২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নজরুলের গজল ও ইসলামী গান

-

আমাদের জাতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত বিদ্রোহী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি মুসলিম জনগোষ্ঠীর জাতীয় নবজাগরণের প্রতীক। তিনি আমাদের মুসলিম ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সাথে কুরআন ও হাদিসের আলোকে লিখেছেন সাড়া জাগানো কালজয়ী ইসলামী গান : গজল, হামদ ও নাত। তাঁর লেখা গানেই ইসলামী সঙ্গীত জগত হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ; ফুলে ফলে শোভিত ও সুরভিত।
বাংলার ইসলামী সঙ্গীতে তিনি দিয়েছেন নতুন প্রাণ নতুন সুর। তাঁর লেখা সঙ্গীত ছাড়া ইসলামী সঙ্গীত প্রায় শূন্য। তাঁর সমসাময়িককালে কবি গোলাম মোস্তফা ও অন্যান্য দু’-একজন কবি ইসলামী সঙ্গীত রচনায় নিমগ্ন থাকলেও কাজী নজরুলই ইসলামী সঙ্গীতের ভাণ্ডারকে কানায় কানায় পূর্ণ করেছেন। যা আজ ও আগামী প্রজন্মের জন্য আকাশের নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বলতায় জ্বল জ্বল করবে নিঃসন্দেহে।
বাংলা গান রচনার সংখ্যাধিক্যে রবীন্দ্রনাথকেও কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়িয়ে গেছেন, অথচ একসময় নজরুল রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন ও শুনতেন। তিনি এত পরিমাণ রবীন্দ্র সঙ্গীত মুখস্ত গাইতে পারতেন যে, তৎকালীন সময়ের গুণী শিল্পীরাও হার মানতেন। তিনি আধুনিক গান, প্রেমের গান, শ্যামা সঙ্গীত, ইসলামী গান লিখেছেন। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ তার নজরুল সাহিত্য বিচার গ্রন্থে ‘নজরুলের গান এবং তার বৈশিষ্ট্য প্রবন্ধে লিখেছেনÑ নজরুল ইসলাম নানা রকম গান লিখেছেন। আধুনিক গান, গজল গান, ইসলামী গান, কীর্তন, রামপ্রসাদী, শ্যামা সঙ্গীত ও বিভিন্ন রকম সঙ্গীত। তিনি একা অজশ্র ইসলামী গান লিখেছেন বলে এবং বাংলা ভাষায় তাঁর ইসলামী গান সবিশেষ পরিচিত বলে আমরা ইসলামী গান শুনলেই মনে করি সেটা নজরুলের। ইসলামী গান গোলাম মোস্তফা সাহেবও লিখেছিলেন এবং আরো অখ্যাত কবি কেউ কেউ। কিন্তু নজরুলের মতো সামগ্রিকভাবে জনচিত্ত গ্রাস করতে পারেননি তারা কেউ। প্রকৃতপক্ষে নজরুলের গানের ভেতরে আছে উন্নত উপমা, চিত্রকল্প, দর্শন । সেই সাথে সুরে সুরে আছে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের খেয়াল, ঠুংরি ও টপ্পার সংমিশ্রণ। নজরুলের আগে বাংলায় কেউ গজল গান লেখেননি। তিনিই প্রথমে বাংলা গানে গজল আমদানি করেছিলেন। বাংলার আনাচে-কানাচে যে গজল গান ছড়িয়ে পড়েছিল। সুরের মূর্ছনায় তা সবই নজরুলের। তাঁর গজলে আছে ইরানি কাব্যসুষমার লালিত্য ও ভারতীয় সঙ্গীতের অপূর্ব সুর। তাঁর গজল তাই সৃষ্টি রসে অতুলনীয়। তাঁর গজলে অবশ্য ইরানি মহাকবি হাফিজের প্রভাব লক্ষণীয়। সেই সাথে ওমর খৈয়ামেরও। তাঁর অসংখ্য গজল গান হৃদয়কে বিমোহিত করে। ভাষা ও সুরের কারুকার্যে হৃদয় ঝংকৃত হয়। যেমন তাঁর একটি গজল গান এরকমÑ
বাগিচায় বুলবুলি তুই
ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল।
অথবা দেখিÑ
আমারে চোখ ইশারায় / ডাক দিলে হায়
কে-গো দরদী।
এ ছাড়াÑ
আসল যখন ফুলের ফাগুন
ফুলবাগে ফুল চায় বিদায়।
অথবাÑ
বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে
ঝরা বন গোলাপের বিলাপ শোনে।
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৩০ পরবর্তী সালে গ্রামোফোন কোম্পানির সাহচর্যে আসার পর থেকে লোকগীতি সম্রাট আব্বাস উদ্দীন আহমদের তাগিদে ইসলামী গান রচনায় মনোনিবেশ করেন। গ্রামোফোন রেকর্ডের জন্য তিনি লিখলেনÑ
ক) ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে
এলো খুশির ঈদ
খ) ইসলামের ঐ সওদা নিয়ে
এলো নবীন সওদাগর।
আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে গান দুটি গ্রামোফোন কোম্পানি বের করলে শ্রোতা মণ্ডলী তা লুফে নেয়। কবি নজরুলই মুসলমান জনগোষ্ঠীর চোখের মণি হয়ে ওঠেন। এই গান এখনো আমাদের রোজার শেষে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার সাথে সাথে হৃদয়কে সুরের মদিরায় ডুবিয়ে দেয়। এই গান ছাড়া ঈদ আমাদের অসম্পূর্ণ মনে হয়। এর পর থেকে তিনি ইসলামী গান একের পর এক রচনা করতে থাকেন।
আমাদের প্রিয় আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর দুনিয়াতে তাশরিফ আনার মুহূর্তটিকে তার কল্পনার জগতের মাধুরী মিশিয়ে লিখলেন অপূর্ব একটি গানÑ
তোরা দেখে যা আমিনা / মায়ের কোলে
যেন ঊষার কোলে / রাঙা রবি দোলে।

আরেকটি গানে লিখলেনÑ
ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ
এলোরে দুনিয়ায়,
আয়রে সাগর আকাশ-বাতাস
দেখবি যদি আয়।
অন্যখানে লিখলেনÑ
বক্ষে আমার কাবার ছবি
চক্ষে মোহাম্মদ রাসূল।

তিনি আবারো লিখলেন অপূর্ব গানÑ
মোহাম্মদের নাম জপেছিলি
বুলবুলি তুই আগে
তাই কিরে তোর কণ্ঠের ও গান
এত মধুর লাগে।
ওরে গোলাপ নিরিবিলি
নবীর কদম ছুঁয়েছিলি
তাই তার কদমের খুশবু আজও
তোর আতরে জাগে।
কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামী গানের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলোÑ বাংলা শব্দ অলঙ্কারের পাশাপাশি আরবি, ফার্সি শব্দের সংযোজন, যা তাঁর গানের বাণীর ব্যঞ্জনাকে সমৃদ্ধতর করে গভীর হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী কবি, তাই তাঁর লেখা ইসলামী গানেও আমরা সেই যুক্তিপূর্ণ গানের পরিচয় পাই। তিনি যে পাক কুরআন ও সুন্নাহ তথা আল্লাহর কালাম নবীর হাদিসভিত্তিক, ইসলামের আদর্শকে তাঁর গানে মূল উপজীব্য করেছেন তা তার ইসলামী গানের বাণীর দিকে তাকালে প্রতীয়মান হয়। আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেনÑ ‘লা খওফুন আলাইমিন’ অর্থাৎ তাদের (মুমিন মুসলমান) কোনো ভয় নেই। কবি আল্লাহর ঘোষণাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। তাই তিনি হাশরের মাঠে ভয়ে ভীত না হয়ে বরং আল্লাহর সাক্ষাতে খুশি হয়ে উঠবেন। তাঁর একটি ইসলামী গানে তিনি সেই কথাই বর্ণনা করেছেন...!
যেদিন রোজ হাশরে করতে বিচার তুমি হবে কাজী
সেদিন তোমার দিদার আমি পাবো কি আল্লাজি।
সেদিন নাকি তোমার ভীষণ কাহহার রূপ দেখে
পীর পয়গম্বর কাঁদবে ভয়ে ইয়া নফ্সি ডেকে
আমি তোমায় দেখে হাজারবার দোজখ যেতে রাজি।

যে রূপে হোক বারেক যদি দেখে তোমায় কেহ
দোজখ কি আর ছুঁতে পারে পবিত্র তার দেহ
সে হোক না কেন হাজার পাপী হোক না বেনামাজি।

ইয়া আল্লাহ তোমার দয়া কত তাই দেখাবে বলে
রোজ হাশরে দেখা দেবে বিচার করার ছলে।
প্রেমিক বিনে কে বুঝিবে তোমার এ কারসাজি।

এ ছাড়াও তিনি অন্য এক গানে লিখলেনÑ
আল্লাহ আমার প্রভু
আমার নাহি নাহি ভয়,
আমার নবী মোহাম্মদ
তাহার তারিফ জগৎময়।
একদিন আমাদের এই মুসলমানরাই ছিল শৌর্যবীর্যে বিশ্বের সেরা। কিন্তু তারা অলসতায় গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। নজরুল চান মুসলমানদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার। তাই তিনি লিখতে পেরেছেন এমনই ইসলামী গানÑ
হাতে হাত দিয়ে আগে চল হাতে নাই থাক হাতিয়ার
জমায়েত হও আপনি আসিবে শক্তি জুলফিকার।
তখন আলীর শৌর্য, হোসেনের ত্যাগ
ওমরের মতো কর্মানুরাগ
খালেদের মতো সব অশান্ত ভেঙে কর একাকার।

এ রকম আর একটি গানে তিনি লিখেছেনÑ
ধর্মের পথে শহীদ যাহারা/আমরা সেই সে জাতি
সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা/বিশ্ব করেছি জ্ঞাতি।
তিনি মুসলিম জনগোষ্ঠীর আশা আকাক্সক্ষার সাথে পরিচিত ছিলেন। ফলে তিনি জ্বালতে পেরেছিলেন মুসলিম মুমূর্ষ জাতির বঞ্চিত হৃদয়ে প্রত্যয়দীপ্ত দুর্নিবার আশা আকাক্সক্ষার প্রেরণার মশাল।
তিনি মুসলমানদের জীবন গঠনের জন্য তাঁর গানে পবিত্র কুরআনের আলোকে তাকিদ দিয়েছেন এইভাবে। ‘আল্লাহর নাম লইয়া, বান্দা, রোজ ফজরে উঠিও।’ লিখলেনÑ
শোনো শোনো ইয়া ইলাহি আমার মুনাজাত
তোমারই নাম জপে যেন হৃদয় দিবস-রাত।
তাঁর ইসলামী গানে পাওয়া যায় সমাজ সচেতনতা, সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, সংগ্রাম ও শান্তির বারতা। তার ইসলামী গান শুধু হৃদয় নিঃসৃত ভক্তিমূলক গানই ছিল না, ছিল ইসলামের সব দিক পরিপূর্ণ করা। তাৎপর্যপূর্ণ রাজনীতি, ইতিহাস, সমাজনীতি প্রভৃতি। একদিন যারা তাঁকে কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন তারাই আবার তার ইসলামী গান শুনে চোখের পানি সম্বরণ করতে পারেননি। আসলে নজরুলের অসংখ্য ইসলামী গান আমাদের মনকে নাড়া দেয়, ভক্তিরসে পরিপূর্ণ করে । আল্লাহর পথে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা যোগায়।
কাজী নজরুল ইসলাম অসংখ্য হামদও রচনা করেছেন। যেমন তিনি লিখেছেনÑ ‘এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি খোদা তোমার মেহেরবাণী’ ইত্যাদি। তিনি গানের ভুবনে এক অবিস্মরণীয় নাম। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছেনÑ কাব্যে ও সাহিত্যে আমি কী দিয়েছি জানি না। আমার আবেগে এসেছিল তাই আমি সহজভাবে বলেছি। আমি যা অনুভব করেছি তাই বলেছি। ওতে আমার কৃত্রিমতা ছিল না। কিন্তু সঙ্গীতে যা দিয়েছি সে সম্বন্ধে আজ কোনো আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে, ইতিহাস লেখা হবে, তখন আমার কথা সবাই স্মরণ করবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে। সাহিত্যে দান আমার কতটুকু জানা নেই, তবে এইটুকু মনে আছে, সঙ্গীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি, তার এই উক্তির যথার্থতা মেলে। তিনি সব গানের সাথে ইসলামী গানে আমাদের যা দিয়েছেন তা অতুলনীয়, ইসলামী গানের ভাণ্ডার তিনি পূর্ণ করেছেন তাঁর শক্তিশালী কলমের ডগায়। ইসলামের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ থেকেই তিনি ইসলামী গানের প্রতি ঝুঁঁকে পড়েছিলেন। ইসলামের প্রতি তাঁর ভক্তি-ভালোবাসা, শ্রদ্ধার প্রতিফলন দেখতে পাই তিনি যখন আল্লাহর কাছে যাওয়ার ব্যাকুল আশায় মগ্ন তখন তিনি লেখেনÑ
মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই।
যেন কবর থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।
তাঁর আরজ আল্লাহ কবুল করেছিলেন বলেই তার কবর মসজিদেরই পাশে হয়েছে। আল্লাহ তাঁর বেহেশত নসিব করুন। হ


আরো সংবাদ



premium cement