে সভাপতি করে গোপনে পরিচালনা কমিটি গঠন করে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী প্রধান শিক্ষককে শিক্ষা অফিসে পরিচালনা কমিটি গঠনের আবেদন করতে হয়। এ ছাড়া সর্বশেষ কমিটির সভাপতি ও দাতা সদস্যের সম্মতি নিয়ে কমিটি গঠন করতে হয়। কিন্তু কোনো নিয়ম না মেনে গোপনে কমিটি করে সহকারি শিক্ষক আতাউর রহমান সেই কমিটির মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহমান দায়িত্বে থাকাকালেই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হন এবং আরো কয়েকজনকে শিক্ষক কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

স্কুল বন্ধের কারণে অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতির মেয়াদ পার হয়েছে দুই বছর আগে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের জেএসসি সমাপনী পরীক্ষায় কোনো শিক্ষার্থী অংশ গ্রহণ করেনি। কিন্তু কিভাবে সরকারি অনুদান ও উপবৃত্তি উত্তোলন হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, স্কুল ঘরগুলো জরাজীর্ণ পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎ স্কুল বন্ধ থাকার কারণে সেখানে গাছপালায় ভরে গেছে। মানুষের পদচারণা না থাকায় সেখনে গবাদিপশু পালন হয়। ওই অভিযোগের বিষয়ে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও দাতা সদস্য মোশারফ হোসেন স্বপন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় উপপরিচালক বরাবর অভিযোগ দাখিল করেন। এরপর থেকে গত ২০১৮ সাল থেকে তিন বছর ধরে জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অতাউর রহমান ও ভুয়া স্কুল পরিচালনা কমিটি বরাবর চিঠি চালাচালি ও তদন্তের পর তদন্ত হলেও বিষয়টি ঝুলে রয়েছে।

প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহমান জানান, প্রতিটি তদন্তে উপস্থিত ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপন করলেও ভুয়া ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান কোনো তদন্তে উপস্থিত হননি, কোনো চিঠির জবাব দেননি এবং কাগজপত্রও দেখাননি।

এর প্রমাণ হিসেবে ধুনট উপজেলা শিক্ষা অফিসার এসএম জিন্নাহ ২০১৮ সালের ২২ মে এক চিঠিতে লিখেছেন, বিদ্যালয়ের সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে কাগজপত্র নিয়ে হাজির হতে বার বার বলা হলেও তারা আসেননি। বিভাগের অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে যোগসাজশের কারণে বিষয়টি সমাধান হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে বৈধ শিক্ষক ও দাতারা শিক্ষামন্ত্রী, সচিব ও শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

এ ব্যাপারে স্কুল পরিচালনা কমিটির তৎকালীন সভাপতি ও নিমগাছী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দুলু বলেন, আমাকে কখন কিভাবে বাদ দেয়া হলো এবং কেমন করে নতুন কমিটি করা হলো তার কিছুই জানি না। অনেক দিন ধরে স্কুল বন্ধ রয়েছে। তারপরেও উপবৃত্তির টাকা, অনুদান ও প্রণোদনার টাকা বরাদ্দ কিভাবে হয় সেটাই আমার প্রশ্ন?

স্কুলের দাতা সদস্য মোশারফ হোসেন স্বপন জানান, ননএমপিও স্কুলের মালিক পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সদস্যবৃন্দ। কিন্তু তারাসহ বৈধ প্রধান শিক্ষককে কোনো কিছু না জানিয়ে নতুন পরিচালনা কমিটি গঠন ও তাদের নিয়োগ অবৈধ। এ ব্যাপারে শিক্ষা অফিসের রাজশাহী উপপরিচালক, জেলা শিক্ষা অফিস ও উপজেলা অফিস বার বার তদন্ত করলেও বিষয়টি সমাধান না করে কালক্ষেপণ করছে।

২০১৯ সালের ৮ আগস্ট রাজশাহী বিভাগীয় উপপরিচালক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন উল্লেখ করে বলেন, পরিচালনা কমিটি গঠনে দাতা সদস্য মোশারফ হোসেন স্বপনের স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে যা আংশিক বিধি সম্মত হয়নি এবং স্কুলের পাঠদান বন্ধ রয়েছে। কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকা অবস্থায় অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি নবায়নের জন্য আবারো আবেদনের পর গত ১৭ সেপ্টেম্বর জেলা শিক্ষা অফিসার হযরত আলী সরেজমিনে তদন্ত করেন। সে সময় প্রধান শিক্ষক হাজির হলেও তার কোনো কথা শোনা হয়নি।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান বলেন, আমি ২০১২ সালে মামুনুর রশিদ সভাপতি থাকাকালে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হয়েছি। বর্তমানে স্কুলের অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি নেই, তবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে ৯০ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। তবে কেউ উপবৃত্তির টাকা উত্তোলন করে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ মিথ্যা।

ধুনট উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শফিউল আলম বলেন, সরকারি বিধি মোতাবেক সবকিছু হবে। এখানে নিয়মের বাইরে কিছু হবে না। স্কুল বন্ধকালে অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি নবায়নের চেষ্টা, ছাত্রছাত্রী না থাকলেও উপবৃত্তি ও সরকারি অনুদান উত্তোলনের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে জবাব এড়িয়ে বলেন, সবকিছু নিয়মের মধ্যে হবে।

বগুড়া জেলা শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত ) হযরত আলী বলেন, আমি ফাইল না দেখে সবকিছু বলতে পারব না। অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতির নবায়ন বিষয়ে তিনি বলেন, আমি সরেজমিনে যা পেয়েছি তাই রিপোর্ট দেব।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর রাজশাহীর উপপরিচালক ড.শরমিন ফেরদৌস চৌধুরীর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য জানা যায়নি।


আরো সংবাদ



premium cement