১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

নাগরিকত্ব আইন : এক তীরে অনেক শিকার

-


সাধারণ নির্বাচনের ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে দেশে অনুসরণীয় আচরণবিধি জারি হয়ে গেছে। দেশে আগামী দুই মাস রাজনৈতিক হাঙ্গামাকারীদের দখলে থাকবে। এভাবেই নির্বাচনকে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব বলা হয়। ক্ষমতাসীন বিজেপি লাগাতার তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরিকল্পনা বানাচ্ছে। বলা হচ্ছে, এবারো মোদিই দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন। নিজেদের সফলতাকে নিশ্চিত করার জন্য বিজেপি সকল যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করেছে। রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা সবচেয়ে বড় যুদ্ধকৌশল, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণির ধর্মীয় আধিপত্যের জন্য কার্যকর করা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের তারিখ কাছে এগিয়ে আসতেই সরকার নির্বাচনী বন্ডের ফাঁদে আটকে গেছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এটাকে বিশে^ অবৈধ আয়ের সবচেয়ে বড় মাধ্যম অভিহিত করেছেন। নির্বাচনী বন্ডের পরিপূর্ণ তথ্য সরবরাহ না করার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াকে আরো একবার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। সরকার মনে করছে, নির্বাচনী বন্ডের স্ক্যান্ডালের রহস্য উন্মোচনের পর আর কিছ্ইু করার নেই। এ কারণে এ বিষয় থেকে জনগণের মনোযোগ সরানোর জন্য সরকার যে কৌশল অবলম্বন করেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কৌশল বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) বাস্তবায়ন। যা শুরু থেকেই মুসলমানদের নাগরিকত্বকে বিপদে ফেলার আইন অভিহিত করা হচ্ছে। এ কারণেই সিএএ বাস্তবায়ন সম্পর্কিত নোটিশ জারি হওয়ার সাথে সাথেই সে সকল শঙ্কা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, যা এ আইন সম্পর্কে মুসলমানদের ভেতর ছড়িয়ে পড়েছিল।

অথচ সরকারের দাবি, এটা কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার আইন নয়। বরং এর উদ্দেশ্য ওই সকল অমুসলিমকে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা, যারা প্রতিবেশী দেশগুলোতে ধর্মের ভিত্তিতে নির্যাতিত হয়। কিন্তু এ আইন যেহেতু ভারতীয় নাগরিকত্ব ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত, এ জন্য এর ভয়াবহতা সবাই অনুভব করছে। শুধু ভারত নয়, বরং আমেরিকা ও ইউরোপও এ আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুসলমানদের এ নিশ্চয়তা প্রদানের চেষ্টা করেছেন যে, ‘এ আইন দ্বারা তাদের নাগরিকত্বের কোনো সমস্যা হবে না। এটা নাগরিকত্ব প্রদানের আইন, নাগরিকত্ব হরণের নয়।’ কিন্তু এই ব্যাখ্যা থেকেই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি হয় যে, এ আইনের আলোকে দেশের সকল ধর্মের অনুসারীরা তো নাগরিকত্ব পাবে, তবে মুসলমানদের এখানে কেন বঞ্চিত করা হলো? মূলত ২০১৯ সালে যখন পার্লামেন্টে এ আইন পাস হয়েছিল, তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ক্রমধারা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, প্রথমে সিএএ আসবে। এরপর এনআরসি এবং তারপর এনপিআর আসবে। পরবর্তীতে তিনি সিএএ-এর ব্যাপারে একের পর এক যে বক্তব্য প্রদান করেছেন, তা মুসলমানদের শঙ্কা বৃদ্ধি করার মতো। আর এ কারণেই আজো কেউ তার কথা বিশ^াস করতে প্রস্তুত নয়।

সিএএ বাস্তবায়নের পর যে ধর্মের অনুসারীদের জন্য এটা উপকারে আসবে তন্মধ্যে হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন ও পারসিক ধর্মের অনুসারীরা শামিল রয়েছেন। আর যে দেশগুলোর অধিবাসীদের কোনোরূপ কাগুজে প্রমাণ ব্যতিরেকে অনলাইন ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে তন্মধ্যে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ শামিল রয়েছে। এ আইনে মুসলমানদের যুক্ত না করার কারণ হচ্ছে ওই তিন দেশে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। যেখানে এই সংখ্যালঘুদের বেঁচে থাকা হারাম করে দেয়া হয়েছে। স্বয়ং ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাদের সংখ্যালঘুদের সাথে যে ‘সদাচরণ’টা করে থাকে, তা উল্লেখ করা এখানে অনর্থক হবে। কেননা এটা আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে, ২০১৯ সালে এ আইন তখনই বাস্তবায়ন হয়ে গেছে, যখন পার্লামেন্টে পাস হওয়ার পর এতে প্রেসিডেন্টের সিলমোহরের ছাপ লেগেছে। তবে এ আইনের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন বিক্ষোভ আর প্রতিবাদের প্রেক্ষাপটে সরকার এর বিধি তৈরির কাজ নির্বাচনের সময়ের জন্য রেখে দেয়। যাতে ধর্মের ভিত্তিতে নির্বাচনে এর ফায়দা ওঠানো যায়। সাম্প্রতিক জারিকৃত নোটিশ এ ধারাবাহিকতারই একটি অংশমাত্র। এটা জারির পর আরো একবার ছাত্রসমাজ, সিভিল সোসাইটি ও নাগরিক অধিকারের সংগঠনগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে এবং এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে।

উল্লেখ্য বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বাস্তবায়নের নোটিশ ঠিক নির্বাচনের আগমুহূর্তে জারি করা হয়েছে। সবাই জানেন নির্বাচনের আগে যে ঘোষণাগুলো প্রদান করা হয়, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনে ফায়দা অর্জন করা। ক্ষমতাসীন বিজেপির এ ব্যাপারে যে অভিজ্ঞতা আছে তা অপর কোনো দলের নেই। কংগ্রেসের এ অভিযোগ যথার্থ, ‘এটা নির্বাচনের আগে দেশে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ভোট সংগ্রহ করবে।’ এ আইন প্রতিবেশী দেশগুলোতে বসবাসরত অমুসলিমদের কতটুকু উপকারে আসবে এবং তারা নিজেদের কতটুকু নিরাপদ করতে পারবে সে তর্কে না গিয়ে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, এ আইন পার্লামেন্টে পাস হওয়ার পর থেকে এর বিরুদ্ধে নাগরিক অধিকারের সংগঠন ও মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ জানিয়েছে। সরকার এ প্রতিবাদের নজিরবিহীন সফলতায় সরকার এতটাই ভীত হয়েছিল যে, প্রতিবাদ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে বেআইনি কার্যক্রমে জড়িতদের সম্পর্কিত আইন ইউএপিএ-র আওতায় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

তন্মধ্যে কিছু ব্যক্তি এখনো গরাদের ভেতরে আছেন। ওই সময়ই ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে ভয়াবহ দাঙ্গা সৃষ্টি হয়। যার ফলে পঞ্চাশের অধিক নিরপরাধ ব্যক্তি প্রাণ হারান এবং অসংখ্য ব্যক্তি আহত হন। এ ইস্যুতে দিল্লি পুলিশ ৭৫৮টি মামলা দায়ের করে যে দুই হাজারের অধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে, তার অধিকাংশই ছিল মুসলমান। এর মধ্যে কয়েকটি মামলায় আদালত দিল্লি পুলিশকে তিরস্কার করেছেন। কেননা ওই মামলাগুলোতে সাক্ষী প্রমাণের মারাত্মকরূপে ঘাটতি ছিল। ধারণা করা হয়, নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে সিএএ বাস্তবায়ন করার সবচেয়ে বড় ফায়দা হবে বিজেপির পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গ এই সময় শাসকদলের সবচেয়ে বেশি টার্গেটে রয়েছে। সেখানে সন্দেশখালি ইস্যুতে রাজনৈতিক ভেল্কিবাজি চরমপর্যায়ে রয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন লোকসভা সদস্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছিলেন। এ কারণে এ আইন বাস্তবায়নের নোটিশ জারি হতেই পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি উৎসব পালন করেছে। উল্লেখ্য সিএএ বাস্তবায়ন হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া সম্প্রদায় নাগরিকত্ব পাবে, যাদের সংখ্যা দশ লক্ষাধিক। ২০১৯ সালে এ আইন যখন পার্লামেন্টে পাস করা হয়, তখন বিজেপি মতুয়া সম্প্রদায়ের কাছে ওয়াদা করেছিল যে, সিএএ-র মাধ্যমে তাদের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া, উত্তর-পশ্চিম চব্বিশ পরগনা জেলাগুলোর লোকসভার কমপক্ষে চারটি আসনে এ সম্প্রদায় হারজিত চূড়ান্ত করতে পারে। বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়ন হওয়ার পর মুসলিম সমাজে সবচেয়ে বেশি হইচই হচ্ছে। সরকারি মাধ্যমগুলো মুসলমানদের আশ^স্ত করার জন্য এ কথা বলছে যে, তাদের ওপর এ আইনের প্রভাব পড়বে না। কেননা এ আইন নাগরিকত্ব প্রদানকারী, নাগরিকত্ব হরণকারী নয়। এ কারণে মুসলমানদের নাগরিকত্বের কোনো শঙ্কা নেই। আসল সমস্যা মুসলমানদের নাগরিকত্বের নয়, বরং সমস্যা সেই মানসিকতার, যার উদর থেকে এ আইন জন্ম নিয়েছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কথা হচ্ছে, এ দেশে প্রথমবার এমন এক আইন অস্তিত্ব লাভ করল, যা ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকদের শ্রেণিবিন্যাস করছে। আমাদের সংবিধানে কোথাও ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের ভিত্তির কথা নেই। এ আইনে মুসলমান ছাড়া দেশের সকল সম্প্রদায়কে শামিল করা হয়েছে। এ কারণে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এ আইনকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে এবং সেখানে কমবেশি ২০০টি আর্জি শুনানির অধীন রয়েছে। জাতিসঙ্ঘের নাগরিকত্ব সম্পর্কিত দফতরও এ আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে একটি আর্জি দায়ের করেছে। সুপ্রিম কোর্টে সিএএ-র বিভিন্ন দফাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। ভবিষ্যৎই বলবে সিএএ ভারতকে কোথায় নিয়ে যাবে এবং এর দ্বারা আরো কত শিকার করা হবে।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ
হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল