জগৎ যেন ‘ধুলায় অন্ধকার’
- খন্দকার হাসনাত করিম
- ০৬ মে ২০২৪, ০০:০৫
দৈনিক আজাদ পত্রিকার বর্ষীয়ান সাংবাদিক মুজিবর রহমান খাঁ সাহেবের মুখ থেকে একটা কথা তখনকার বুদ্ধিজীবী মহলে বেশ চাউর হয়ে গিয়েছিল। কথাটা ছিল ‘ধুলায় অন্ধকার’। অস্পষ্টতা এবং কোনো কিছুর মধ্যে অচেনা রহস্য বা হেঁয়ালি দেখলেই মুজিবর রহমান খাঁ সাহেব বলে উঠতেন, ‘ধুলায় অন্ধকার’। আজকের পৃথিবীর দিকে তাকালে সেই কথাটিই বারবার মনে পড়ছে। পৃথিবীর চেনা পরিচিত স্বার্থ-দ্বন্দ্ব, বিরোধ-বিভেদের সীমানা ছাড়িয়ে পৃথিবীব্যাপী যেন ‘ধুলায় অন্ধকারের’ মতো অনির্ণয়যোগ্য এক নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে। ইহুদিবাদী হায়েনা রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতি ইঙ্গ-মার্কিন সমর্থন আগেও ছিল। তবে এখন তাদের পালে বাতাস দিচ্ছে মুসলিম বিশ্বেরই কয়েকটি দেশ। খ্রিষ্টান রাষ্ট্র দক্ষিণ আফ্রিকা যখন ইসরাইলি বর্বরতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা ঠুকছে, ইসরাইল থেকে তাদের দূতাবাস গুটিয়ে আনছে এবং তাদের দেশ থেকে ইসরাইলি দূতকে ফেরত পাঠাচ্ছে, তখন ইসরাইলের ওপর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহত করছে জর্দান এবং ইরানের বিরোধিতা করছে মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন প্রভৃতি মুসলিম রাষ্ট্র! দক্ষিণ আফ্রিকা যখন তেল আবিব থেকে তার দূতাবাস গুটিয়ে এনেছে, মিসর-জর্দান বা নতুন করে মিত্র হওয়া সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের সাথে তাদের কূটনৈতিক অভিসার চালিয়ে যাচ্ছে। সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাসে বোমারু বিমানযোগে হামলার ইহুদি আগ্রাসন চালাতে নির্লজ্জের মতো নিজেদের আকাশসীমা ব্যবহার করতে দিয়েছে জর্দান। আবার ইরান যখন গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা এবং তাদের ছয়জন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে ইরানের মাটি থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, যেগুলোকে আকাশেই ধ্বংস করতে আমেরিকা ও ব্রিটিশ রণকৗশলে সাথী হয়েছে জর্দান। শ্বশুরদের স্বার্থরক্ষায় এক অপার কৃতজ্ঞতা জর্দানের বাদশাহ হোসেনের! বেশ কয়েক বছর আগে মেয়ের বয়সী এক মার্কিন তরুণীকে বিয়ে করেন জর্দানের বাদশাহ হোসেন। অথচ আরব-বিরোধী ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ এর যুদ্ধে এ জর্দান ও মিসরেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছিল ইসরাইল। এ ইসরাইলের সাথে গোপন আঁতাত করেই মিসরের রক্তপিপাসু সামরিক নেতৃত্ব পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতাসীন আল মুরসির ‘ব্রাদারহুড’ সরকারকে নির্বাচনের অল্প কিছুদিনের মাথায় ক্ষমতাচ্যুত করেছিল এবং ক্ষমতায় বসিয়েছিল ইসরাইল ও আমেরিকার পদলেহি সিসিকে।
পৃথিবী আসলেই ধুলায় অন্ধকার! আরব রাজতন্ত্রগুলো ও ইউরোপের তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশের শাসকরা যখন ইসরাইলের আরব গণহত্যায় ইন্ধন জোগাচ্ছে, তখন খোদ ইউরোপের বড় বড় শহরগুলোর সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ছাত্ররা গাজায় গণহত্যা ও হানাদারির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছে। বিশ্বের বড় বড় গণশোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরাইলি সন্ত্রাসের প্রতিবাদ ধ্বনি উঠছে লন্ডন, প্যারিস, মেলবোর্ন এবং টোকিওতে। খোদ মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অচল হয়ে পড়েছে গাজার সমর্থনে এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক এবং অভিভাবক, সাধারণ মানুষের প্রতিবাদে। তারা হলো ত্যাগ করে ক্যাম্পাসের খোলা আকাশের নিচে তাঁবু খাটিয়ে দিনরাত পার করে দিচ্ছে বাইডেন প্রশাসনের নগ্ন ইহুদি-প্রীতির প্রতিবাদে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ইহুদিবাদের সমর্থকরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে হামলা করছে, বোমা ছুড়ছে। সেখানে মার্কিন পুলিশ নীরব। অথচ এ পর্যন্ত হাজারখানেক প্রতিবাদকারী ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়েছে। টিভির খবরে দেখা গেছে প্রতিবাদী মার্কিন তরুণ-তরুণীরা আরবদের ঐতিহ্যবাহী চাদর পরে গণসংহতি প্রকাশ করছে। প্যালেস্টাইনি নির্যাতিত জনগণের সাথে এ দৃশ্য কি লজ্জা দিচ্ছে না জর্দানি, সৌদি, কুয়েতি-কাতারি বা মিসরীয় শাসকগোষ্ঠীকে? এ যেন সেই ‘আরর বসন্তই’ ফিরে এসেছে মার্কিন নতুন প্রজন্মের মানবতাবাদী তারুণ্যের মাঝে। এ মার্কিন যুবকরাই একদিন ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন নারকীয়তার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়েছিল। অচল করে দিয়েছিল গোটা যুক্তরাষ্টকে। আজ ঠিক তেমনই মানবিকতার তাগিদে তারা ক্লাস ছেড়ে ক্যাম্পাসের মাঠে, রাজপথে জড়ো হয়েছে প্রতিবাদের অন্তহীন মিছিলে। প্রবীণ মার্কিনিরা ভয় পাচ্ছে তরুণরা অ্যান্টি-সেমিটিজম বা ইহুদি বর্ণবাদ বিরোধিতাকে উসকে দিচ্ছে। কিন্তু সত্য এই যে, যে মানুষটির দেহে মনে বিবেক বিবেচনা সামান্যটুকু আছে, সে গাজার এ ইহুদিবাদী পৈশাচিকতার প্রতিবাদ না করে পারবে না। এমনকি ইসরাইলের ভিতরে ও বাইরে ইহুদি ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর কেউ কেউ বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার পরম মিত্র বাইডেন প্রশাসনের একচোখা আরববিদ্বেষী কার্যক্রমের প্রতিবাদে রাজপথে নামতে বাধ্য হয়েছে। প্রতিবাদ জানিয়েছে কানাডা, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, জার্মানির জনগণও। শতাব্দীর নৃশংসতম এ গণহত্যায় শুধু পাষাণ হৃদয় গলছে না আরব দেশগুলোর মার্কিন মিত্রদের। আর রাজতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রে জনগণের মতামতের কী-ই বা মূল্য আছে? পৃথিবীর কোন প্রান্তের কোন একজন সাধারণ মানুষ ইহুদিবাদী এ পৈশাচিক গণহত্যার প্রতিবাদ না করে পারছে না। এমনকি অতি উগ্রপন্থী ইহুদি গোষ্ঠীগুলোর কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইল-বিরোধী প্রতিবাদকারী ছাত্রছাত্রীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে, টিভি সংবাদে এ দৃশ্যও দেখা গেছে। কোনো দিকের কোন কথায় কর্ণপাত করছে না দুর্নীতিবাজ নরঘাতক ‘গাজার জল্লাদ’ নামে খ্যাত নেতানিয়াহু ও তার রক্তপিপাসু সামরিক নেতারা। করছে না, কারণ বিশ্বের পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো তাদের ‘পাওয়ার হাউজ’।
একটা ঘণ্টার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতি তাদের অন্ধ সমর্থন প্রত্যাহার করেই দেখুক না, পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ইসরাইল নামের রাষ্ট্রটাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আরবরা ফিরে পাবে তাদের পবিত্র পিতৃভূমি ফিলিস্তিন। একশ বছরের রক্তগঙ্গা থামবে। পৃথিবীর দেহ থেকে ক্যান্সারটি অপসারিত হবে। রক্ত¯্রােত ছাড়াই আবার প্রবাহিত হবে জর্দান নদীর নীল পানি। ইসরাইলের সাথে এখনো নির্লজ্জভাবে সম্পর্ক রাখা আরব শাসকদের জন্য অত্যন্ত শরমের খবর এই যে, গাজায় গণহত্যা ও ধ্বংসকাণ্ডের প্রতিবাদে আমেরিকার ছাত্রছাত্রীরা হল বা বাসা ত্যাগ করে ক্যাম্পাসের মাঠে প্রতিবাদ তাঁবুতে অবস্থান করে ইসরাইলের হানাদারি এবং আমেরিকার অন্ধ ইসরাইলি নীতির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে। আমেরিকা যদি গণতান্ত্রিক দেশই হবে তবে প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের ইউনিভার্সিটি থেকে নাম খারিজ করছে কেন? তাদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালাচ্ছে গোয়েন্দা এবং ফেডারেল পুলিশ! কলাম্বিয়া, ইউসিএলএ প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ছাত্রনেতা মিলোকেশ সাফিকের মতে, এ পর্যন্ত প্রায় ১০০০ ছাত্রকে জেলে পোরা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের সাথে এখন যোগ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাও। ভিয়েতনাম-বিরোধী মার্কিন ছাত্রবিক্ষোভের পর এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম।
মার্কিন প্রশাসনের অন্যায় নীতির প্রতিবাদে সে দেশের ছাত্র বিক্ষোভের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। ১৯১৭ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পিছনে ব্রিটিশ ‘বেলফোর ঘোষণা’র সাথে সাথে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল সেদিনের মার্কিন ছাত্রছাত্রীরা। এটা ১৯১৭ সালের কথা। মার্কিনি হয়েও তারা গঠন করেছিল ইহুদিবাদবিরোধী ফিলিস্তিনি সংহতি সংস্থা। পরে যে সংগঠনটির নামকরণ করা হয় প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল লিগ এবং তারও পর সংগঠনটি আবার ন্যাশনাল লিগ নামে পুনঃআত্মপ্রকাশ করে। গত শতাব্দীতে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকারের প্রতি সংহতি ও সমর্থনের সপক্ষে আরবের বাইরে যে কয়টি আন্দোলন গড়ে ওঠে তার অধিকাংশই আমেরিকা এবং ইউরোপে- তথাকথিত ‘মুসলিম বিশ্বে’ নয়। যে প্রতিবাদী মার্কিন-আরব বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাঈদের বিরুদ্ধে আরব-শাসকদের এতো বিরাগ এবং ঘৃণা সেই ব্যক্তিই মার্কিন ক্যাম্পাসে গঠন করেছিলেন অর্গানাইজেশন অব অ্যারাব স্টুডেন্টস এবং অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যারাব-আমেরিকান ইউনিভার্সিটি গ্র্যাজুয়েটস। ক্যাম্প কেভিড উদ্যোগ কিংবা ফিলিস্তিনবিষয়ক ‘অসলো-চুক্তির’ পর এসব সংগঠনের কার্যক্রমে ভাটা পড়লেও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মার্কিন ছাত্রছাত্রীরা আবার মাঠে নেমেছে ইসরাইলি নারকীয়তার বিরুদ্ধে এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও তাকে স্বীকৃতি প্রদানের দাবিতে।
সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্য আর একটি বিস্ময়কর পরিহাস এই যে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য আজ হাতিয়ার নিয়ে গর্জে উঠেছে ইরান, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা এবং অবশ্যই, ফিলিস্তিনি হামাস স্বাধীনতাকামীরা। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক, সিরিয়া এবং কাতার। কী লজ্জার কথা যে, লেবাননের হিজবুল্লাহ ঘাঁটি থেকে গত অক্টোবর ও তৎপরবর্তী সময়ে যে, ৬৬ বার ইসরাইলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষিপ্ত হয় সেগুলো ইসরাইলের মাটি স্পর্শ করার আগেই অর্থাৎ আকাশে থাকা অবস্থাতেই ধ্বংস করে জর্দান কিংবা বাহরাইনে অবস্থিত মার্কিন বিমান প্রতিরক্ষা ডিভিশন আর মার্কিন পঞ্চম নৌবহরের ঘাঁটি এখন বাহরাইনে!
ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরবরা যতটা না ঐক্যবদ্ধ তার চেয়ে অনেক প্রবল হলো আরব দেশগুলোর নিজেদের মধ্যকার কলহ-বিবাদ-সঙ্ঘাত। তুরস্ক ব্যস্ত কুর্র্দি অন্তর্ঘাত মোকাবেলায়; জর্দান ইসরাইলের চেয়েও তাদের স্বার্থের প্রতি বেশি ক্ষতিকারক বলে বিশ্বাস করে সিরিয়াকে; মরক্কো ব্যস্ত স্প্যানিশ সাহারা সঙ্কট নিয়ে; সৌদি আরব ইসরাইলের চেয়েও তাদের শত্রু মনে করে ইরানকে; মিসর মার্কিন ও ইসরাইলি মদদ পেয়ে আত্মহারা; জর্দান তো মার্কিন অঙ্গরাজ্যের মতোই আচরণ করছে; পিএলও নেতাদেরকে খুন করেছে মিসর। আর গাজা আজ এক কারাগার। যে অঞ্চলে মুনাফেক ও নির্বীর্য শাসকদের রাজত্ব, সেখানে ইহুদিবাদ তো পুরোটাই সফল। ভূ-রাজনীতির খলনায়কেরা যেখানে শাসন করে, ইসরাইল তো সেখানে নিরাপদে থাকবেই। আসলে পুরোটাই ধুলায় অন্ধকার!
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা