মা দিবস-বাবা দিবসের পাঁচালী
- গোলাম মাওলা রনি
- ১৭ মে ২০২৪, ০০:০৫
বিশ্ব মা দিবসে আমি কোনো দিন মাকে শুভেচ্ছা জানাইনি। আব্বার সাথেও অমনটি কোনোকালে করিনি। অথচ তাদের সাথে আমার যে সম্পর্ক তা প্রতি মুহূর্তে আমাকে আবেগতাড়িত করে তোলে। মার সাথে আমার বয়সের পার্থক্য মাত্র ১৪ বছর আর আব্বার সাথে ১৫। আমি ষাটের দশকের আবহমান বাংলার প্রচলিত কিশোর-কিশোরী মা-বাবার প্রথম সন্তান। আমার জন্মের পর নানাবাড়ি দাদাবাড়িতে আনন্দের বন্যা ছুটল। আমার বাবা-মা লজ্জায় মুখ ঢাকলেন। যুবক দাদা-দাদী নানা-নানীও বেশ বিব্রত। নানার বাবা-মা এবং নানীর বাবা-মা বিরাট এক উৎসবের আয়োজন করলেন।
আমার দাদী আমার জন্য দুগ্ধবতী ছাগী কিনে আনলেন। তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী, সচ্ছল পরিবারের শিশু-সন্তানদের মায়ের দুধের পাশাপাশি ছাগলের দুধ পান করানো হতো। ফলে শিশুকাল থেকেই আমার পেটের পীড়া শুরু হলো। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত ছাগলের দুধ যে শিশুদের জন্য ক্ষতিকর এই বিজ্ঞান তখনো গ্রামে প্রবেশ করেনি; বরং শিশুকে দু-এক ফোঁটা ঘি-মধু খাইয়ে মুরব্বিরা ভাবতেন, শিশুটি জ্ঞানী-গুণী ও শক্তিমান হবে। আমার জমানায় ঘি-মধু আর ছাগলের দুধ খেয়ে কার কতটা উন্নতি হয়েছে তা বলতে পারব না কিন্তু আমার পেট চিরস্থায়ীভাবে দুর্বল হয়ে গেছে এবং শরীরের গঠনেও নানান ত্রুটি লক্ষ করছি। আর এসব কিছুর সাথে শৈশব থেকেই যুক্ত হয়েছে কম ঘুম, খিটখিটে মেজাজ ও খাদ্যে অরুচি।
উল্লিখিত কারণে শৈশবে আমার কিশোরী মায়ের জন্য আমি যে কতটা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণ ছিলাম তা সম্মানিত পাঠক নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন। ফলে আমার জন্মের প্রথম দুই বছর মা আর আমি হরিহর আত্মার মতো একজন অন্যজনের সাথে লেগে থাকতাম। আমার দাদীও আমাকে চরমভাবে ভালোবাসতেন। কিন্তু দুই বছরের মাথায় আমার দ্বিতীয় ভাইটি জন্ম নিলো এবং পরবর্তীতে প্রতি এক বছর বা দুই বছরের মাথায় আমিসহ মোট সাতটি ছেলেসন্তান এবং একটি কন্যাসন্তান প্রসব করে আমার মা কিভাবে বেঁচে ছিলেন এবং সন্তান হিসেবে আমি কী করেছি সে কথাই আপনাদের জানাব।
কৃষি-পশুপালন ও ব্যবসায় ছিল আমাদের পরিবারের অন্ন জোগানের মাধ্যম। যদিও আমরা যথেষ্ট সচ্ছল ছিলাম কিন্তু আজকের জমানার মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের পরিবারের মহিলাদের মতো ষাটের দশকের মহিলাদের পায়ের ওপর পা তুলে জীবন পার করার সময় ছিল না। প্রায় ১৬-১৭ জনের একান্নবর্তী পরিবার, দুই ডজন গরু-ছাগল, গোটা পঞ্চাশেক মুরগি, দু’জন রাখাল এবং দুই-চারজন পূর্ণকালীন মেহমান নিয়ে আমাদের জমজমাট সংসারে যখন দ্বিতীয় ভাইটি জন্ম নিলো তখন ভোর ৫টা থেকে গভীর রাত অবধি সংসারের হাড়খাটুনি খেটে আমার মায়ের অবস্থা বেহাল হয়ে পড়ল। ফলে তার দ্বিতীয় সন্তানকে আমি কোলে নিতাম। বড় আদর করে তাকে মিনো বলে ডাকতাম। আর তার মুখে যখন জবাব এলো, তখন মধুর স্বরে ও আমাকে মিভাই বলে ডাকতে আরম্ভ করল।
মিনোর বয়স যখন দুই তখন তৃতীয় ভাই এলো। দুধের মতো সাদা আর তুলার মতো নরম শিশুটির দায়িত্ব আমার ওপর পড়ল। তৃতীয়জনের নাম দিলাম ইলাট ফিরাপের গদি। গদি আর মিনো দু’জনেই মায়ের দুধ খাওয়ার জন্য কাঁদত। কিন্তু সেই কান্নায় মায়ের কাজ থামত না। কখনো ধান ভানা, কখনো রান্না, ঘরঝাড়–, জামা-কাপড় ধোয়া ইত্যাদি হাজারো কাজে মা থাকতেন ক্লান্ত বিধ্বস্ত। ফলে মিনো-গদির কান্না তার কর্ণকুহরে পৌঁছাত না। এ অবস্থায় আমি উচ্চস্বরে কান্না শুরু করতাম। আমার কান্না শুনে মা আসতেন। মিনো এক দুধে মুখ লাগিয়ে চোঁ চোঁ শব্দে দুধ পান করত আর গদি অন্য দুধের দখল নিত। দূরে দাঁড়িয়ে আমি ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো আনন্দে লাফালাফি করতাম।
মিনো গদির পর আমার চতুর্থ এবং পঞ্চম ভাইয়ের জন্ম হলো এবং দু’জনের বয়সের পার্থক্য ছিল মাত্র আট মাস। চতুর্থ ভাইটি জন্ম নেয়ার পর মায়ের বুকের দুধ সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেল- আর ভাইটি জন্মগতভাবে অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়ল। বার্লি-গুঁড়োদুধ, গরু-ছাগলের দুধ, সবরি কলা ইত্যাদি দিয়ে শিশুটির ক্ষুধা নিবারণ হয় বটে কিন্তু সারারাত একটুও ঘুমায় না- অনবরত কান্না করতে থাকে। আমার মা সারা দিনের ক্লান্তিতে বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়তেন- আর আমি চতুর্থ ভাইটিকে কোলে নিয়ে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকতাম যেন মায়ের ঘুমের ব্যাঘাত না হয়। এ ভাই আমিসহ বাকি চার ভাই ধীরে ধীরে বড় হতে থাকি। আমি যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়তাম তখন শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের মেজদা চরিত্র দ্বারা নিদারুণভাবে অনুপ্রাণিত হই। মায়ের ব্যস্ততা- আব্বার সীমাহীন ব্যস্ততা- ঝক্কিঝামেলার কারণে আমাদের পড়াশোনার বিষয়ে খোঁজখবর নেয়ার অবস্থা তাদের ছিল না। ফলে মেজদার আদলে স্নেহ-মায়া মমতা বুকে চেপে শাসনের চাবুক হাতে তুলে নেই।
আমি গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করতাম- আর ভাইদেরকে কঠোর অনুশাসনে রাত ১২টা পর্যন্ত জাগিয়ে দৈনন্দিন পড়াগুলো মুখস্থ করিয়ে ছাড়তাম। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই আমার ভায়েরা ভালো ছাত্ররূপে প্রসিদ্ধি পেয়ে গেল। আমি যখন ভাইদের শাসন করতাম তখন মা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতেন- আবার তারা যখন গড় গড় করে সব পড়া মুখস্থ করে ফেলত তখন সেই দৃশ্য দরজার আড়াল থেকে মা দেখতেন এবং তৃপ্তি ও গর্বের হাসি দিয়ে সবার অলক্ষ্যে চলে যেতেন।
আমি দশম শ্রেণী পর্যন্ত গ্রামে ছিলাম। ভাইদেরকে পড়ানো শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখা এবং তাদের খানা খাদ্য-পোশাক-আশাক এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কে যতœ নেয়ার পাশাপাশি মায়ের গৃহকর্মে সহযোগিতা করা ছিল আমার নিত্যকার অভ্যাস, দায়িত্ব ও কর্তব্য। বাজার করা, ধান-গম দূরের কল থেকে ভাঙিয়ে আনা, গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগির তদারক করা, দূরবর্তী এলাকা থেকে খাবার পানি মাথায় করে আনা, রান্না-বান্নায় মাকে সহযোগিতা করতে গিয়ে প্রতিদিন তার সাথে আমার যে রসায়ন ঘটত আজ বহু বছর পরও ওসব স্মৃতি আমাকে তাড়িত করে। জীবনের প্রতিটি ক্ষণে আমি ওসব স্মরণ করি আর আমার বৃদ্ধ মায়ের জন্য দোয়ার পাশাপাশি তার প্রয়োজন মেটানো এবং তার মানসিক শক্তি জোগানোর জন্য চেষ্টা করি। মায়ের সাথে ছবি তুলে ফেসবুকে দেয়ার সময় আমার হয়নি কিংবা মা দিবসে কিছু উপহার নিয়ে হঠাৎ তার সামনে গিয়ে নাটক করার প্রবৃত্তি হয়নি। কিন্তু জীবনের প্রতিটি ক্ষণে মাকে স্মরণ করা এবং সেই শৈশব থেকে মাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করার যে সৌভাগ্য আমার হয়েছে তার কিয়দংশ যদি এ যুগের সন্তানরা পেত তবে আলাদা করে মা দিবসের প্রয়োজন হতো না।
মা দিবসের পর এবার বাবা দিবস নিয়ে কিছু বলি। আমার আব্বার সাথে বছরে মাত্র দু’বার দেখা হতো। আমি যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি তখন আব্বা আমাদেরকে ফরিদপুর থেকে পটুয়াখালীর গলাচিপা নিয়ে গেলেন। আর তখন থেকে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটত সপ্তাহে এক দিন অর্থাৎ প্রতি শুক্রবার। আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি তখন কোনো এক বৈশাখ মাসের তপ্ত দুপুরে আমার মনটি আব্বার জন্য হাহাকার করে উঠল। আমি কাউকে কিছু না বলে ঘর থেকে বের হলাম এবং ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলাম। আমাদের বাড়ি থেকে কালীখোলার বাজার তারপর চৌদ্দরশির বাজার এবং বাইশরশি জমিদার বাড়ি পার হয়ে যখন ডাক্তারখানার বাজার পর্যন্ত হেঁটে প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলাম তখন সন্ধ্যা নামতে খুব অল্প সময় বাকি ছিল।
সেদিন আমি কেবল হেঁটেছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম যে আমার আব্বা আসবেন। আমাদের ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তাটি তখন মেঠোপথ ছিল। কোনো যানবাহন চলত না। ভারী মালামাল বহনের জন্য দিনের বেলায় ঘোড়ার গাড়ি চলত। অসুস্থ লোকদেরকে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থান পর্যন্ত নেয়া হতো। ফলে সদরপুর থানা সদর থেকে পুকুরিয়া বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ সবাইকে হেঁটে পাড়ি দিতে হতো। তবে বর্ষাকাল এলে লোকজন নৌকা ব্যবহার করতে পারত। এ অবস্থায় আব্বা তার বরিশালের কর্মস্থল থেকে বাসে করে পুকুরিয়া বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আসতেন। তারপর হেঁটে বাড়িতে আসতেন।
ঘটনার দিন প্রকৃতি এক অপরূপ খেলা খেলেছিল আমার সাথে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই আমার আতঙ্ক শুরু হলো- কিভাবে ফিরব। রাস্তার দু’পাশে ঘন জঙ্গল। শিয়াল-বাগডাশা-সাপ, বন্য শুয়োর, সজারু ইত্যাদি প্রাণী সন্ধ্যার পর অবাধে চলাফেরা করে এবং কাউকে একা পেলে বেঘোরে আক্রমণ চালায়। ওসব প্রাণী ছাড়াও শয়তান-ভূত-পেতœী, জিন, ইত্যাদির ভয়ও ছিল প্রবল। আমি যখন অস্তমিত সূর্যের বিভা আকাশে মিলিয়ে যাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে আতঙ্কের সাগরে ডুবতে বসছিলাম, ঠিক তখন লক্ষ করলাম দূর থেকে কেউ একজন আসছেন। প্রবল আশা দিয়ে আরেকটু এগোতেই দেখি, আমার আব্বা। আমি আকাশের চাঁদ পেলাম আর আমার আব্বা পেলেন সাত রাজার ধন মানিক। আমার যুবক বাবা আমাকে কোলে তুলে নিলেন এবং বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পাগলের মতো চুম্বন করতে থাকলেন।
উল্লিখিত ঘটনার মাধ্যমে আমার সাথে আমার আব্বার একটি আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। আমি সেই শৈশব থেকেই আব্বার পছন্দ-অপছন্দ, চাহিদা কামনা-বাসনা টের পেতাম। তাকে খুশি করার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছি। তিনি অসুস্থ হয়ে প্রায় ১৫ বছর শয্যাশায়ী ছিলেন। ওই সময়ের মধ্যে বছরের পর বছর হাসপাতালে থেকেছেন। কখনো মাসের পর মাস বাসায় থেকেছেন। বায়ু পরিবর্তনের জন্য মাঝে মধ্যে পটুয়াখালী কিংবা ফরিদপুর ছিলেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে ছিলেন জাতীয় সংসদের ন্যাম ভবনে। আব্বার সাথে আমার হাজারো স্মৃতির মধ্য ছোট্ট একটি ঘটনা বলে আজকের নিবন্ধ শেষ করব। কিন্তু তার আগে আব্বা এবং আমার রসায়নের কিছু কাহিনী বলে নিই।
আব্বা আমার জীবনের সেরা নায়ক- সেরা দার্শনিক। সেই শৈশব থেকে আজ অবধি আমার মনে সর্বদাই তিনি হাজির আছেন। আমার কানে তার কণ্ঠস্বর সর্বদা সুর তোলে, তার চেহারা চোখে ভাসে। তার উপদেশ আমাকে পরিচালিত করে। ঘুম আহার বিহার উপাসনায় আমি সর্বদা আব্বার সাথে বিরাজ করি। আমি জীবনে একটিবারের জন্য ভাবতে পারিনি যে, জীবনের কোনো ক্ষেত্রে আব্বাকে আমি অতিক্রম করতে পেরেছি। আমার সারা জীবনের অভিলাষ- মা-বাবার একমাত্র অভিলাষকে পূর্ণতা দেয়া। আর সেই অভিলাষ হলো- প্রত্যেক মা-বাবাই চান গর্বিত জনক-জননীর মর্যাদা পেতে। অর্থাৎ সন্তানের সুনাম সুখ্যাতি-সফলতা এবং সুস্থতা ছাড়া পৃথিবীর কোনো মা-বাবার ভিন্নতর চাওয়া পাওয়া থাকে না। মা-বাবার ইচ্ছাকে কতটুকু পূর্ণ করতে পেরেছি সেটি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ভালো জানেন। তবে আব্বার অসুস্থকালীন একটি ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে আজকের নিবন্ধের ইতি টানব। আব্বা ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি। আমি সকাল-বিকেল দেখতে যাই। তার সার্বক্ষণিক সেবার জন্য মা ছাড়াও আমার কাকা ও এক খালু নিয়োজিত ছিলেন। আব্বা বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়ে থাকতেন। একদিন ঘুমন্ত অবস্থায় আমি তার হাতখানি ধরলাম। তিনি হঠাৎ চোখ মেললেন। ক্ষণিকের তরে তার ঘুমেভরা পূর্ণিমার চাঁদের আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। অসুস্থ কণ্ঠে বিড়বিড় করে বললেন, আমার হাজার তারার এক চাঁদ! আমার ছেলে! এইটুকু বলে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। আমার নয়ন অশ্রুসিক্ত হলো। আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে আমি হাসপাতাল ত্যাগ করলাম।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা