১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
সমকালীন প্রসঙ্গ

মহামন্দার হতাশা, খাদের কিনারে দেশ

-

দেশের মানুষ কেমন আছেন তা বোঝার জন্য আপনি যদি মাত্র কয়েক মিনিট জাতীয় প্রেস ক্লাবের উল্টো দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গেটের কাছে দাঁড়ান বিশেষ করে সকাল ১১-১২টার দিকে, তবে মুহূর্তের মধ্যেই দেশের পুলিশ প্রশাসন-লোকজনের অভ্যাস এবং সরকারের চেইন অব কমান্ড টের পেয়ে যাবেন। তোপখানা রোডের সাথে সেগুনবাগিচার যে সংযোগ সড়ক রয়েছে, সেখান দিয়ে উল্টোপথে বাস-গাড়ি-রিকশাসহ সাধারণ পথচারী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গেটের সামনে দিয়ে হাইকোর্ট, মৎস্য ভবন, শিক্ষা ভবন ও সচিবালয়সহ প্রেস ক্লাবে যাওয়ার জন্য যে জটিল ঘূর্ণিপাক তৈরি করে তা নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনো কর্তৃপক্ষ-শৃঙ্খলা বাহিনী অথবা জনগণ আমার চোখে পড়েনি। ফলে এই পথ দিয়ে যাতায়াতকারী লোকজন নিয়তির ওপর ভরসা করে প্রকৃতির ওপর নিজেদের সঁপে দিয়ে প্রতিদিন প্রতিজনে কয়েক ঘণ্টার শ্রমঘণ্টা নষ্ট করে সরকারের মহা উন্নয়নের জিকির করতে বাধ্য হয়।

উল্লিখিত স্থান পার হয়ে আপনি জাতীয় ঈদগাহের সদর দরজার সামনে দিয়ে আমাদের হাইকোর্ট চত্বরের চারপাশটি একটু ঘুরে আসতে পারেন। চত্বরের বাইরে যে সীমান্ত দেয়াল রয়েছে সেখানে একটু পরপর মনুষ্য বিষ্ঠা বা মানুষের মলমূত্রের সমাহার আপনাকে দেশের উন্নয়ন-রুচি-অভিরুচির কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। জাত বেজাতের ভিখেরি, সাধু-সন্নাসী, ছিন্নমূল মানুষের বসবাস এবং সেসব মানুষের বর্জ্যরে সাথে ধুলোবালি-লতাপাতা-কফ-থুতু আমাদের একটি স্পর্শকাতর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বহিরাঙ্গনকে কিভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে তা অনুধাবন করে এবার হাইকোর্ট চত্বরের ভেতরে প্রবেশ করুন। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা, গাছগাছালির ঝরাপাতার পচা স্যাঁতসেঁতে গন্ধের সাথে বিচারাঙ্গনের পবিত্রতার মিল খুঁজতে খুঁজতে আপনি ধানমণ্ডির সুধা সদনের সামনে চলে যান।
সুধা সদন হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামীর বাড়ি। এই বাড়ির নিরাপত্তার জন্য পুলিশ-সেনাবাহিনী এবং সরকারের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরাট একটি দল দিন-রাত সেখানে কর্তব্যরত রয়েছেন। তারা সব কাজ করেন অর্থাৎ আহার-বিহার-বিশ্রাম থেকে শুরু করে অন্যান্য মানবিক বায়োলজিক্যাল এবং রাসায়নিক কর্মাদি। কিন্তু ভবনের চারপাশের পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে তারা এতটাই উদাসীন যে, সুধাসদন দেখে কেউ বুঝতেই পারবেন না এটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি যা রাষ্ট্রীয় তদারকিতে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। এখানে ময়লা আবর্জনা-ধুলাবালি-গাছের ঝরাপাতা এবং কুকুর বিড়ালের অভয়ারণ্যের সৌন্দর্য উপভোগ করে আপনি চলে যান প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনের সামনে।
গণভবনের সামনের দৃশ্য, পুলিশের কাঁটাতারের বেড়া, বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি প্লাস্টিক বা টিন দিয়ে বানানো ব্যারিকেডের সৌন্দর্য পুরো গণভবনের জৌলুশ দিল্লির রাজভবন, লালকেল্লা, নেপালের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনকে রীতিমতো লজ্জায় ফেলে দেবে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের উল্লিখিত স্থান ও স্থাপনার হালহকিকতের মধ্যেই আপনি জনগণের হতাশা এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অযোগ্যতা অদক্ষতা এবং যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন তাদের রুচি-অভিরুচির পরিচয় পেয়ে যাবেন।

আপনার যদি বিশ্ব মন্দার ইতিহাস জানা থাকে এবং একটি দেশে কিভাবে মহামন্দা শুরু হয় এবং সেই মহামন্দাজনিত জাতীয় হতাশার কবলে পড়ে কিভাবে একটি সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তবে আপনি চোখ বুঁজে বলতে পারবেন যে, হালআমলের ছাগলকাণ্ড, উচ্চ বংশীয় গরুর তাণ্ডব, আজিজ বেনজীর আসাদ আনার ফয়সাল সাকলায়েন পরীমণি থেকে শুরু করে তুফান সিনেমার উরাধরা মাইয়ার মধ্যে ১৮ কোটি বাংলাদেশীর হতাশা যেভাবে ফুটে উঠেছে তাতে করে পুরো দেশ যে খাদের কিনারে চলে গেছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে বর্ণনার জন্য মার্কিন জাতির সবচেয়ে বীভৎস মহামন্দার পূর্বাপর ইতিহাস এবং মহামন্দার কারণ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করেই ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যায়। মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে রাষ্ট্রের অর্থভাণ্ডারে এত পরিমাণ অর্থ জমা হয় এবং নাগরিকদের একাংশের হাতে যেভাবে কাঁড়ি কাঁড়ি বৈধ-অবৈধ টাকার পাহাড় এসে ধরা দেয় তাতে করে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা ওজন হারিয়ে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক বনে যায়। যুদ্ধরত উভয়পক্ষের সাথে ব্যবসায়-বাণিজ্য, কালোবাজারি এবং সুদের ব্যবসায় করে মার্কিন সমাজের প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য নাগরিকরা অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে যান। অন্য দিকে, রাষ্ট্র হিসেবেও আমেরিকা ছলে বলে কৌশলে যুদ্ধকালীন সময়ে সীমাহীন অর্থ-বিত্ত হাসিল করে ফেলে।
উল্লিখিত অবস্থায় আজকের বাংলাদেশের মতো তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনে বিরাট এক মাফিয়া লুটেরা ও দুর্নীতিবাজ আমলাগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। এই শ্রেণীটির সাথে তালমিলিয়ে ব্যবসায়ী, অভিজাতবর্গ, রাজনীতিবিদ এবং অন্ধকার জগতের চোরাকারবারি বা মাফিয়া ডনেরা সমান্তরাল একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। ফলে দেশের বেশির ভাগ ধন সম্পত্তি মাত্র ১ শতাংশ লোকের হাতে চলে আসে এবং বাকি ৯৯ শতাংশ লোক আজকের বাংলাদেশের হতদরিদ্রদের মতো হয়ে যায়। দুর্নীতির মহা উৎসব করার জন্য বড় বড় মেগা প্রকল্প হাতে নেয়া হয় এবং অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়। অন্য দিকে, ধনীক শ্রেণী বাংলাদেশ ছাগলকাণ্ড গরুকাণ্ড ক্যাসিনোকাণ্ডের মতো একের পর কেলেঙ্কারি ঘটাতে থাকে। সমান্তরালভাবে শেয়ার কেলেঙ্কারির শত শত দরবেশের তাণ্ডবে নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটে স্মরণকালের ভয়াবহ আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটতে থাকে।

বাংলাদেশের হলমার্ক-অ্যাননটেক্স-এসআলম-আব্দুল হাই বাচ্চু-বেনজীর-আসাদ-আজিজ-আনারের মতো শত শত ঘটনা পুরো মার্কিন মুলুকের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড-ব্যাংকিং, ব্যবসায় বাণিজ্য এবং সামাজিক স্থিতি তছনছ করে দেয়। ধনীরা ভোগবিলাসে মত্ত হতে গিয়ে নিত্যনতুন হতাশার কবলে পড়ে। আবার সেই হতাশা কাটাতে গিয়ে বিকৃত যৌনাচার, জুয়া-মাদকে আসক্ত হয়ে পরিবার ও সমাজের ভিত নষ্ট করে দেয়। দুর্নীতিবাজরা ব্যাপক হারে অর্থ পাচার শুরু করে। ফলে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক-বীমা ব্যবস্থায় ধস নামে। পুরো মার্কিন মুলুকে শুরু হয় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা এবং জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে মহা হতাশা, যা গ্রেট ডিপ্রেশন নামে পরিচিত। আমেরিকার সেই গ্রেট ডিপ্রেশন বা মহামন্দা চলে টানা ১০ বছর। অর্থাৎ ১৯২৭ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত।
আমেরিকার মহামন্দা বাদ দিয়ে এবার বাংলাদেশের মহামন্দা নিয়ে কিছু বলি। কিন্তু তার আগে মহামন্দার সময় মানবমনে, মানবের মস্তিষ্কে এবং শরীরে কী ধরনের রসায়ন ঘটে তা নিয়ে আলোচনা করা আবশ্যক। পৃথিবীতে শ্রমবিহীন অর্থ উপার্জন কিংবা চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি-লোক ঠকানোর মাধ্যমে অর্জিত ধন সম্পত্তির প্রাকৃতিক প্রতিশোধ হলো এসব ধন সম্পত্তি মানুষকে অতিশয় কৃপণ অথবা অতিশয় বেহিসাবি উৎফুল্ল দাম্ভিক বিলাসী এবং ভোগবাদী বানিয়ে ফেলে। অলসতা-লোভ-সন্দেহ-ভয়-অস্থিরতা দ্বারা অবৈধ উপায়ে অর্থবিত্তের মালিক বনে যাওয়া লোকজন প্রতি মুহূর্তে তাড়িত হতে থাকে। তারা সুখ খুঁজতে গিয়ে নিজেদের জন্য একের পর এক জাহান্নাম তৈরি করতে থাকে এবং সেই জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হয়ে শান্তির খোঁজে হতাশার সাগরে ডুব দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে।
একটি দেশকাল সমাজে উল্লিখিত পরিস্থিতি কেবল তখনই সৃষ্টি হয় যখন অসৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধোঁকাবাজি এবং লুটপাটের রাজনীতি শুরু করে। রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে মাফিয়াতন্ত্রের বুনিয়াদ তৈরি করে। বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে অনাচার এবং অবিচারের নিত্যনতুন রেকর্ড তৈরি করে। জনগণের হক মেরে দিয়ে পোষ্য মাফিয়াদের অবাধে লুটপাটের লাইসেন্স প্রদান করে এবং রাষ্ট্রক্ষমতাকে জনগণের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। এতসব অপকর্মের ফলে সাধারণ মানুষের মনে বিষক্রিয়া তৈরি হয়। জনগণের উদ্ভাবনী ক্ষমতা হ্রাস পায়। কাজ করার শারীরিক ও মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। বেশির ভাগ লোক রোগাক্রান্ত, অলস অথর্ব এবং বিষণœতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে সমাজের স্বাভাবিক কোলাহল থেমে যায়। জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। জাতীয় অর্থনীতিতে ধস নামে এবং দেশ খাদের কিনারে পৌঁছে গিয়ে একটি মহামন্দার কবলে পড়ে যায়, যার ইংরেজি নাম গ্রেট ডিপ্রেশন।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement