২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সমকালীন প্রসঙ্গ

লোডশেডিংয়ের দুর্বিষহ কবিতা

-

লোডশেডিং নিয়ে ইদানীং নিদারুণ সব সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড হচ্ছে। কেউ বা গান রচনা করছে, কেউ গাইছে। অনেকে বাহারি কবিতা রচনা করছে আবার কেউ কেউ তা আবৃত্তি করে সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তুলছে। মাঝে মধ্যে লোডশেডিং নিয়ে বাণী জাতীয় কিছু বাক্য যেমন রচিত হচ্ছে, তেমনি কিছু যুগান্তকারী ব্যঙ্গাত্মক রচনা, কার্টুন ইত্যাদি সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। আরেকজনের খোঁজ নিতে গিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করছেন- তোমাদের ওখানে বিদ্যুতের খবর কী!
বিদ্যুতের লোডশেডিং নিয়ে প্রখ্যাত কবি পূর্ণেন্দ্র পত্রীর একটি অসাধারণ কবিতা রয়েছে। আমার এক বন্ধুবর সাংবাদিককে দেখলাম কবিতাটি চমৎকারভাবে আবৃত্তি করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, বন্ধুটি কয়েক বছর ধরে একটু বোহেমিয়ান জীবনযাপনের চেষ্টা করছিল। চুলগুলোকে এলোমেলো কাকের বাসা বানিয়ে, বাউণ্ডুুলে পোশাক পরে কবি কবি ভাব নিয়ে সে এমনভাবে চলত যা দেখে মনে হতো দুনিয়ার রূপ-রস-গন্ধের প্রতি তার সব মায়া মোহ উঠে গেছে। তার কথাবার্তা ছিল নির্লিপ্ত এবং কোনো রকম হাসাহাসি বাদ দিয়ে বিশাল দার্শনিক প্রকৃতির গাম্ভীর্য নিয়ে উদাসীন দু’টি চোখে এলোমেলো দৃশ্য ধারণ করে পরিচিত লোকদেরকে প্রায়ই সে না চেনার ভান করত। কিন্তু লোডশেডিং তার জীবনের যে রূপান্তর ঘটিয়েছে তা যদি লোডশেডিংয়ের জনক ও জননীরা দেখতেন তবে গর্বে তাদের বুকের ছাতি ফুলে হিমালয়ের আকার ধারণ করত।

আমার উল্লিখিত বন্ধু কবি পূর্ণেন্দ্র পত্রীর কবিতা আবৃত্তির যে ভিডিও ফেসবুকে ছেড়েছেন, সেখানে দেখলাম তার চুল বেশ পরিপাটি। পরনে ভদ্রলোকের পোশাক। মুখে তৃপ্তির হাসি। তার শরীরে কিঞ্চিৎ মেদ জমেছে এবং চর্ম রঙ বেশ উজ্জ্বল হয়েছে। তার কণ্ঠে এক দিকে যেমন লালিত্য এসেছে অন্য দিকে অদ্ভুত এক আত্মবিশ্বাসের স্বর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তো তার এ রূপ দেখে আমি হকচকিত হলাম এবং আমারও মনে হলো যে, লোডশেডিং নিয়ে এই জাতির অনেক কিছু করার আছে। সুতরাং আমার কী করা উচিত তা গভীরভাবে চিন্তার জন্য আমি যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক তখনই বিদ্যুৎ চলে গেল। আমি প্রথমে অবাক হলাম এবং একটু পর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। কারণ জীবনে প্রথমবারের মতো অতি প্রকৃত বা অলৌকিক ঘটনার মুখোমুখি হলাম। বিদ্যুৎবিভ্রাট বা লোডশেডিং নিয়ে সৃষ্টিশীল কিছু করার চিন্তা শুরুর সাথে সাথে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার মধ্যে আমি অনেক অলৌকিক বিষয়ের সন্ধান পেলাম এবং কাজী নজরুলের সৃষ্টি সুখের উল্লাস তালাসের জন্য বাথরুমে চলে গেলাম।
আমার জীবনে বাথরুমে সময় কাটানো নিয়ে নানা রকম ঝক্কিঝামেলা হয়েছে। বিশেষ করে আমার স্ত্রী বিষয়টি একদম বরদাশত করতে চান না। কারণ ছেলেমেয়েরা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাথরুমে ঢুকে দীর্ঘ সময় ধরে মোবাইল ফোন টিপতে থাকে। তাদের মা শাসন করা শুরু করলেই সন্তানরা বলে বাবাও তো অনেকক্ষণ ধরে ওখানে থাকে। এসব কারণে আমি বাসার পরিবর্তে অফিসে এসে কিছুটা সময় ওখানে ব্যয় করি এবং দেশ জাতি নিয়ে চিন্তা করি। বাথরুমে বসে পত্রিকা পড়া এবং দেশ জাতি নিয়ে চিন্তা করার বুদ্ধিটি আমি ধার করেছিলাম আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের কাছ থেকে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ত্যাগ করার পর আমি আর বাথরুমে গিয়ে ওসব চিন্তা করি না। কিন্তু লোডশেডিংয়ের মাত্রা বাড়ার পর আমার পুরনো শিক্ষা এবং পুরনো অভ্যাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রচণ্ড গরমে যথাসম্ভব উদোম হয়ে নির্লজ্জ-বেহায়ার মতো বসে ঘাম ঝরানোর জন্য আমার কাছে বাথরুমই সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থান বলে বিবেচিত হচ্ছে।

অনেকে হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, আমার কেন উদোম হয়ে ঘাম ঝরাতে হবে। আমার কি আইপিএস নেই- আমি কি জেনারেটর চালিয়ে লোডশেডিংয়ের সময় এসি ছেড়ে ফুটানি দেখাতে পারি না। এ ব্যাপারে হাল আমলে যা ঘটছে, তা বুঝিয়ে না বললে বিষয়টি পরিষ্কার হবে না। আমার অফিসের জেনারেটরটি চালাতে প্রতি ঘণ্টায় তিন হাজার টাকার তেল লাগে। শুধু জেনারেটর বাবদ মাসে এক লাখ টাকার তেল পোড়ানোর মতো রমরমা ব্যবসায় আমি তো দূরের কথা- আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর কারোরই নেই- যা স্বর্ণালি অতীতে ছিল। অন্য দিকে যেসব জায়গায় আইপিএস রয়েছে, সেখানে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে আইপিএস চার্জ হওয়ার মতো সময়টুকুও পায় না। কাজেই কর্মক্ষেত্রে উদোম হওয়ার যে সুযোগ উন্নয়নের রূপকাররা আমায় দিয়েছে, তার ফায়দা হাসিলের জন্য আমি অনেক উপায় বের করে ফেলেছি।
আমি নিয়মিত ঘাম ঝরানোর জন্য দীর্ঘ দিন ধরে ব্যায়াম করি এবং স্টিম-সাওয়ার নিয়ে থাকি। এই কর্মের জন্য আমাকে যথেষ্ট সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হতো। লোডশেডিংয়ের কল্যাণে আমার শরীর থেকে প্রতিদিন দুই-তিন লিটার ঘাম অনায়াসে ঝরে যায়। ফলে সময় ও অর্থ ব্যয় ছাড়াই শরীরের মনের মস্তিষ্কের টক্সিনগুলো দূর করে প্রাকৃতিক উপায়ে সুস্থ থাকার যে সুযোগ সদাশয় আওয়ামী সরকার বাহাদুর আমাকে করে দিয়েছে, তা স্মরণ করলে আবেগে কান্দন চলে আসে। অনেকের জন্য মায়া হয়- অনেকের সাথে মোসাফাহা করার ইচ্ছে জাগে এবং অনেককে বাসায় দাওয়াত করে লোডশেডিংয়ের মধ্যে অর্ধ উদোম হয়ে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে পোলাও-কোর্মা খেয়ে আনন্দে ধ্যাতাং ধ্যাতাং নাচতে ইচ্ছে করে।
আজকের নিবন্ধে আমি যে দিনের কথা বলছি, সে দিন বাথরুম থেকে বের হয়ে হঠাৎ মহামানব হয়ে গেলাম। বহু মানুষের জন্য দরদ উথলে উঠল। প্রথমেই আমার ব্যক্তিগত পিয়ন সাইফুলকে ডাকলাম। প্রায় কুড়ি বছর ধরে সাইফুল আমার সাথে আছে। তার কাছে লোডশেডিংয়ের হাল হকিকত জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল, গত রাতে সাতবার ক্যারেন্ট গেছে। সারা রাত একটুও ঘুমাতে পারিনি। তার ছোট শিশুটির গরম ঠাণ্ডা লেগেছে। আমি সাইফুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, রাজ্যের ক্লান্তি অবশাদ এবং হতাশা তার সীমিত আয়ের যুদ্ধবিদ্ধস্ত জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে।
সাইফুলের সাথে কথা বলার পর আমি আবার বৃদ্ধ মায়ের সাথে কথা বললাম। এক মাস ধরে তিনি গ্রামে আছেন। মায়ের বয়স আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি। আমরা সাতটি ভাই শত চেষ্টা করেও মায়ের আরাম-আয়েশকে সেই পর্যায়ে নিতে পারিনি যে পর্যায়ে রাষ্ট্র ও গরিব জনগণ প্রধানমন্ত্রীর নিরবচ্ছিন্ন আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করেছেন। গণভবন-বঙ্গভবনের বিরতিহীন বিদ্যুৎ সংযোগ-এসি-ফ্যান-লাইটের মতো করে বাংলাদেশের কোনো ধনী তাদের বাসগৃহে ও অফিসগৃহে স্মার্ট বাংলাদেশের পোর্ট্রটে রচনা করতে পারছে না। ফলে আমরা ঢাকা শহরে যে দুর্বিষহ গরমের যন্ত্রণায় দাহ হচ্ছি তা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মা গ্রামে গিয়ে ভারী বিপদে পড়েছেন। ওখানে এত বেশি ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে যা এলাকাবাসীকে রীতিমতো পাগল বানিয়ে ফেলছে।

মায়ের সাথে কথা বলার পর আমি খুব স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম। স্বাধীনতার পরপর আমার শৈশবের যে স্মৃতি আজো আমাকে নস্টালজিয়ায় ফেলে দেয় সেখানে অসংখ্য স্মৃতির মধ্যে চৈত্র মাসের তাপদাহ এবং ভাদ্র মাসের তালপাকা ভ্যাপসা গরমের স্মৃতির কথা মনের মধ্যে চলে আসে। আমার কিশোরী মা সেই সময়ের গরমের মধ্যে সারা রাত তালপাখা দিয়ে আমায় বাতাস করতেন- আর দিনের বেলায় যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতেন যেন তার দুরন্ত শিশুটি রোদের কবলে পড়ে রোগাক্রান্ত না হয়ে পড়ে। সময়ের বিবর্তনে তালপাখার জায়গায় বৈদ্যুতিক পাখা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র সবই পেয়েছি- কিন্তু উন্নয়নের খড়গ এমনভাবে আঘাত করেছে যে, তালপাখা দিয়ে বাতাস করার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
মায়ের সাথে কথা বলার পর বৈকালিক শরীরচর্চার জন্য রমনা পার্কে গেলাম। পার্কে দর্শানার্থী নেই বললেই চলে। সুনসান নীরবতার মধ্যে আমার মতো দু-চারজন অতি সিরিয়াস স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ প্রচণ্ড গরমের মধ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে অর্ধ মাতালের মতো হেলেদুলে হাঁটার চেষ্টা করছে। পার্কের মধ্যে অন্য সময় কাক-কুকুরের যে উপদ্রব থাকে তা সে দিন একেবারে ছিল না। কোনো পাখির কুজন, হকারের হাঁকডাক এবং প্রেমিক-প্রেমিকাদের ফিসফাস ছিল না। অন্যান্য সময়ের মতো কাঠবিড়ালিরা ছোটাছুটি করছিল না। পার্কের চার দিকের ব্যস্ত রাস্তাগুলোতে দুর্বিষহ যানজট এবং পার্কের মাটি থেকে উঠে আসা বাষ্পের যন্ত্রণায় পুরো রমনা পার্কে যেন এক টুকরো বিভীষিকাময় ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে, যেখান দিয়ে হাঁটতে গিয়ে এক ধরনের নিঃসঙ্গতা ও হাহাকার অনুভব করছিলাম। পার্ক থেকে ফেরার পথে দেখলাম এক ভদ্রলোক হিটস্ট্রোকের কবলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। মন্ত্রিপাড়ার কাছে পার্কের যে মূল গেটটি রয়েছে, সেখানেই ভদ্রলোক পড়ে আছেন। তিনি হয়তো সরকারের বড় কোনো কর্তা হবেন। ড্রাইভার-পুলিশ এবং পথচারীরা প্রাণান্ত চেষ্টা করছে তার সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনার জন্য। আমি ভদ্রলোকের নিথর দেহপানে তাকিয়ে বুঝলাম- তিনি সর্বদা এসির বাতাসে অভ্যস্ত নাদুস নুদুস প্রকৃতির মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক। হয়তো গত কয়েক দিন ঘুমোতে পারেননি- হয়তো তার ডায়াবেটিসের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। ফলে অসুস্থ শরীর নিয়ে হাঁটতে এসেছিলেন; কিন্তু পারেননি। হিটস্ট্রোকের কবলে পড়েছেন, তাকে জরুরিভিত্তিতে হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন- কিন্তু চারপাশের ট্রাফিক জ্যাম ভেদ করে তাকে নিয়ে যাওয়া- অথবা তাকে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স আসা অসম্ভব। অথচ পার্কের খুব কাছাকাছিতেই অনেক সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। ভদ্রলোকের কপালে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছে তা বলতে পারব না- কারণ স্থান ত্যাগের সময় তার ড্রাইভারের কান্নার সুর কানে এসেছিল।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement
ফিলিপাইনে ব্রহ্মস পাঠাল ভারত, ৩৭৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি চীনের মোকাবেলায় নতুন ডিভিশন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে! আবারো চেন্নাইয়ের হার, ম্লান মোস্তাফিজ 'কেএনএফ' সন্ত্রাস : সার্বভৌম নিরাপত্তা সতর্কতা অর্থনীতিতে চুরি : ব্যাংকে ডাকাতি পাকিস্তানে আফগান তালেবান আলেম নিহত যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য না করলে এ বছরই রাশিয়ার কাছে হারতে পারে ইউক্রেন : সিআইএ প্রধান রাশিয়ার সামরিক শিল্পক্ষেত্রে প্রধান যোগানদার চীন : ব্লিংকন ইরাকে সামরিক ঘাঁটিতে 'বিকট বিস্ফোরণ' শেখ হাসিনা সব প্রতিবন্ধকতা উপড়ে ফেলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা বন্ধে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার

সকল