২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ডি জে শাকিল সম্পর্কে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য

ডি জে শাকিল সম্পর্কে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য - ছবি : নয়া দিগন্ত

সিরাজগঞ্জের তাড়াশের রিশান গ্রুপের আলোচিত চেয়ারম্যান যুবলীগ নেতা প্রতারক চক্রের হোতা রাব্বী শাকিল ওরফে ডি জে শাকিল গ্রেফতার হবার পর তার নানা অপকর্মের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। দুই সহযোগীসহ শাকিল এখন বগুড়া ডিবি’র কাছে ৫ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। তবে তিনি এ পর্যন্ত প্রতারণার অধিকাংশ তথ্যই গোপন রেখেছেন বলে জানা গেছে।

এলাকাবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শাকিল তার অপকর্ম সফল করার জন্য দেশব্যাপী গড়ে তোলেন দালাল চক্র। ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন ধরনের লোভ দেখিয়ে দালালরা নিয়ে আসতেন তার অফিসে। বড় বড় পার্টি অফিসে এলে তাদের আপ্যায়ন করা হতো রাজকীয়ভাবে। ভয়ে এত দিন চুপ থাকলেও ডি জে শাকিল ও তার সহযোগীরা গ্রেফতার হবার পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা। কিভাবে তারা প্রতারিত হয়ে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও তার দালালদের মিথ্যা মামলায় এলাকা ছাড়া হয়েছেন তা বলতে শুরু করেছেন।

এমনই এক ভুক্তভোগী পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার মাছপাড়া গ্রামের মোকসেদ আলীর ছেলে জিয়াউর রহমান অভিযোগ করে বলেন, আমাকে বেসরকারি এবি ব্যাংকে চাকরি দেয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেয় শাকিল।

তাড়াশ উপজেলার তাড়াশ গ্রামের মৃত তোজাম্মেল হকের ছেলে রুহুল আমিন বলেন, ডিসি অফিসে অফিস সহকারী পদে চাকরি দেয়ার কথা বলে তাকে ৩০ লাখ টাকা দিয়েছি। পরে চাকরির নিয়োগপত্র ভুয়া প্রমাণিত হওয়ায় ডি জে’র বিরুদ্ধে আদালতে নিয়মিত মামলা দায়ের করি।

উল্লাপাড়া উপজেলার আলিচক গ্রামের সোনা উল্লাহর ছেলে খোকন মিয়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে মুদ্রাক্ষরিক কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকুরী দেয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা নেয়। এরপর ডি জে শাকিল তাকে যোগদানপত্র দেয়। পরে জানতে পারি সেটি ভুয়া।

একই উপজেলার আংগাড়– গ্রামের আব্দুল জলিলের ছেলের নিকট থেকে স্বাস্থ্য বিভাগের ক্যাশিয়ার নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। তাকে ক্যাশিয়ার পদের নিয়োগ পত্র দেয়। চাকুরিতে যোগদান করতে গেলে সেটি ভুয়া প্রমাণিত হয়। তিনি জমি বিক্রি করে টাকার যোগান দিয়েছিলেন।

পরে শাকিলের কাছে টাকা ফেরত চাইতে গেলে তিনি তাকে বিভিন্নভাবে মামলা- হামলার হুমকি দেখাতে থাকেন। এ ছাড়াও উল্লাপাড়া উপজেলার আলিয়াপুর গ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে রিপন মিয়া বলেন, আমাকে হাসতালের ওয়ার্ড বয় পদে চাকুরী দেওয়ার কথা বলে আমার নিকট থেকে ৭ লক্ষ নেয়।
কিছুদিনের মধ্যে একটি মৌখিক (ভাইভা ) পরীক্ষার কার্ড হাতে দিয়ে আরো ২ লাখ দাবি করেন। বাধ্য হয়ে টাকা দেই। তিনি আরো বলেন ভাইভা দিতে হবে না, সরাসরি নিয়োগ হবে। তখন ঢাকায় স্বাস্থ্য অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায় এ ধরনের কোন নিয়োগ নাই। পরে টাকা ফেরত চাইতে গেলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে টাকা না দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। অনেক চেষ্টা করেও টাকা উঠানো সম্ভব হয়নি।

একই উপজেলার বেরাবাড়িয়া গ্রামের আক্কাস আলীর ছেলে গিয়াস উদ্দিনের অভিযোগ, সিরাজগন্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অফিস সহকারী পদে চাকুরী বাবদ ৭লক্ষ টাকা তাকে দেয়। কিন্ত তিনি তাকে চাকুরী দিতে পারেন নি। টাকা ফেরত চাইতে গেলে বলে চাকরি হবে, ধৈর্য ধারণ করতে হবে। একইভাবে চাকরি দেওয়ার কথা বলে নাটোর জেলার বনপাড়ার বুলবুল আহম্মেদ এর নিকট থেকে ৫ লাখ টাকা, নাটোর নিচা বাজার এলাকার সৈকতের কাজ থেকে ৯ লাখ টাকা ডিজে শাকিল হাতিয়ে নেয়। আরেক ভুক্তভোগী উল্লাপাড়া উপজেলার ধরাইল গ্রামের বিরেনদ্রনাথের ছেলে গৌতম কুমার জানান, পুলিশ হেড কোয়ার্টারে ডি, আইজির ব্যক্তিগত সহকারী পদে চাকরির প্রলোভনে আমার নিকট হতে ১০ লাখ টাকা নেন। পরে ভুয়া নিয়োগ পত্র আমাকে দিয়েছে।

স্থানীয় একাধিক লোক অভিযোগ করে বলেন, ডি.জে. শাকিল কোম্পানীর চেয়ারম্যান হলেও মূলত প্রযুক্তি বিষয়ে প্রতারণার মূল হোতা হুমায়ন কবির লিমন। তিনি প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। হুমায়ন কবির লিমন বিএ পাশ করে বর্তমানে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে মাস্টার্স করছেন। তারা আরো জানান, ডি.জে. শাকিল মূলত কম শিক্ষিত, ওই সুযোগে তাকে ব্যবহার করে প্রতারণার সিংহভাগ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তার সংগঠনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হুমায়ন কবির লিমন। তিনি তাড়াশ পৌর এলাকায় একটি আলীশান বাড়ী তৈরীর কাজ শুরু করেছেন।

একটি সূত্রে জানা যায়, ইতিপূর্বে ডিজে শাকিল দীর্ঘদিন ঢাকায় থাকতেন। ওই সুবাদে সরকার দলীয় বিভিন্ন শ্রেণীর নেতা, এমপি, মন্ত্রীর সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠার কথা শোনা যায়। ২০১২ সাল থেকে তিনি তাড়াশে নিয়মিত বসবাস করতেন। তাড়াশ উপজেলা পরিষদের গেটে ও আলেফ মোড়ে রয়েছে তার বিলাসবহুল অফিস। শাকিল ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের কারখানাও পরিচালনা করেন বলে স্থানীয় লোকজনের কাছে পরিচয় দিতেন। অংশগ্রহণ করতেন বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে।

ডিজে শাকিল আউট সোর্সিংয়ে চাকরি দেয়ার নাম করে, বিভিন্ন ব্যাংকের লোন পাইয়ে দেয়ার কথা বলে, বিভিন্ন চাকুরি বার্তা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ও বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি চাকরি দেয়ার নামে চমকপদ বিজ্ঞাপন দিয়ে খুলে বসেন প্রতারণার ফাঁদ। সর্বশান্ত হোন শত শত মানুষ। তিনি রাতারাতি বনে যান কোটি কোটি টাকা মালিক। তাড়াশে হয়ে ওঠেন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মোটা অংকের উপঢৌকন ও ডোনেশান দিয়ে পরিণত হোন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বে। আর এ ধরনের প্রতারণার কাজে বিশ্বাস অর্জন করতে তিনি বিভিন্ন এমপি ও মন্ত্রীর নাম ও ছবি ব্যবহার করতেন। ডিজে শাকিল তাড়াশ সদরের খাঁ পাড়ায় সুদৃশ্য বাড়ি, দুটি বিলাসবহল অফিস, ৮টি ট্রাক, পৌর এলাকায় কাউরাইলে একটি ফুড প্রডাকসের করখানার মালিক বলে জানা যায়। তিনি খাঁ পাড়ার বাসিন্দা ও তাড়াশ উপজেলা কৃষকলীগ সভাপতি কাজী গোলাম মোস্তফার ছেলে । ব্যক্তি জীবনে তিনি স্কুলের গন্ডিও পার হতে পারেননি।

ডি.জে.শাকিল বেশি লেনদেন করতেন পূবালী ব্যাংক তাড়াশ শাখায়। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রিশান মৎস্য খামারের নামে ১৯৩৪৯০১০২১৭০৬ হিসাব নং তিনি বেশি লেনদেন করতেন।
এ বিষয়ে তাড়াশ থানার ওসি মো: মাহবুল আলম বলেন, তাড়াশ থানায় তার বিরুদ্ধে কোন মামলা নেই।
ডিজে শাকিল বর্তমানে বগুড়া ডিবি পুলিশের হেফাজতে ৫ দিনের রিমান্ডে রয়েছে। শনিবার তৃতীয় দিন পার হয়েছে। তাকে জিঙ্গাসাবাদ করছেন ডিবির পরিদর্শক ইমরান মাহমুদ তুহিন। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, শাকিল এ পর্যন্ত ২০ জনের কাছ থেকে ৫৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার কথা স্বীকার করেছেন। এ ২০ জনের নাম দিলেও তাদের ঠিকানা ও মোবাইল ফোন নং দেয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, এ সংখ্যা ও টাকার পরিমাণ বেশি হবে। ৫ দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করা হবে।

উল্লেখ্য, গত বুধবার বগুড়া সদর থানায় প্রতারনা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এক ব্যসায়ীর দায়েরকৃত মামলায় ওই দিন বিকেলে বগুড়া ডিবির পরিদর্শক ইমরান মাহমুদ তুহিনের নেতৃত্বে একটি টিম সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলা সদরে অবস্থিত রিশান গ্রুপের অফিসে অভিযান চালিয়ে শাকিলকে দুই সহযোগি সহ গ্রেফতার করে। এরপর তার অফিস থেকে এক হাজার দুশ' এক কোটি ৭২ লাখ ১০ হাজার টাকার বিভিন্ন ব্যাংকের ভুয়া চেক বই, সামরিক বাহিনীসহ বিভিন্ন অফিসের ভুয়া নিয়োগপত্রমসহ প্রতারণায় ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করে।

 


আরো সংবাদ



premium cement