ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আচরণবিধি
- প্রফেসর কর্নেল ডা: জেহাদ খান (অব:)
- ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০৫
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের জীবন কিভাবে পরিচালনা করা দরকার সব বিষয়ে ইসলামের রয়েছে স্পষ্ট ও কল্যাণময় দিক-নির্দেশনা। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের ব্যাপারে ইসলামের কোনো দিক-নির্দেশনা রয়েছে কি? চলুন মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও হাদিসে এ ব্যাপারে কী রয়েছে জানা যাক।
জ্ঞানার্জন
কুরআন ও হাদিসে জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে অনেক জোর দেয়া হয়েছে- ‘এবং বলো, আমার রব আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন’ (আল-কুরআন-২০ : ১১৪)।
‘এমন কোনো জিনিসের পেছনে লেগে যেও না যে সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই’ (আল-কুরআন ১৭ : ৩৬)।
রাসূল সা: বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি চিকিৎসা সম্পর্কে না জেনে চিকিৎসা করে তবে সে দায়ী হবে (ভুল চিকিৎসার জন্য)’ (আবু দাউদ-৪৫৮৬, ৪৭৮৭)।
কুরআন ও হাদিস থেকে জানা গেল, জ্ঞানার্জনের জন্য ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।
জ্ঞান বিতরণ
উন্নত দেশগুলোতে সিনিয়র ডাক্তারদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে জুনিয়র ডাক্তারদের শেখানো। এ ব্যবস্থা আমাদের দেশে এখনও ভালোভাবে গড়ে ওঠেনি। রাসূল সা: বলেছেন, ‘আদম সন্তান মারা গেলে তার আমল বন্ধ হয়ে যায় তিনটি ব্যতীত: সদকায়ে জারিয়া, জ্ঞান যা সে শিক্ষা দিয়েছে ও উপকারে লেগেছে এবং নেক সন্তান’ (মুসলিম-১৬৩১)।
সিনিয়র ডাক্তাররা এই হাদিসটি অনুসরণ করলে আমাদের দেশে জুনিয়র ডাক্তাররা অনেক তাড়াতাড়ি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন।
বিনয়
‘রহমানের (আসল) বান্দা তারাই যারা পৃথিবীর বুকে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং মূর্খরা তাদের সাথে কথা বলতে থাকলে বলে দেয়, তোমাদের সালাম’ (আল কুরআন ২৫ : ৬৩)।
‘আর মানুষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কথা বলো না, পৃথিবীর বুকে উদ্ধত ভঙ্গিতে চলাফেরা করো না, আল্লাহ কোনো দাম্ভিক ও অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না’ (আল-কুরআন ৩১ : ১৮)।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের ডাক্তারদের রোগীদের প্রতি আচরণ মনঃপুত না হওয়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী দেশের বাইরে চলে যায়।
অপারেশন বা যেকোনো কাজের শুরুতে আল্লাহর নাম নেয়া
এ ব্যাপারে একজন প্রখ্যাত তাফসিরকারক সুন্দর আলোচনা করেছেন, ‘ইসলাম মানুষকে একটি বিশেষ সভ্যতা ও সংস্কৃতি শিক্ষা দিয়েছে। প্রত্যেকটি কাজ শুরু করার আগে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা এই সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি রীতি। সচেতনতা ও আন্তরিকতার সাথে এ রীতির অনুসারী হলে অনিবার্যভাবে তিনটি সুফল লাভ করা যায়- ১. মানুষ অনেক খারাপ কাজ থেকে নিষ্কৃতি পাবে। কারণ আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার অভ্যাস প্রতিটি কাজ করার আগে এ কথা চিন্তা করতে বাধ্য করবে যে, এ কাজে আল্লøাহর নাম উচ্চারণ করার কোনো ন্যায়সঙ্গত অধিকার তার আছে কি না? ২. বৈধ, সঠিক ও সৎ কাজ শুরু করতে গিয়ে আল্লাহর নাম নেয়ার কারণে মানুষের মনোভাব ও মানসিকতা সঠিক দিকে মোড় নেয়। সে সবসময় সবচেয়ে নির্ভুল বিন্দু থেকে তার কাজ শুরু করবে। ৩. এ ক্ষেত্রে বড় সুফল এই যে, আল্লাহর নামে সে কাজ শুরু করবে তখন আল্লাহর সাহায্য, সমর্থন ও সহায়তা তার সহযোগী হবে। তার প্রচেষ্টায় বরকত হবে। শয়তানের বিপর্যয় ও ধ্বংসকারিতা থেকে তাকে নিরাপদ রাখা হবে। বান্দা যখন আল্লাহর দিকে ফেরে তখন আল্লাহও বান্দার দিকে ফেরেন, এটিই আল্লাহর রীতি (তাহফিমুল কুরআন প্রথম খ-, পৃষ্ঠা-৩৮, সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী)।
মনোযোগ দিয়ে শোনা
আমাদের দেশের রোগীদের একটি অভিযোগ যে, ডাক্তাররা তাদের কথা ঠিক মতো শুনতে চান না। অথচ রাসূল সা: পৃথিবীর ব্যস্ততম মানব হয়েও ছোট-বড় সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, শুধু তাই নয়, বক্তার দিকে ফিরে কথা শুনতেন। কুরআনের ভাষায়, ‘তাদের মধ্যে কিছু লোক আছে (মুনাফিক) যারা নিজেদের কথা দ্বারা নবীকে কষ্ট দেয় এবং বলে, এ ব্যক্তি অতিশয় কর্ণপাতকারী’ (আল-কুরআন ৯ : ৬১)।
পরামর্শ করা
রোগ শনাক্ত করা সম্ভব না হলে বা জটিল রোগ হলে ডাক্তারদের উচিত তাদের চেয়ে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা।
‘তারা তাদের রবের নির্দেশ মেনে চলে, নামাজ কায়েম করে এবং নিজেদের সব কাজ পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে আঞ্জাম দেয়’ (আল-কুরআন ৪২ : ৩৮)।
রাসূল সা: বদর, ওহুদ ও খন্দকের যুদ্ধে সাহাবিদের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় স্ত্রীর পরামর্শে কাজ করেছেন।
দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করা
অসুস্থতার কারণে বা অন্য কোনো কারণে রোগী বা তার অ্যাটেন্ডেন্টদের ভুল-ত্রুটি হতে পারে। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উচিত তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করা।
‘এবং ভালো ও মন্দ সমান হয় না। প্রতিহত করো (মন্দকে) তা দিয়ে যা উত্তম, ফলে তখন তোমার ও যার মধ্যে শত্রুতা আছে সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো’ (আল-কুরআন ৪১ : ৩৪)।
‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সব অবস্থায়ই অর্থসম্পদ ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ দমন করে এবং অন্যের দোষ-ত্রুটি মাফ করে দেয়। এ ধরনের সৎ লোকদের আল্লাহ অত্যন্ত ভালোবাসেন’ (আল-কুরআন ৩ : ১৩৪)।
দৃষ্টি সংযত রাখা
‘হে নবী! মুমিন পুরুষদের বলে দাও, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হিফাজত করে। এটি তাদের জন্য বেশি পবিত্র পন্থা। তারা যা কিছু করে আল্লাহ তা জানেন’ (আল-কুরআন ২৪ : ৩০)।
অপারেশনের পরে বা নির্জন মুহূর্তে কোনো কোনো স্বাস্থ্যকর্মীর অসংযত দৃষ্টি মাঝে মধ্যে দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
রোগের নয়, রোগীর চিকিৎসা করা
Dr. Larry Dossey, MD এ ব্যাপারে একটি সুন্দর কথা বলেছেন:
‘An internist always looks internally inside the patient for the origin of the problem in the present moment. An Eternist looks at all time and space, both inside & outside the patient for solutions.’
অর্থাৎ ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ শুধু শরীরের ভেতরের সমস্যা নিয়ে বর্তমান সময়ে চিন্তাভাবনা করে থাকেন। আর একজন Eternist চিন্তা করেন স্থান, কাল, পাত্রসহ শরীরের ভেতরের ও বাইরের সব কিছু সমাধানের জন্য। এ কথাটি অন্য ভাষায় বলা হয়, রোগের চিকিৎসায় Wholistic Approch অর্থাৎ শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, মানসিক, সামাজিক এবং নৈতিক দিক সব কিছু বিবেচনায় আনা। একজন ডাক্তারকে ইসলামী স্বাস্থ্যনীতি এরকম কর্মপন্থারই শিক্ষা দিয়ে থাকে। সব কিছু বিবেচনার পরও কুরআন আরো শিক্ষা দেয়- ‘আমি যখন রোগাক্রান্ত হই তিনিই আমাকে সুস্থতা দান করেন’ (আল-কুরআন ২৬ : ৮০)।
উপরের আয়াতটি ডাক্তারদের এই শিক্ষাই দেয়, সত্যিকার রোগমুক্তি বা মৃত্যু মহান আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। অনেক ডাক্তার অসুস্থ হন, হঠাৎ করে মারা যান। জীবন ও স্বাস্থ্য তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলে তারা এভাবে মারা যেতেন না। কাজেই বৈষয়িক উপকরণের পাশাপাশি চিকিৎসার ব্যাপারে মহান আল্লাহর ওপর নির্ভর করাই হচ্ছে ইসলামের আহ্বান।
পেশাগত বা ব্যবসায়িক সততা
ইংরেজিতে একটি কথা আছে: ‘Honesty without ability is worthless but ability without honesty is dangerous’ অর্থাৎ সৎ লোকের যদি যোগ্যতা না থাকে তা অর্থহীন, কিন্তু যোগ্য লোক যদি অসৎ হয় তা হবে ভয়ঙ্কর। কাজেই একজন ডাক্তারকে সৎ ও যোগ্য হতে হবে।
‘যারা ব্যবসায় ও বেচাকেনার ব্যস্ততার মধ্যেও আল্লাহর স্মরণ, নামাজ কায়েম ও জাকাত আদায় করা থেকে উদাসীন হয় না। তারা সে দিনকে ভয় করতে থাকে যে দিন অন্তরসমূহ পাথর হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে’ (আল-কুরআন ২৪ : ৩৭)।
ইবনে আব্বাস রা: বলেন, রাসূল সা: অভিশাপ দিয়েছেন ওই পুরুষদেরকে যারা নারীরূপ ধারণ করে’ (বুখারি-২০০২)। এসব নারী-পুরুষের ইচ্ছা আংশিকভাবে পূরণের জন্য কোনো কোনো অসৎ ডাক্তার তাদের অপারেশন করে থাকে। পরিণামে এই Transgender বা হিজরা মানুষগুলো পরিবার বা সমাজের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
রাসূল সা: বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন বলবেন- ‘হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমার খোঁজখবর রাখোনি।’ সে বলবে, হে পরওয়ারদিগার! আমি কী করে তোমার খোঁজখবর রাখব, অথচ তুমি সারা জাহানের প্রতিপালক! আল্লøাহ বলবেন, ‘তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, আর তুমি তার সেবা করোনি। তুমি কি জানতে না যে তুমি তার সেবা শুশ্রƒষা করলে তার কাছেই আমাকে পেতে’ (মুসলিম-২৫৬৯)।
এই হাদিস অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর্মীদের মহান আল্লাহকে কাছে পাওয়ার অপূর্ব সুযোগ রয়েছে। আবার আমাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়ানোরও সম্ভাবনা রয়েছে।
কোনো কোনো ডাক্তার এমন সব ডিগ্রি লিখে থাকেন, যা স্বীকৃত নয়। এটিও ব্যবসায়িক অসততার পরিচয়। তেমনি একজন ডাক্তার যদি রোগীকে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা বা অপারেশন করে রোগীর অধিকার নষ্ট করেন কিয়ামতের দিন তা বিপদের কারণ হতে পারে। হ
লেখক: মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা