১১ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩০, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিজরি
`
তৃতীয় নয়ন

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন

-

‘বঙ্গ-কণ্ঠে’র সেই কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল চিরতরে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানী ঢাকার মতিঝিলে দেখলাম তার ছবিওয়ালা একটি পোস্টারে, তার মৃত্যুর পর এক বছর চলে গেল। আমরা কেউই এটা টেরই পেলাম না। আসলে আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি। না হয় ‘পল্লীবন্ধু’ এরশাদ বিস্মৃত হননি; কিন্তু ‘বঙ্গকণ্ঠ’ শাহ মোয়াজ্জেম বিস্মৃত হয়ে গেলেন কিভাবে? আসলে শেষ জীবনে বিএনপি করার কারণে শাহ মোয়াজ্জেম বিস্মৃত, এ কথা ধরে নেয়া যায়। মুন্সীগঞ্জের কোরবান আলী, প্রফেসর একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর চেয়ে তিনি কম বিখ্যাত ছিলেন না। শাহ মোয়াজ্জেমের দুর্ভাগ্য শুরু হয়েছিল খন্দকার মোশতাকের সাথে ভিড়ে। তখনকার প্রেক্ষাপটে অনেকেই মোশতাকের সাথে ভিড়ে গিয়েছিলেন।
শাহ মোয়াজ্জেমকে বলা হতো, এধড়ষ নরৎফ, কারণ তিনি জীবনের বিরাট একটা সময় জেলেই কাটিয়েছেন। তার লেখা একটি বিখ্যাত বই বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে। নাম ‘নিত্য কারাগারে’। এর ভূমিকায় তিনি বলেছেন, তার স্ত্রী গভীর রাত পর্যন্ত জেগে তাকে সহায়তা না করলে এই বই লেখা তার পক্ষে সম্ভব হতো না। তার স্ত্রী হচ্ছেন ঢাকার উইলস লিটন ফ্লাওয়ার স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষিকা মরহুমা সালেহা খাতুন। তিনি লেখকের পুরো প্রুফ দেখতে সহায়তা করেছেন। শাহ মোয়াজ্জেমের মতো আরেক বিতর্কিত রাজনীতিবিদ তাহের উদ্দীন ঠাকুরের একটি বড় সুখপাঠ্য বইয়ের নাম- ‘শুভ কেন আসে না’। দু’টি বই-ই প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি। হয়তো তাদের বাধ্য হয়ে এ কাজ করতে হয়।
শাহ মোয়াজ্জেমের জ্বালাময়ী কণ্ঠের কথা অনেকেই ভুলবেন না। বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনা এই দুই নেত্রীর যুগপথ আন্দোলনের তীব্র সমালোচনা করে তিনি বক্তব্য রেখেছেন এরশাদ আমলে। তার অনেক বক্তব্যকে অশ্লীল বলে গণ্য করা হতো। তিনি বলেছিলেন, দুই নেত্রীর মিলনে কোনো আন্দোলনই উৎপন্ন হবে না। এ জন্য তাকে অনেক সমালোচিত হতে হয়েছিল। ধানমন্ডি ২ নম্বর রোডের জাতীয় পার্টির সাবেক অফিসে ৯ নভেম্বর, ১৯৮৭ সালের রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে এ বক্তব্য রাখেন। আমি নিজেও সাংবাদিক হিসেবে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম।

শাহ মোয়াজ্জেম ছাত্রলীগের কর্ণধার ছিলেন। সে সুবাদে তিনি বিশেষ করে এরশাদ আমলে জাতীয় সংসদে বলতেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধুকে মুজিব ভাই বলেছি। কখনো ভাইকে বাপ ডাকিনি।’ শাহ মোয়াজ্জেম শেখ মুজিবের আমলে ছিলেন চিফ হুইপ। অথচ তিনি পরবর্তীকালে যোগ্য সমাদর পাননি। তিনি টঙ্গীর দু’জন বিখ্যাত শ্রমিক নেতার একজনের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কথিত। নিজের ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি ‘শাহ সাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন।
আমার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল ঢাকা জেলা ক্রীড়া সমিতি (DDSA) মিলনায়তনে। তখন এটি ছিল পল্টন ময়দানের পাশে। একটি এল শেপের টিনশেডের একতলা লম্বা ঘর। সেখানে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন ডেমোক্র্যাটিক লীগের একটি অংশের আত্মপ্রকাশের অনুষ্ঠান চলছিল। অনুষ্ঠানে শাহ মোয়াজ্জেমের সাথে ছিলেন কুষ্টিয়ার আব্দুর রউফ চৌধুরী (যিনি পরে বিএনপির এমপি হয়েছিলেন) এবং মানিকগঞ্জের আব্দুল বারী ওয়ার্সী ও বেগম আমেনা বারী। হলভর্তি দর্শকের সামনে যে ভাষায় খন্দকার মোশতাকের সমালোচনা করলেন, তা আমার কাছেও সঠিক মনে হয়নি। মোয়াজ্জেমের বক্তব্য ছিল অত্যন্ত শ্লেষাত্মক। তিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে পারতেন। তবে তার এতদিনকার নেতা মোশতাকের বিরুদ্ধে বলার ব্যাপারে তার আরো সংযমী হওয়া উচিত ছিল।

শেষ জীবনে শাহ মোয়াজ্জেম ম্ন্সুীগঞ্জে জাতীয় সংসদের একটি আসনে বিএনপির একজন প্রার্থী হয়েছিলেন। একটি ছোট দলের প্রার্থী সরকারের আশীর্বাদ নিয়ে শাহ মোয়াজ্জেমকে অপমানিত ও পরাজিত করে জয়ী হয়েছিলেন। তিনি প্রকৃত বিরোধী দল বিএনপি প্রার্থী না হলে এবং ক্ষমতায় তার সাবেক দল আওয়ামী লীগ না থাকলে হয়তো তাকে এভাবে অপমানিত ও নিগৃহীত হতে হতো না। এ ঘটনার পরে একটি সংবাদ সম্মেলনে শাহ মোয়াজ্জেম কাঁদো কাঁদো হয়ে ওই ঘটনা বর্ণনা করেন। কিন্তু তার এ বক্তব্য সংবাদপত্রে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল