১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
দেশ জাতি রাষ্ট্র

ত্রিরত্নের কেলেঙ্কারি ও ক্ষমতাসীনদের দায়

-

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ১৭ বছরের শাসনসূত্র- সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও লুটপাট। তৃণমূল থেকে রাজধানী পর্যন্ত এই নীতি নিষ্ঠার (!) সাথে পালন করে আসছে তারা। সন্ত্রাসই যে তাদের শাসনক্ষমতার উৎস তা তারা তাদের বাহিনীগুলো দিয়ে যেমন প্রমাণ করেছে, তেমনি প্রয়োগ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। এমনকি রাষ্ট্রের স্বার্থে লালিত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে লেলিয়ে দিয়েছে বিরোধীদের দমন-পীড়নে। দুর্নীতির ক্ষেত্রে তারা বিশ্বজোড়া নাম! করেছে। টিআইবির প্রতিবেদনে এ পর্যন্ত তাদের এ পরাক্রম অব্যাহত রয়েছে। দেশের এমন কোনো সেক্টর নেই যেটি দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত নয়। পিয়ন থেকে সচিব, আরদালি থেকে বিচারক এবং ছাত্র থেকে ভাইস চ্যান্সেলর পর্যন্ত দুর্নীতিতে নাম কামিয়েছেন।
বহির্বিশ্বে শুধু দুর্নীতি শব্দটি দ্বারাই বাংলাদেশ সমধিক পরিচয় অর্জন করেছে। লুটপাটেও তাদের জুড়ি নেই। একসময় তাদের সম্পর্কে প্রবাদ ছিল- ‘ওলটপালট করে দে মা, লুটেপুটে খাই।’ পাঁচ দশক পরও তাদের এ বিষয়ে কোনো পরিবর্তন হয়নি; বরং লোকেরা মজা করে বলে- ‘আওয়ামী ভাই, করে খাই খাই, সবকিছু খেয়ে বলে কিছু খাই নাই।’ ইদানীং তারা জমি খেয়েছে, নদী-নালা, খাল-বিল খেয়েছে, ব্যাংক খেয়েছে, ব্যবসায়-বাণিজ্য খেয়েছে, বাজার খাওয়ার জন্য সিন্ডিকেট করেছে, তবুও বলে, তারা নাকি কিছুই খায় নাই। কেবল তারা সুশাসন আর স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে।

কখনো কখনো দৈব দুর্ঘটনাক্রমে তাদের এসব কেলেঙ্কারির খবর বাইরে বেরিয়েছে। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি অথবা শাহেদদের লুটপাটের খবর কখনোই মানুষ জানত না, যদি স্বার্থের সঙ্ঘাত না ঘটত। এই সময়ে প্রকাশিত ত্রিরতেœর কেলেঙ্কারি গত সপ্তাহজুড়ে ছিল ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। দেশজুড়ে যারা একটু রাজনীতির খোঁজখবর রাখেন অথবা সচেতন মানুষ তারা এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন। ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। আতঙ্কিত হয়েছেন। ২২ মে, ২০২৪ প্রথম খবরটি নাগরিক সাধারণকে আহত করে। সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আসে। তাকে নিয়ে তার সময়কাল থেকেই অনেক গুজব ও সরস আলোচনা চলছিল।
২০১৮ সালের নির্বাচন ঘিরে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা ও জাতীয় স্বার্থে একটি ভূমিকার আশা তৈরি হয়েছিল দেশ-বিদেশে। তখন তিনি দৃঢ়ভাবে ক্ষমতাসীনদের দমন-পীড়ন ও অন্যায় অত্যাচারকে সমর্থন দিয়েছেন। নির্বাচনের দিন দায়িত্ব পালনরত সেনাবাহিনী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে মানুষ নিরপেক্ষতা আশা করছিল। সেরকম ধারণাই তিনি প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু মানুষ দেখল, সেনাবাহিনী পুলিশের বি-টিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। তার পুরস্কারস্বরূপ ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে তিনি নিয়েছেন অনেক অন্যায় সুবিধা। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, আজিজ আহমেদ তার ভাইকে বাংলাদেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি এড়াতে সহযোগিতা করেছেন। আরো অভিযোগ, অন্যায্যভাবে তিনি সামরিক খাতে কন্ট্রাক্ট পাওয়া নিশ্চিত করতেও ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা এলো ঘটনার তিন বছর পর। মাইকেলকে উদ্ধৃৃত করে যে কেউ বলতেই পারেন, ‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে।’ যাই হোক, বেটার লেট দ্যান নেভার।

সাবেক সেনাপ্রধানের এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সরকারি ও বিরোধী শিবিরের মন্তব্য পাওয়া গেছে। ওবায়দুল কাদের অনেকটা পাশ কাটিয়ে বলেছেন, এটি ভিসানীতির প্রয়োগ নয়। অন্য আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে আমি আর কিছু বলব না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি জানেন না। অথচ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলেছেন, নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আগেই জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাহলে প্রশ্ন করা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি নিজ রাষ্ট্রের খবর রাখেন না। তবে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তার নিষেধাজ্ঞা দুর্নীতির কারণে।
তিনি আরো বলেন, দুর্নীতির ব্যাপারে আমরা হাজারবার বলেছি। সারা দুনিয়া বলেছে। তারা অঙ্গীকার করেছে। এখন খবর এসেছে, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আজিজ আহমেদকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কারণ দুর্নীতি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রভাবিত করা এবং জনগণের বিশ্বাস ক্ষুণœ করা। আজিজ আহমেদকে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে ব্যবহার করার প্রসঙ্গ টেনে মির্জা ফখরুল বলেন, আপনারা ব্যবহার করেছেন রাষ্ট্রযন্ত্রকে, ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন সেনাবাহিনীকে, ব্যবহার করেছেন বিচার বিভাগকে, প্রশাসনকে। ভয়ের রাজত্ব তৈরি করেছেন।
আজিজ আহমেদের নানা কুকীর্তি প্রকাশ করে ওই সময় আল জাজিরা টেলিভিশন ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ নামে এক চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশ করে। নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর তার অপকর্মের নানা ফিরিস্তি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়, ক্ষমতার স্বার্থে ক্ষমতাসীনরা তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও করেনি; বরং নানাভাবে তোষণ ও পোষণ করেছে।
সেনাপ্রধানের ঘটনার পর এবারের ঘটনাটি সাবেক পুলিশপ্রধানের। পুলিশের পোশাকে রাজনীতির ভাষায় কথা বলে তিনি তখন আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন। বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় অনেকগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে। ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে বিরোধীদের নির্মূল করার প্রয়োজনে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় বলে বিরোধীদের অভিযোগ। তার এই ভূমিকার জন্য ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তার ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ সময় র্যাবের আরো সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ আনা হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে বলা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র যখন নিষেধাজ্ঞা দেয় তখন আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন বেনজীর আহমেদ। এসব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে তিনি ক্ষমতাসীনদের বিশ্বস্ত এজেন্ট হিসেবে পুলিশকে ব্যবহার করেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে নিষ্ঠুরতার প্রমাণ দেন। এভাবে ক্ষমতাসীনদের বিশ্বস্ততা অর্জন করে তিনি বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হন। তার ঘুষ-দুর্নীতি সীমা লঙ্ঘন করেছে বলেই আজ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এসব অভিযোগ আসছে। ইতোমধ্যে আদালত বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও মেয়ের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার আদেশ দিয়েছেন। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের এই আদেশ এসেছে। দুদকের ভাষ্যে বলা হয়, গণমাধ্যমে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের যেসব অভিযোগ এসেছে তার পরিপ্রেক্ষিতেই অনুসন্ধান শুরু হয়।
এই সেদিনও যিনি ক্ষমতাসীনদের প্রধান লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন আজ তার বিরুদ্ধে এই তদন্তে অনেকেই অবাক হয়েছেন। তবে সংবাদপত্রে এই মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, সরকারের নিঃশব্দ অনুমোদনেই এসব করা হচ্ছে। সাধারণভাবে সবাই জানেন, তার আদেশ ছাড়া বাংলাদেশে নাকি গাছের পাতাও নড়ে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, কোথাও কোনো অঘটন ঘটেছে। আগেই বলা হয়েছে, স্বার্থের সঙ্ঘাত ও ব্যক্তির স্বার্থ লঙ্ঘিত না হলে এত বড় বিশ্বস্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা নয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক মন্তব্য করেন, বেনজীর আহমেদের আয়-বহির্ভূত সম্পদের বিষয়ে সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং লোকমুখে সবসময়ই আলোচনায় ছিল। বিষয়টি প্রায়ই সবাই জানত। জেনেও সরকার তখন নেয়নি কোনো পদক্ষেপ। যতক্ষণ না স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাধা এসেছে।
এর পরের ঘটনাটি লোমহর্ষক ও বিস্ময়কর। চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে খুন হলেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সরকারদলীয় এমপি আনোয়ারুল আজিম ওরফে আনার। ধৃত আসামিদের সূত্রে হত্যাকাণ্ডে যে বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তা লোমহর্ষক ও মর্মান্তিক। পাঁচ কোটি টাকার চুক্তিতে খুনিরা কৌশলে কলকাতার এক বাড়িতে তাকে হত্যা করে। হত্যার কারণ খুঁজতে গিয়ে যা জানা যায় তা একসাথে বিস্ময়কর ও অবিশ্বাস্য। তথ্যসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, স্বর্ণ চোরাচালানের আন্তঃদেশীয় চক্রের দ্বন্দ্বের জেরে পরিকল্পিতভাবে আনারকে ভারতে নিয়ে নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয়। যারা সে দেশে এবং এ দেশে হত্যাকাণ্ডে জড়িত তারা সবাই একই ব্যবসার পার্টনার।

এমপি আনোয়ারুল আজিমের পরিবার সন্ত্রাসের জন্য ওই এলাকায় কুখ্যাত। তার ভাই শিপলু খুলনা জেলার চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসী। ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর পুলতলায় অর্থাৎ নিজ এলাকার যুবলীগের সমাবেশে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের হাতে ফুল দিয়ে যুবলীগে যোগ দেন এমপির ভাই শিপলু। তিনি ২০১৬ ও ২০২১ সালে গায়ের জোরে দুবার নৌকা প্রতীক নিয়ে নিজ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ওই সময়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকায় দুই ভাইয়ের নাম ছিল। শিপলু ভূঁইয়া যখন যুবলীগে যোগ দেন। তখন তার নামে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ ১২টির মতো মামলা ছিল।
তিনটি ঘটনাই বিব্রতকর, অপমানজনক, অন্যায় ও মর্মান্তিক। এই তিন জনই ক্ষমতার শীর্ষ বলয়ে থেকে অন্যায়, অপরাধ ও অত্যাচার করেছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই তিন জনের দ্বারা উপকৃত হলেও দায়-দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। কিন্তু আইন-কানুন ও নীতি-নৈতিকতা অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্ষমতাসীনদের দায়ী করবে। যদিও তারা প্রকাশ্যে বলছেন, অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। তিনি সাবেক আইজি হোন আর সাবেক সেনাপ্রধান হোন।
গ্রাম দেশে বলে- উপরে থুথু নিক্ষেপ করলে তা নিজের গায়েই পড়ে। আওয়ামী লীগের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে যারা এত সব অন্যায় অপকর্ম করেছে, কী করে তারা দায় এড়াতে পারে? দুই বাহিনীর সাবেক দুই প্রধানের কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে ক্ষমতার কাঠামোর সংশ্লিষ্টতা ছিল। আর খুন হওয়া সংসদ সদস্য নিজে সরকারি দলের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঢালাওভাবে অন্যায় করেছেন এবং অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছেন। পরপর তিনবার তিনি এমপি হয়েছেন। সরকার কি তার সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর নেয়নি? আসলে গোটা দলেই অন্যায় অপকর্ম এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে, একজনের অন্যায়কে আলাদা করে চিহ্নিত করার ক্ষমতা এখন তাদের নেই। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, পাপ কখনো চাপা থাকে না। এই সত্যকে অনুধাবন করে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা যদি শিক্ষা গ্রহণ করে, তা হলে জাতি উপকৃত হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement