দুর্নীতিবাজদের ওপর খোদায়ি গজব
- গোলাম মাওলা রনি
- ৩১ মে ২০২৪, ০০:০৫
নিয়তি নিয়ে কমবেশি সব ধর্মমতের মানুষের বিশ্বাস প্রায় একই রকম। তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে, ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন- ইত্যাদি কথাবার্তা সারা দুনিয়ার সব প্রান্তের মানুষের মধ্যে আদিকালেও যেমন গুরুত্ব বহন করত তদ্রƒপ বর্তমানকালেও মানুষ এসব বিশ্বাস করে। আপনি যতই বিজ্ঞানমনস্ক হন না কেন অথবা আধুনিক টিকটকার, ইউটিউবার বা ফেসবুকার সেলিব্রিটি হিসেবে যতই ভাবসাব দেখান না কেন বিপদে পড়লে নিজের অজান্তে নিজের মুখ দিয়ে কিভাবে যে আল্লাহ খোদা ঈশ্বর ভগবানের নাম বের হয়ে যাবে তা টেরও পাবেন না।
পাক ভারতের পাঁচ হাজার বছরের পুরনো রামায়ণ মহাভারতে পাপী তাপী দুর্নীতিবাজ চোর ডাকাতের পরিণতি সম্পর্কে যেভাবে সতর্ক করা হয়েছে ঠিক একইভাবে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, আসিরীয় সভ্যতা কিংবা গ্রিক সভ্যতার শিল্প-সাহিত্যে চোর-ডাকাতের নির্মম পরিণতি নিয়ে পিলে চমকানো সব গল্প কবিতার অস্তিত্ব রয়েছে। হিন্দুদের ভগবত গীতা, খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের নিউ টেস্টামেন্ট, ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে শুরু করে পারসিক অগ্নি উপাসক, ভারতীয় শিখ-মারাঠী ধর্মগ্রন্থসহ সারা দুনিয়ার হাজার হাজার ধর্মমতে দুর্নীতিবাজের ওপর খোদায়ি গজব সম্পর্কে যা বলা হয়েছে সেগুলোর সারাংশ প্রায় একই রকম।
বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ এবং মুসলিমদের আল কুরআনে দুর্নীতি এবং দুর্নীতিবাজদের সম্পর্কে এত বিস্তারিত বলা হয়েছে, তা যদি কেউ সামান্যতম অনুসরণ করত তবে দুর্নীতি করার চেয়ে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করাকে অনেকে নিরাপদ মনে করত।
বাংলাদেশের চলমান ঘটনা এবং কিছু প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজের হালহকিকত এবং আজকের শিরোনাম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে নিয়তি-খোদায়ি গজব এবং দুর্নীতি নিয়ে মহামতি হিরোডোটাস বর্ণিত কয়েকটি কাহিনী বলে নিই। প্রথম ঘটনাটি সম্রাট সাইরাস এবং সম্রাট ক্রেসাসের। সাইরাস ছিলেন বর্তমান ইরান এবং মধ্যপ্রাচ্যের সম্রাট। আর ক্রেসাস ছিলেন বর্তমান তুরস্ক এবং মধ্য এশিয়াসহ ইউরোপের বিশাল অংশের সম্রাট। ক্রেসাসের রাজ্যের নাম ছিল লিডিয়া আর সাইরাসের রাজ্যের নাম মিডিয়া। উভয় সাম্রাজ্যের ছিল বিশাল সেনাবাহিনী, অঢেল স্বর্ণে পরিপূর্ণ রাজকীয় কোষাগার এবং বহু বছরের বংশীয় আভিজাত্য।
লিডিয়া ও মিডিয়ার মধ্যে যে ঐতিহাসিক যুদ্ধ হয়েছিল তাতে ক্রেসাস পরাজিত হন। বিজয়ী সম্রাট সাইরাস পরাজিত সম্রাট ক্রেসাসকে শাস্তি না দিয়ে উল্টো তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। যুদ্ধ শেষে সাইরাস যখন নিজ দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন জানা গেল, লিডিয়ার কিছু অঞ্চলের সেনাপতিরা নতুন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাইরাস তার প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। কিন্তু বহু দিন যুদ্ধ করেও বিদ্রোহী বাহিনীকে পরাস্ত করতে পারলেন না। এ অবস্থায় তিনি বিদ্রোহের কারণ এবং বিদ্রোহ দমনের উপায় সম্পর্কে তার সদ্য নিয়োজিত প্রধানমন্ত্রী এবং লিডিয়ার সাবেক সম্রাট ক্রেসাসের পরামর্শ চাইলেন।
বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে ক্রেসাস যা বললেন তা সর্বকালের ইতিহাসে অমর ও অক্ষয় হয়ে থাকবে। ক্রেসাসের মতে, বিদ্রোহীরা অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ সেনা। তাদের রক্তে দেশপ্রেম এমনভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, যেকোনো লোভ প্রলোভন তাদেরকে বিজয়ী রাজার অধীনস্থ করতে পারবে না। তাদের শরীরে রক্ত থাকা পর্যন্ত তারা লিডিয়ার জন্য যুদ্ধ করে যাবে। লিডিয়ার রাজা আত্মসমর্পণ করেছে এবং আপনার প্রধানমন্ত্রীরূপে নিয়োগ লাভ করেছে এটি তাদের দেশপ্রেমে নতুন উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে।
ক্রেসাসের উত্তর শুনে সাইরাস পাল্টা প্রশ্ন না করে সবিনয়ে বললেন, জনাব, বিদ্রোহীরা আপনার সেনাবাহিনীর অংশ ছিল এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় আপনি আমার চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। সুতরাং কিভাবে সেনা বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব তা নিয়ে আমাকে কিছু পরামর্শ দিন। উত্তরে ক্রেসাস বললেন, গতানুগতিক যুদ্ধে বিদ্রোহী সেনাদের পতন ঘটানো সম্ভব নয়। কারণ তারা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছে। সুতরাং আপনি যদি যুদ্ধক্ষেত্রের বিভিন্ন এলাকায় আরামদায়ক পোশাক, মজাদার পর্যাপ্ত খাবার এবং মদ রেখে দেন তবে সৈনিকরা অচিরেই মোটা হয়ে যাবে এবং অলসতা তাদের ওপর ভর করবে। এরপর দ্বিতীয় ধাপে আপনি যদি আরামদায়ক জুতো এবং বাদ্যযন্ত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখেন তবে তাদের মধ্যে যেসব সৈনিকসুলভ গুণাবলি রয়েছে তা ধীরে ধীরে রহিত হয়ে যাবে।
ক্রেসাসের পরামর্শে সাইরাস উল্লিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং মাত্র এক বছরের মাথায় কোনোরকম যুদ্ধ ছাড়াই প্রাচীন দুনিয়ার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ একটি গেরিলা যোদ্ধা জাতিকে পরাস্ত করতে সক্ষম হন। হিরোডোটাস বর্ণিত কৌশলটির কথা চানক্য এবং মাস্টার সান ঝু তাদের লেখনীতে বর্ণনা করেছেন। ম্যাকিয়াভেলিও প্রতিপক্ষের সেনাবাহিনী ধ্বংসের জন্য যে উপায় বর্ণনা করেছেন সেখানে বিত্ত-বিলাস-মদ-নারী এবং দুর্নীতি বিস্তারের পরামর্শ দিয়েছেন। সুতরাং সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় অন্যান্য বাহিনীর মধ্যে যখন শৃঙ্খলা-অধ্যবসায়-কঠোর অনুশীলন- ইত্যাদির পরিবর্তে নৃত্য-গীত সঙ্গীত, আরাম-আয়েশ, অর্থ-বিত্ত-প্রাচুর্য এবং আহার-বিহারের সাথে অবাধ দুর্নীতির রাস্তা খুলে দেয়া হয় তখন তা সেনাবাহিনী হোক কিংবা পুলিশ অথবা অন্য বাহিনী হোক, তাদের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে।
উল্লিখিত ঐতিহাসিক শিক্ষা এবং নৈতিক শিক্ষার সাথে যদি আমরা বর্তমান বাংলাদেশের হালহকিকত লক্ষ করি তবে দেখতে পাবো যে, আমলাতন্ত্র থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সব তন্ত্রে আরাম-আয়েশ এবং দুর্নীতি এতটা সুকৌশলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে, মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে দুর্নীতি আর সুনীতি আলাদা করা যাচ্ছে না। সুকর্ম আর কুকর্ম রেললাইনের মতো সমান্তরালভাবে চলছে না; বরং সুকর্মকে কবর দিয়ে কুকর্ম এতটাই বিস্তৃতি লাভ করেছে যে, সুকর্মের সন্ধান বই-পুস্তকেও পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ যদি ইদানীংকালে সুকর্ম সম্পর্কে খুব বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন সে ক্ষেত্রে তাকে হয়তো কোনো সুসভ্য দেশ ভ্রমণ করে সুকর্ম দেখে আসতে হবে নতুবা বিশেষ ধরনের ধ্যান শিখে নিজেকে অতীতকালে নিয়ে যেতে হবে।
দুর্নীতি-অনিয়ম-জুলুম-অত্যাচার চুরি-ডাকাতি সবসময়ই ছিল। এমনকি বড় বড় চোর-ডাকাত বিভিন্ন সময়ে রাজা-বাদশাহ হয়ে সিংহাসনে পর্যন্ত বসেছে। তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও চুরি-ডাকাতিকে জনপ্রিয় করতে পারেনি। নিজেদেরকে ভদ্র সমাজের অন্তর্গত করতে পারেনি। রাজা হওয়ার পরও চোরের পাত্র-মিত্ররা রাজাকে চোর হিসেবেই মূল্যায়ন করত এবং রাজকর্মের মতো পবিত্র দায়িত্বের সাথে যেন রাজার চৌর্যবৃত্তি মিশে না যায় সে জন্য চোর রাজার উজির-নাজিররা সর্বদা সতর্ক পাহারায় থাকতেন। উদাহরণ হিসেবে আমি ফ্রান্সের এক রাজার কাহিনী জানি, যার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আধুনিক অপরাধবিজ্ঞানে একটি অধ্যায় রয়েছে। ফ্রান্সের সেই রাজা একসময় দাগি চোর ছিলেন। রাজা হওয়ার পরও চুরির অভ্যাস ছাড়তে পারেননি। তিনি মাঝে মধ্যে পাত্র-মিত্রসহ বিভিন্ন বাজার পরিদর্শনে যেতেন এবং সুযোগ পেলেই এটা ওটা চুরি করে পকেটে ভরতেন। রাজার লোকেরা বিষয়টি জানতেন। সুতরাং এক দিকে রাজা মনের আনন্দে চুরি করতেন আর অন্য দিকে রাজার লোকেরা ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিকে মূল্য পরিশোধ করে দিতেন।
ফ্রান্সের উল্লিখিত চোর রাজার সৎ রাজকর্মচারীর মতো আমলা আজকের দিনে কোথাও পাওয়া যাবে না; বরং রাজা যদি চোর হন তবে রাজকর্মচারীরা ডাকাতরূপে জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর রাজা যদি ডাকাত হন তবে তার কর্মচারীরা হয়ে যান ডাকাতদের সর্দার। ফলে আধুনিক দুনিয়ার দেশ কাল সমাজ যদি রাজকর্মে চোর-ডাকাতের কবলে পড়ে যায় তবে একমাত্র আসমানের মালিক আল্লাহর সাহায্য ছাড়া তাদের কোনো উপায় থাকে না। এমতাবস্থায় অসহায় এবং মজলুম জনতা দুই হাত তুলে দুর্নীতিবাজ এবং চোর-ডাকাত-তস্কর প্রকৃতির রাজা এবং রাজকর্মচারীর বিরুদ্ধে অবিরত অভিসম্পাত করতে থাকে। ফলে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে যখন দুর্নীতিবাজদের ওপর খোদায়ি গজব এসে পড়ে তখন আর জনগণকে ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয় না। প্রাকৃতিক নিয়মেই ওরা প্রকৃতির জালে ধরা পড়ে এবং নির্মম পরিণতি ভোগ করার আগে এই ‘উহ’ শব্দ করার সুযোগও পায় না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা