ইন্ডিয়ার বাংলাদেশ সিনড্রোম
অন্য দৃষ্টি- জসিম উদ্দিন
- ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
সরকারি হেফাজতে নাগরিক-সাধারণের ওপর পীড়নের অভিযোগ ওঠে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম থেকে। হেফাজতে বহু মানুষের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। এর চেয়ে বেশি ঘটেছে নির্যাতনে পঙ্গু হওয়ার ঘটনা। বিরোধী দলের নিশানা করা নেতাকর্মীরা এই ভারবহতার শিকার। এর মধ্যে যারা ইসলামী ধারার রাজনীতির সাথে জড়িত, পুলিশি হেফাজত শেষে তাদের মুমূর্ষু অবস্থায় পাওয়া গেছে। আদালতে তারা আর সশরীরে হেঁটে হাজির হতে পারেননি। অন্যের ঘাড়ে ভর দিয়ে কিংবা স্ট্রেচারে করে আনতে হয়েছে। কারাগারেও তাদের ওপর অমানসিক নির্যাতন অভিযোগের অন্ত নেই। কারাবাসের পর চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন অনেকে। কারাগার থেকে লাশ হয়ে ফেরত ব্যক্তির সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
একই আলামত শুরুর ইঙ্গিত মিলছে ভারতে। যদিও দেশটিতে রাজনৈতিক নেতাদের এ যাবৎ রাষ্ট্রব্যবস্থা সুরক্ষা দিয়েছে। কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী ছাড়া অন্যরা এ সুরক্ষার আওতায় ছিলেন। অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে রাজনৈতিক নেতা হত্যা কিংবা কারাগার থেকে কেউ নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে আসার খবর ভারতে খুব একটা নেই। শুধু সত্তর দশকে নকশালপন্থীদের ওপর ইন্দিরা সরকারের তীব্র অত্যাচার লক্ষ করা গেছে। তবে একথাও অস্বীকার করার জো নেই, তারা প্রচলিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক শীর্ষ নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে এক যুগ আগে যে অভিযোগ তুলে আসছেন, সদ্য গ্রেফতার হওয়া দিল্লিøর মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল সেই অভিযোগ আনলেন। তিনি কারাগার থেকে এক বার্তায় বলেছেন, ‘সন্ত্রাসী নই, আমি কেজরিওয়াল’। তার সহযোদ্ধারা জানিয়েছেন, তার একজন নাগরিক হিসেবে যেমন সুযোগ পাওয়ার কথা সেটি দেয়া হচ্ছে না। তার সাথে কারা কর্তৃপক্ষের আচরণ দাগি আসামির চেয়ে নিকৃষ্ট। সহকর্মীরা অস্বচ্ছ কাচের দেয়ালের আড়াল থেকে কেজরিওয়ালের সাথে কথা বলেছেন। এমনকি স্ত্রীর সাথে মুখোমুখি বসে কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়নি কেজরিওয়ালকে। এমন আচরণ কারাগারে শুধু সন্ত্রাসীদের সাথে করা হয়।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এখনো বহু মানুষ গুমের শিকার। এসব ঘটনায় দেশের মানুষ কোনো প্রতিকার পায়নি। জাতিসঙ্ঘ, মানবাধিকার সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আপত্তিকে সরকার পাত্তা দেয়নি। আপাতত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন স্তিমিত হলেও দেশের মানুষ এই হুমকিতে রয়েছেন। যেকোনো সময় আবার বড় আকারে শুরুর আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। বিচার না পাওয়া মানুষের আর্তনাদ এ দেশের আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এ অবস্থায় ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের ক্রন্দন আমরা শুনতে পাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত সে দেশে ‘সরকারবিরোধী রাজনীতি’ করা অপরাধের পর্যায়ে চলে যায় কিনা; কিংবা সেখানে তাদের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের অপরাধ সংঘটন করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী আগাম দায়মুক্তি পায় কিনা, বলা মুশকিল। তবে লক্ষণ ইতোমধ্যে ফুটে উঠেছে। মোদি সরকার এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনুসরণ করলে আশ্চর্যের কিছু থাকবে না।
বিজেপি যে বাংলাদেশ সরকার অনুসৃত পথটি বেছে নিতে পারে তার প্রাথমিক আলামত দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারবিরোধী মোর্চা ইন্ডিয়া জোট রাষ্ট্র্রযন্ত্র ব্যবহার করে তাদের ওপর পীড়ন চালানোর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেছে। এক স্মারকলিপিতে নির্বাচন কমিশনের কাছে এই নির্বাচনী মোর্চা আহ্বান জানিয়েছে, তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র্রীয় বাহিনী যেকোনো ধরনের অভিযান চালানোর আগে যেন নির্বাচন কমিশনের একটি কমিটির অনুমোদন নেয়। অর্থাৎ বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে দেবে নির্বাচন কমিশন। কমশিন বাধা দিলে সেটি যেন রাষ্ট্র্রীয় বাহিনী আর করতে না পারে। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের বিরোধী দল নির্বাচন কমিশনের কাছে এ ধরনের দাবি জানিয়ে আসছে। একটি অবাধ স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে তারা যেন ভূমিকা রাখে। এ ধরনের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশের বিরোধী দল ক্লান্ত-শ্রান্ত। তারা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে। নির্বাচন কমিশন বিরোধী দলের দাবির ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। তারা তাই করেছে, সরকার যা চেয়েছে। ফলে নির্বাচনে প্রতিযোগিতার অধিকার হারিয়েছে বিরোধী দল। নাগরিকরা হারিয়েছেন ভোটাধিকার।
আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি; ভারত একের পর এক এসব নির্বাচনে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগী হয়েছে। ২০১৪ সালে দেশটির তদানীন্তন পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং এ দেশের রাজনীতিতে নগ্ন হস্তক্ষেপ করেন। ওই সময় ভারতে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। কংগ্রেস-সরকারের প্রণোদনায় একটি একপক্ষীয় নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধস নামায়। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে আমাদের পুরো দেশ। এখন শুরু হয়েছে ভারতের পালা। বিজেপি এখন সেই নীতি গ্রহণ করছে, যা ২০১৪ সালে কংগ্রেস বাংলাদেশে প্রচলনে সহযোগিতা করেছে। ২০১৮ সালে আমরা দেখেছি, ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা কিভাবে নির্বাচন কমিশনে আসা-যাওয়া করেছেন। এরপর আমাদের প্রায় সব রাষ্ট্র্রীয় সংস্থা ধসে গেছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের বিরোধীরা উচ্চ আদালতেও কোনো আশ্রয় পায়নি। বিদেশী সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছে- বিরোধীদের দমনে আদালতকে বরং হাতিয়ার বানিয়েছে সরকার।
কংগ্রেস নেতারা এখন এসব রাষ্ট্র্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে ধরনা দিচ্ছেন। সম্ভবত ইতোমধ্যে দেশটির নির্বাচন কমিশন সরকারের কব্জায় চলে গেছে, যেমনটি আমাদের দেশে হয়েছে। ফলে তারা প্রতিকার না পেয়ে নির্বাচন কমিশনের দ্বারা বাংলাদেশের মতো প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কংগ্রেসসহ বিরোধীরা কেন্দ্রীয় সংস্থা ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি-এনআইএ, সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট-ইডিসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে তাদের সবচেয়ে সক্ষম নেতাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার অভিযোগ এনেছে।
দুর্নীতির মামলা নিয়ে বিজেপি সরকারের পলিসি এত দিনে এসে হুবহু বাংলাদেশের সাথে শতভাগ মিলে যাচ্ছে। এতে দেখা যাচ্ছে, বিরোধী সম্ভাবনাময় নেতারা সরকারি দল কিংবা তাদের জোটে যোগ দিলে সব মামলা উধাও হয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের ২৫ জন কেন্দ্রীয় নেতা তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার তদন্ত চলাকালে সরকারি শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের কাউকে কাউকে মামলা থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে, কারো বিরুদ্ধে তদন্ত চলে গেছে হিমঘরে। অন্যদিকে, নতুন নতুন মামলা নিয়ে ইডি, সিবিআই, এনআইএ ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিরোধীদের ওপর। এসব নিয়ে বিরোধীরা যখন সমালোচনামুখর তখন সরকারের একেবারে শীর্ষ ব্যক্তি বাংলাদেশের মতো নানাভাবে কামান দাগাচ্ছেন বিরোধী নেতাদের চোর-দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে। মোদি বলছেন, এসব নেতা পাপের ভয়ে ভীত, এমনকি তাদের তিনি মাদক কারবারি, মাফিয়া ইত্যাদি অপরাধে অভিযুক্ত করতেও পিছপা হচ্ছেন না।
কংগ্রেসের ওপর বিজেপির চতুর্মুখী আক্রমণ যেগুলো মূলত গণতন্ত্র চর্চা কিংবা রাজনীতি চর্চা নয়। তারপরও দলটি বাংলাদেশে করা অপকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি নয়। সম্প্রতি দলটির ঘোষিত নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে বাংলাদেশ-বিষয়ক যে আলাপ তোলা হয়েছে, তা দায়িত্বজ্ঞানহীন। তারা সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করার তাগিদ দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের সাথে আর্থ-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক- দুটোই দিল্লির সাথে গভীর। তারা এ দেশের মানুষের মনে যে কষ্ট চাপিয়ে দিয়েছে সেটি উপলব্ধি করার যোগ্যতা রাখে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অদূর ভবিষ্যতে তারা যে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না, তাদের মেনিফেস্টোতে সে ইঙ্গিতের কথাই মনে হয়।
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা