১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস

জীবনে পরিবারের ভূমিকা সীমাহীন

-

আজ ১৫ মে বুধবার আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস। যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখার মানসিকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসঙ্ঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৯৬ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিনটি পরিবার সম্পর্কিত সমস্যাগুলো সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং পরিবারের ওপর প্রভাব সৃষ্টিকারী সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং জনসংখ্যার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানাবোঝার সুযোগ এনে দেয়। পরিবার আত্মিক সম্পর্কের সূতিকাগার। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্নেহ মমতা, ভালোবাসা সৌহার্দ্য ও পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধন গড়ে তোলে পরিবারই।
পরিবার মানেই হচ্ছে মা, বাবা, ভাই, বোন, দাদা, দাদী বাইকে নিয়ে একসাথে বসবাস। আমাদের সমাজব্যবস্থায় পরিবারের এই ধারণা প্রচলিত অতীত থেকেই। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে, আমরা যেন ততই এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসছি। সুপ্রাচীনকাল থেকে যে যৌথ পরিবারের চিত্র বাংলাজুড়ে ছিল এখন তা অনেকটাই ম্লান। শহুরে জীবনে অনেক আগেই বিলীন হয়েছে যৌথ পরিবারের চিত্র। আগে গ্রামে কিছু যৌথ পরিবার দেখা গেলেও এখন তাও নেই।
আমরা পরিবারকে ক্রমেই ‘স্বামী-স্ত্রী-সন্তানে’ই সীমাবদ্ধ করে ফেলছি। সেখানে মা-বাবা কিংবা দাদা-দাদীর কোনো স্থান নেই। মা-বাবাকে হয়তো গ্রামের বাড়িতে কাটাতে হচ্ছে নিঃসঙ্গ-অসহায় জীবন। আবার অনেক মা-বাবার ঠিকানা হচ্ছে ‘বৃদ্ধাশ্রম’। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের সমাজে প্রচলিত যৌথ পরিবারে পারস্পরিক সম্প্রীতি গভীর হয়, অটুট থাকে। অসুখ বিসুখসহ নানা সমস্যায় একে অন্যের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এতে অনেক বড় সমস্যাও সমাধান হয়ে যায় অতি সহজে। সময়ের তাগিদে যৌথ পরিবার কিংবা পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার বিষয়টি যখন এই সমাজে ক্রমান্বয়ে গুরুত্বহীন হয়ে উঠছে, ঠিক সেই মুহূর্তে আজকের এই আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস পালনের গুরুত্ব অপরিসীম।

পরিবারের ভূমিকা
মানবজীবনে প্রত্যেক মানুষের জন্য এই পারিবারিক শিক্ষা অতি গুরুত্বপূর্ণ। আর এগুলো আয়ত্ত করতে পরিবারই সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। নানাবিধ চারিত্রিক গুণাবলি, যেমন ভদ্রতা, নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা, কৃতজ্ঞতাবোধ, বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শন, কনিষ্ঠদের স্নেহ-আদর করা, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা, পরোপকারিতার মানসিকতা গড়ে তোলা, উদার মানসিকতাবোধ জাগ্রত করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যতটা না, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্জন করা যায় পরিবার থেকে।
আধুনিক সামাজিক ব্যবস্থার প্রসার, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং সংখ্যানুপাতিক হারে জীবিকার তারতম্য ঘটতে থাকায় যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানী নজরুল ইসলাম। তিনি মনে করেন, জীবনের তাগিদেই আগের মতো ভাই-ভাই একসাথে বসবাস করেন না। এমনকি এই ঢাকা শহরে একই বিল্ডিংয়ে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকলেও কথা বা সামাজিক রীতির আদান প্রদান হয় খুবই কম। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার কুফল হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশে যা উদ্বেগজনক।
আমাদের দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে দ্রুত। বাড়ছে পরিবারের সংখ্যা। বাংলাদেশে মোট খানার সংখ্যা এখন (এক হাঁড়ির রান্না খেয়ে যারা একসাথে থাকেন) চার কোটি ১০ লাখ ১০ হাজার ৫১টি। প্রতিটি খানায় গড়ে চারজন বাস করেন। বর্তমানে দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে এক হাজার ১১৯ জন বাস করে। ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯৭৬ জন।

পরিবারের কার্যাবলি
পরিবারের সদস্যদের সুন্দর ও নিরাপদ জীবন গড়ে তোলার জন্য পরিবার বহুবিধ কাজ করে। এর মধ্যে সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন করা অন্যতম। শিক্ষামূলক কাজ, যেমন বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগেই বর্ণমালা শেখানো। তা ছাড়া মা-বাবা-ভাই-বোন ও পরিবারের অন্য সদস্যদের পারস্পরিক সহায়তায় সততা, শিষ্টাচার, উদারতা, নিয়মানুবর্তিতা প্রভৃতি মানবিক গুণাবলি শিক্ষার প্রথম সুযোগ পরিবারেই সৃষ্টি হয়। পরিবারে শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বলে পরিবারকে শাশ্বত বিদ্যালয় বা জীবনের প্রথম পাঠশালা বলা হয়।

অর্থনৈতিক কাজ : পরিবারের সদস্যদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি চাহিদা পূরণের দায়িত্ব পরিবারের। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্নভাবে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে এসব চাহিদা মিটিয়ে থাকে। পরিবারকে কেন্দ্র্র করে সম্পাদিত হয় নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
তবে একটি আদর্শ পরিবারের অন্যতম কার্যাবলি হলো পরিবারের সবাই মিলেমিশে একত্রে বাস করা। পরিবারের সবাই একটি নির্দিষ্ট শৃঙ্খলার মধ্যে বাস করে। তারা বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখে এবং শান্তিতে বসবাস করে। পরিবারের কারো বিপদে অন্য সদস্যরা তাকে মানসিকভাবে সাহায্য করে। ফলে সে তার বিপদ দ্রুত কাটিয়ে ওঠে। ক্ষমাশীলতার শিক্ষাও আসে পরিবার থেকে।

একে অপরকে সময় দেয়া : এই আধুনিক যুগে সবাই এখন যন্ত্র হয়ে গেছে। কিন্তু একটি আদর্শ পরিবারে পরিবারের সব সদস্য একে অন্যকে যথেষ্ট পরিমাণ সময় দেয়।
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য আছে, আছে নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি। এসব কিছুকেই আমাদের ধারণ করে সামনে এগোতে হবে। তাই রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন কিছু সংবিধান আছে তেমনি পারিবারিক সংবিধানও থাকা দরকার। যেমন পরিবারের সবার সাথে সদ্ভাব গড়ে তোলা, সাংসারিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, মিথ্যে না বলা, গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা, নির্দিষ্ট সময়ে ঘরে ফেরা, নিজের কাজ নিজে সম্পন্ন করা, মিথ্যাকে ঘৃণা করা এবং মানবিক মূল্যবোধগুলোর চর্চার মাধ্যমে অন্তরকে বিকশিত করা। আমাদের বুঝতে হবে, অন্যের কাছ থেকে ধার করা কোনো কিছুতেই গৌরব নেই। বরং তা আমাদের জন্য অপমান। সর্বোপরি, পারিবারিক বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে বলেই আমাদের সামাজিক নানা সমস্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে অস্থিরতা। ধর্মীয় বিধানেও রক্তের সম্পর্ক অক্ষুণœ রাখার ওপর তাগিদ দেয়া হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার সমাজের ভিত্তিমূল। তাই আন্তর্জাতিক পরিবার দিবসে বিশ্বের প্রতিটি পরিবারের বন্ধন দৃঢ় হোক এবং পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য অক্ষুণœ থাকুক। প্রতিটি পরিবারে বিরাজ করুক অনাবিল সুখ ও শান্তি।
লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement