১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ছাগল-চামড়ায় নয়ছয় তামাশা

-


একটি ছাগল, যা এবার কোরবানির ঈদে পশু কেনাবেচাকে নিয়ে গেছে অন্য এক উচ্চতায়। ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কিনে আলোচনায় উঠে এসেছিলেন মুশফিকুর রহমান ইফাত নামে ১৯ বছরের এক তরুণ। কোরবানি শেষ হলেও ওই ছাগলকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক থামছে না। সামাজিক মাধ্যমে ঘুরছে ছাগল, ইফাত ও একজন রাজস্ব কর্মকর্তাকে নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা। তাতে ভোল পাল্টে ফেলেন ইফাত। দাবি করেন, তিনি কোনো ছাগলই কেনেননি। তাকে ছাগলের মডেল বানিয়েছে সাদিক অ্যাগ্রো নামের একটি খামার। তবে গণমাধ্যমে ইফাতের বক্তব্যের পুরো দ্বিমত পোষণ করেন খামারের কর্ণধার ইমরান হোসেন। তাহলে কার কথা ঠিক?
গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ইফাত রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাদিক অ্যাগ্রো থেকে একটি ছাগল ছাড়াও ঢাকার অন্তত সাতটি খামার ও একটি হাট থেকে এ বছর ৭০ লাখ টাকার গরু কিনেছেন। গত বছরও কিনেছেন ৬০ লাখ টাকার পশু।
এনবিআরের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিল ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মিষ্টভাষী ড. মো: মতিউর রহমান। হাসিতে যেন মুক্তা ঝরে। ন্যায়নীতির কথার মহা ওস্তাদ। তারই ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাতের ১৫ লাখ টাকায় কোরবানির ছাগল কেনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে আলোচনার ঝড়ের মধ্যে তিনিও দিলেন নতুন কথার জোগান। জানালেন, ইফাত তার ছেলে নয়, এমনকি তার আত্মীয়-স্বজনও নয়।

ছাগলামির ওপর ছাগলামি যাকে বলে
ইফাতের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই বলে ড. মো: মতিউর রহমান দাবি করলেও গণমাধ্যম প্রমাণ করেছে, তিনিই ইফাতের বাবা। মতিউর দুই বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রীর নাম লাইলা কানিজ। যিনি বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। মতিউর প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে থাকেন বসুন্ধরায়। দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আক্তারের সন্তানই এই মুশফিকুর রহমান ইফাত। থাকেন ধানমন্ডির বাসায়। আর তার মা থাকেন কাকরাইলের একটি ফ্ল্যাটে। ইফাতের আরেক বোন ফারজানা রহমান ইস্পিতা থাকেন কানাডায়। এদিকে ফেনী-২ আসনের সংসদ-সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীও গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ইফাত আমার মামাতো বোন শাম্মী আক্তারের সন্তান। তাদের বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার সোনাপুর গ্রামে। আর মতিউর রহমানই তার বাবা। ইফাত মতিউর রহমানের দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে। ধারণা করছি, রাগ করে মতিউর রহমান ইফাতের সাথে সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন। মতিউর রহমান নিয়মিত দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানেও অংশ নেন।
সহকর্মী ড. মো: মতিউরের ছেলের ১৫ লাখ টাকার ছাগল-বিষয়ক প্রশ্নের চেয়ে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ কনসেপ্টে অ্যাটেনশন দিতে আগ্রহী এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো: রহমাতুল মুনিম।

ঈদের পর এক সেমিনার শেষে এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো: রহমাতুল মুনিমকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এটি কোনো প্রশ্ন নয়। এ নিয়ে কোনো প্রশ্নের জবাব দেবো না।’ টিসিবি ভবনে বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের কনফারেন্স রুমে সেমিনারটা ছিল ‘বাংলাদেশের বাণিজ্যনীতি : বিবর্তন, বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা’ বিষয়ে। এর আয়োজক বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন-বিটিটিসি। সেমিনারে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, এনবিআর কয়েক বছর ধরে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ কনসেপ্ট লালন করছে। এটি দু’ভাবে হতে পারে। একটি, আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদার কিছুই বাইরে থেকে আমদানি করব না। পুরোটাই যেন আমাদের দেশে উৎপাদন হয়, সেদিকে আমাদের দৃষ্টি। যখনই আমরা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে ফেলব, তখন অটোমেটিক রফতানি হবে। তাই আমরা প্রথমে মার্কেট থেকে সব বিদেশী পণ্য বিদায় করতে চাই। অর্থনৈতিক এ প্রক্রিয়ার মধ্যে রফতানির জায়গা তৈরি হয়ে যাবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, কাস্টমস থেকে রাজস্ব আয় হোক, সেটি আমরা আশা করতে পারি না। কারণ কাস্টমসের রাজস্ব আয় ধীরে ধীরে কমবে। তিনি কিঞ্চিৎ আলোচনা করেন চামড়া নিয়ে। বলেন, লেদারে আমরা (এনবিআর) অনেক দিন ধরে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছি। তার পরও লেদার যেভাবে এক্সপোর্ট মার্কেট দখল করার কথা, সেভাবে পারছে না। এখানে মূল সমস্যা কমপ্লায়েন্স ইস্যু। এমন জ্ঞানগর্ভ কথামালা ও ধারাবাহিক নানা ইস্যুতে ছাগলকাণ্ড থেমে যাবে নিশ্চিত। সামনে চলে আসবে নতুন ইস্যু।

মাত্র ক’দিন আগেই তো দুর্নীতির জাতীয় কৃতিত্বের তিলকে সিক্ত হলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের সাবেক কমিশনার ওয়াহিদা রহমানও! একক সিদ্ধান্তে চারটি মোবাইল অপারেটরের ১৫২ কোটি টাকার সুদ মওকুফের কুকর্মটি করেছেন তিনি। ফাঁস হয়েছে একটু দেরিতে। তার বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। এই মানের ক্ষমতার অপব্যবহার অসংখ্য। দু-একটি ফাঁস বা গণমাধ্যমে আসে মাঝে মধ্যে ঘটনাচক্রে। ওয়াহিদা নিজেকে রাষ্ট্রের চেয়েও বড় মনে করে কাজটি করেছেন। হালে ব্যাপক আলোচিত সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর বা সেনাপ্রধান আজিজসহ অন্যান্য আহমেদের মতোই। আরেক সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার কিছু ক্রিয়াকর্মের খবরও এখন বেশ চাউর।
এই মিয়া সাহেবদের চলনে-বলনে ও সততার প্রশংসার প্রচার ছিল অন্তহীন। সময়ের ব্যবধানে এখন দৃশ্যপটে কিছুটা ভিন্নতা। বেনজীরে-আজিজ, আছাদে-বেনজীর, মতিউরে-ওয়াহিদার মতো ঘটনায় ছাগলকাণ্ডও থেমে যাবে। বুঝমানেরা তা ভালো করেই জানেন। আর জানেন বলেই ‘এটা কোনো প্রশ্ন না’ বলে তাচ্ছিল্যভরা মন্তব্য এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিমের। তার মতো আরো অনেকেরই নিশ্চিত এ আলোচনা ও মাতাতাতিও থেমে যাবে। সামনে চলে আসবে নতুন কোনো বিষয়।

ইফাতের ছাগল কেনার ইস্যু বাসি হয়ে যাবে দিন কয়েকেই। এ ধরনের দুলালদের ১৫ লাখ টাকায় ছাগল, ৭০ লাখ টাকায় গরু কেনা আসলে বিষয় নয়। তাদের বা তাদের বাবাদের বিভিন্ন জায়গায় দু’চারটি বিয়ে করে রাখা, বিশাল বিষয়-আশয়, রিসোর্ট, বাগানবাড়ি গড়া- এগুলো মামুলি ব্যাপার। একসময়ের আলোচিত অনেক কথাই মানুষ ভুলে গেছে। কেউ কেউ এগুলোকে যৎকর্ম তৎফলও ভাবে।
এ বিবেচনায় এনবিআর চেয়ারম্যানের এসব ছাগলকাণ্ড ভাবনায় না নেয়া যথার্থই বলা যায়। তিনি চামড়া নিয়ে তার ভাবনার কথা জানিয়েছেন। তার সহকর্মী ও তার পুত্রের ছাগলকাণ্ড ভাইরাল হওয়ায় এবার চামড়ার নিউজ আসলেই তলায় পড়ে গেছে। অথচ বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। অতীতের মতো চামড়া নিয়ে নয়ছয় চলেছে এবারও। সরকারের বেঁধে দেয়া দরে কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়নি। আড়তদার সিন্ডিকেটের কারণে কোরবানিদাতারা সরকারের বেঁধে দেয়া দামের অর্ধেকও পাননি। বাধ্য হয়ে অনেকে স্থানীয় মাদরাসা ও এতিমখানায় চামড়া দিয়ে রক্ষা ঝামেলা এড়িয়েছেন। আড়তদার ও ট্যানারি ব্যবসায়ীদের হিসাব মতে, এবার পশু কোরবানি হয়েছে এক কোটির বেশি। ঈদের দিন কাঁচা চামড়া আসার হারও সন্তোষজনক। এবার লবণের দাম কিছুটা কমলেও শ্রমিকের মজুরি ও গাড়িভাড়া বেড়েছে। সব মিলিয়ে নির্ধারিত দরের চেয়ে কিছুটা কমে কাঁচা চামড়া কিনতে হয়। কিন্তু, বাকি বিশৃঙ্খলাটা বাধালো কারা? ব্যবসায়ীদের সোজাসাপ্টা যুক্তি, সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম বাড়িয়েছে, সে কারণে অনেক হিসাব-নিকাশ করে তাদের কাঁচা চামড়া কিনতে হয়। শ্রমিকের খরচ, দোকান ভাড়া, পরিবহনসহ সব ধরনের খরচ বেড়ে যাওয়ার অজুহাতও তাদের আছে।

এবার ঈদের বেশ আগেভাগেই গত ৩ জুন চামড়া খাতের একাধিক বাণিজ্য সংগঠনের নেতাদের সাথে বৈঠক করে কোরবানি পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫-৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা। ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫০-৫৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪৫-৪৮ টাকা। সাধারণত বড় গরুর চামড়া ৩১-৪০ বর্গফুট, মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ২১-৩০ এবং ছোট আকারের গরুর চামড়া ১৬-২০ বর্গফুটের হয়। নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ঢাকায় মাঝারি আকারের গরুর ২৫ বর্গফুটের একটি লবণযুক্ত চামড়ার দাম হওয়ার কথা এক হাজার ৩৭৫ থেকে দেড় হাজার টাকা। এই হিসাব থেকে লবণ, মজুরি ও অন্যান্য খরচ বাবদ গড়ে ৩০০ টাকা বাদ দিলে ওই চামড়ার আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় এক হাজার ৭৫ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু, বাজারের বাস্তবতা ভিন্ন করে দিয়েছে সিন্ডিকেট। ছাগলের চামড়ায় তা হয়েছে আরো বেশি। ছাগলের চামড়া নিয়ে আড়তে গিয়ে বেয়াকুব বনে যেতে হয়েছে। ১০ টাকা দরে চামড়া দিয়ে আসতে হয়েছে। তাও রক্ষা। এটি সরকারের ঘোষণা করা দরের তুলনায় অনেক কম। এবার ট্যানারিতে প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা দরে খাসির চামড়া বিক্রির ঘোষণা আসে, গত বছর যা ছিল ছিল ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা। একটি ছাগলে ছয় বর্গফুট চামড়া হলে লবণ দেয়ার পর দাম পাওয়া যাবে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পোষায় না বলে এই চামড়া কেনেন না তারা। তারা জানান, ছাগলের চামড়ার কোনো আড়ত পোস্তায় নেই। আগে ট্যানারি ছিল হাজারিবাগ, তা এখন সাভারে চলে গেছে। নানান কথা ও বাহানায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবসাটা আসলে পুরোনো চক্রেরই কব্জায়। হাজারিবাগ থেকে সাভার স্থানান্তর হওয়ায় নতুন কিছু হাত যোগ হয়েছে মাত্র।

নানান কথার জালে জড়িয়ে তারা সব হজম করে ফেলে। ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন-বিটিএ থেকে জানানো হয়েছে, এবার সারা দেশে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৮০ লাখ পিস চামড়া। আর সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে হয়েছে চার লাখ ৭৫ হাজার পিস। অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে চামড়া প্রক্রিয়া করায় তিন দিনে কয়েক লাখ পিস চামড়া নষ্ট হয়েছে। বেশি নষ্ট হয়েছে ছাগল ও খাসির চামড়া। এ ছাড়া ছাগলের চামড়া সংরক্ষণে খরচ বেশি পড়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর ও করোনা মহামারীসহ বৈশ্বিক নানা সঙ্কটে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের চামড়া খাতে। মূলত আন্তর্জাতিক লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ-এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় দেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতি হচ্ছে না। আর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার-সিইটিপি পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় আন্তর্জাতিক সনদ অর্জনও সম্ভব হচ্ছে না। সামগ্রিক বাস্তবতায় কোরবানির পশুর চামড়া ক্রমেই দাতব্য প্রতিষ্ঠান, মাদরাসা কিংবা এতিমখানায় দানের আইটেম হয়ে গেছে। এই চামড়ার টাকা দিয়ে এতিম শিশুদের ভরণ পোষণও চলে। চামড়া সঠিক দামে বিক্রি করতে না পারলে দুশ্চিন্তায় পড়ে দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোও। দাতব্যরাই দুর্গতিতে পড়ে গেলে বাদবাকিরাও দিনকে দিন আর ধর্তব্যে থাকে না। সেখানে ছাগলই প্রাসঙ্গিক। গোশত বা চামড়া যেন ফেলনা আইটেম।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement