২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মাওলানা আবদুস সুবহানের জীবনী

মাওলানা আবদুস সুবহান
মাওলানা আবদুস সুবহান - ছবি : সংগৃহীত

পাবনা সদর আসনের সাবেক এমপি ও জামায়াতের সাবেক সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা আবদুস সুবহান ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। তিনি গত জানুয়ারি মাসে কাশিমপুর কারাগারে স্ট্রোক করলে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।

চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শুক্রবার বেলা ১টার সময় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তিনি ৫ ছেলে ৬ মেয়ে ও ৪৬ জন নাতী-নাতনী রেখে গেছেন। তার মৃত্যুর খবরে পাবনাসহ সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে।

মাওলানা আব্দুস সুবহানের বড় ছেলে আব্দুল হালিম লাল জানান, ২০১২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে বাড়ীতে আসার পথে বঙ্গবন্ধু টোল প্লাজার কাছে তাকে আটক করা হয়। তারপর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি জেলখানাতেই ছিলেন।

মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুস সুবহান এমনই একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে পাবনার সর্বস্তরের মানুষের কাছে পরিচিত। তিনি পাবনাবাসীর সুখে-দুঃখে, সুদিনে-দুর্দিনে সব সময় সাথে ছিলেন। পাবনার উন্নয়নে তার অবদান বলে শেষ করা যাবে না।

তিনি আরো জানান, তিনি শুধু পাবনারই নেতা নন। তিনি একজন প্রবীণ জাতীয় নেতা। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীরের দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তিনি বরাবরই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছেন।

জন্ম ও শৈশবকাল
মাওলানা আবদুস সুবহান ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাবনা জেলার সুজানগর থানাধীন তৈলকুন্ডু (বর্তমানে মোমিনপাড়া) গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম মওলভী মুন্সী নঈমউদ্দীন আহমদ একজন দ্বীনদার ও পরহেজগার আলেম ছিলেন। মাওলানা আবদুস সুবহান ১৯৬৫ সাল থেকে পাবনা শহরের গোপালপুরে (পাথরতলা) স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বর্তমানে তার পরিবার সেখানেই বসবাস করছেন।

শিক্ষাজীবন
তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় রামচন্দ্রপুর মক্তবে। পরে তিনি মানিকহাট ও মাছপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। ১৯৪১ সালে তিনি উলট মাদরাসায় ভর্তি হন এবং প্রায় সাত বছর এ মাদরাসায় পড়াশুনা করে ১৯৪৭ সালে জুনিয়র পাস করেন। তিনি শিবপুর মাদরাসা থেকে ১৯৫০ সালে আলিম পাস করেন। তিনি সিরাজগঞ্জ আলীয়া মাদরাসা থেকে ১৯৫২ সালে ফাজিল ও ১৯৫৪ সালে কামিল পাশ করেন। মাওলানা আবদুস সুবহান অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি জুনিয়র (মেট্রিকুলেশন সমমান), আলিম ও ফাজিল পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। কামিল পরীক্ষায় মাদরাসা বোর্ড থেকে হাদীস গ্রুপে প্রথম শ্রেণীতে সপ্তম স্থান অধিকার করেন।

পেশা জীবন
মাদরাসা বোর্ড থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি ১৯৫২ সালে হেড মাওলানা হিসেবে পাবনা আলীয়া মাদরাসায় যোগদান করেন। অতপর তিনি গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউট, আরিফপুর উলাট সিনিয়র মাদ্রাসায় সুপারিনটেনডেন্ট ও মাগুরার বড়রিয়া ফাজিল মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। সব শেষ তিনি আরিফপুর ফাযিল মাদরাসার অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে শিক্ষকতা জীবনের সমাপ্তি টেনে সক্রিয় রাজনীতিতে মনোনীবেশ করেন। তিনি ১৯৫২ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর সুনামের সাথে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন বলে তার পরিবার জানান।

রাজনৈতিক জীবন
মাওলানা আব্দুস সুবহান ছাত্রজীবন থেকেই সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার পাবনা জেলার সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫১ সালে তিনি জামায়াতের ইসলামীতে যোগদান করেন এবং পর্যায়ক্রমে বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দীর্ঘদিন পাবনা জেলা আমীরের দায়িত্ব পালন করেন।

পরে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৬১ সালে গয়েশপুর ইউনিয়ন পরিষদের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে তিনি গয়েশপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সে সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে তিনি পুনরায় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বিরোধী দলের সিনিয়র ডেপুটি লিডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মাওলানা আব্দুস সুবহান ২০০১-২০০৬ মেয়াদে সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত সংসদের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। সর্বশেষ তিনি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নায়েবে আমীর এবং কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা কর্মপরিষদ ও নির্বাহী পরিষদের সাবেক সদস্য ছিলেন।

তিনি ১৯৯১ সালে বিপুল ভোটে পাবনা সদর আসনের এমপি নির্বাচিত হন, তিনি প্রথম সর্বোচ্চ ভোটে জয় লাভ করেন এবং সংসদে জামায়াতে ইসলামীর উপনেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পুনরায় ২০০১ সালে চারদলীয় ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে আবার এমপি নির্বাচিত হন।

ছাত্রজীবন থেকেই মাওলানা আব্দুস সুবহান সমাজকল্যাণমূলক কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। শিক্ষা জীবন শেষে ১৯৫৬ সালে তিনি ‘আঞ্জুমানে রফিকুল মুসলেমিন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি জালালপুর জুনিয়র হাই স্কুল ও বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠ নামের প্রতিষ্ঠান দুটি স্থাপন করেন। তিনি উভয় স্কুলে প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন।

মাওলানা আব্দুস সুবহানের আরো একটি বড় অবদান হচ্ছে পাবনা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল। ১৯৬৭ সালে পাবনার জালালপুরে তিনি এ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে ওই স্কুলটি পাবনা ক্যাডেট কলেজে উন্নীত হয়েছে। তিনি পাবনা দারুল আমান ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ছিলেন। এই ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত পাবনা ইসলামিয়া মাদরাসা, ইয়াতিমখানা, ইসলামিয়া ডিগ্রী কলেজ, ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার, হেফজখানার তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

ইমাম গাজ্জালী ট্রাস্ট, ইমাম গাজ্জালী গার্লস স্কুল ও কলেজ, কিন্ডারগার্ডেন স্কুল, কমরপুর পদ্মা কলেজ, দুলাই আল-কুরআন ট্রাস্টেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি পাবনা সদর গোরস্থান কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একসময় পাবনা হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহসভাপতি ছিলেন। অসংখ্য রাস্তা ঘাট, ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ করে তিনি পাবনার মানুষের কষ্ট লাঘব করেছেন।

তার গড়া দারুল আমান ট্রাস্ট একটি বর্তমান শিক্ষা নগরী । সেখানে তার ব্যক্তিগত ৩ কোটি টাকায় বিশাল মসজিদে ত্বাকাওয়া নামে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, সেখানেই তাকে কবর দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। তার ইচ্ছা অনুযায়ী সেই মসজিদের পাশেই তাকে দাফন করা হবে।

এদিকে পাবনা জেলা জামায়াত এক শোক বাণী দিয়েছেন, জেলা জামায়াতের আমীর অধ্যাপক আবু তালেব মন্ডল ও সেক্রেটারী অধ্যক্ষ ইকবাল হুসাইন শোক বাণীতে বলেন, ‘আমরা আমাদের একজন অভিভাবককে হারালাম। তিনি শুধু পাবনার মানুষের অভিভাবক ছিলেন না, তিনি ছিলেন গোটা বাংলাদেশ তথা বিশ্ব মুসলিমের একজন অভিভাবক। আমরা তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি এবং আল্লাহ যেন তাকে শহীদি মর্যাদা দিয়ে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন।’


আরো সংবাদ



premium cement