২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি আরেক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন

-

বিশ্বব্যাপী ভয়ঙ্কর সতর্কতা ও হুঁশিয়ারির মধ্যেই এগিয়ে চলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রাকৃতিক বুদ্ধিমানদের নিরলস গবেষণা। ফলে বিশ্বজুড়ে নতুন করে যথেষ্ট আশঙ্কা ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কৌতূহলী মানুষের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন। এআই নিয়ে আগামীর প্রযুক্তি কি আশীর্বাদ না-কি অভিশাপ বয়ে নিয়ে আসছে? প্রযুক্তির নিত্যনতুন গবেষণায় কী হতে চলেছে আগামীর বিশ্বে? মানুষ কি তাদের প্রযুক্তির গবেষণার মাধ্যমে আরেক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সৃষ্টি করছে? ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সেই রোমহর্ষক কাহিনী আমাদের অনেকেরই জানা। আসুন, আবার সংক্ষেপে একটু জেনে নিই সেই বীভৎস কাহিনী। একজন জার্মান গবেষক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তার বিশেষ গবেষণার মাধ্যমে একটি বিশেষ ধরনের বিজ্ঞান আয়ত্ত করতে সক্ষম হন। ফলে তিনি মৃত ব্যক্তির শরীরের বিভিন্ন অংশ বিশেষ জোড়া দিয়ে তাতে প্রাণ সঞ্চালন করেন। সৃষ্টি হয় প্রচণ্ড শক্তিধর, কুৎসিত এক দানবের। পরে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নিজেই নিজের সৃষ্টিকে ভয় পান এবং তিনি সেটির সাথে খারাপ আচরণ শুরু করেন। স্র্রষ্টা অর্থাৎ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের খারাপ আচরণ দেখে সে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে সেটি তার স্র্রষ্টাকে মেরে ফেলতে চায়। একদিন সেটি বনে আশ্রয় নেয় এবং তার স্রষ্টার ওপর পর্যায়ক্রমে প্রতিশোধ নিতে থাকে। প্রথমেই সে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সহকারী ড. নীল ও তার একজন আয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর সে হত্যা করে তার সৃষ্টিকর্তার এক ভাইকে। বনে আশ্রয় নিলেও সে একে একে শত শত গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এরপর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের বিয়ের রাতে সে নববধূ ও তার আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করে। যদিও ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তার সৃষ্টি করা দানবকে হত্যা করতে চেয়েও পারেননি। একপর্যায়ে সৃষ্টিকর্তাই ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে মারা যান। গল্পের শেষে দেখা যায়, ফ্রাঙ্কেনস্টাইন মারা যাওয়ার পর সেটি নিজেও আত্মহত্যা করতে চেয়ে পরে নিমিষে হারিয়ে যায়। উপন্যাসটিকে বলা হয়- পৃথিবীর প্রথম সায়েন্স ফিকশন। এটি এক সাথে ভৌতিক, গথিক, রোমান্স ও বিজ্ঞানের কল্পকাহিনীতে ভরপুর। শেলি মেরি রচিত উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮১৮ সালের ১ জানুয়ারি। শেলি মেরি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন উপন্যাসের মাধ্যমে মানব জাতিকে স্পষ্ট একটি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আর তা হলো- প্রকৃতির রহস্য পুরোপুরি উন্মোচিত করতে গেলে কেমন করে সব কিছু হারাতে হয়।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের কাহিনীতে যে ম্যুরাল দিকটি আমরা দুই শ’ বছর আগে জেনেছিলাম ঠিক দুই শ’ বছর পরে কি আমরা সে ম্যুরাল থেকে কোনো শিক্ষা নিতে পেরেছি? অনেকেই বলছেন, পারিনি। আমরা যে সত্যি কোনো শিক্ষা নিতে পারিনি তার বড় প্রমাণ ‘এআই গডফাদার’ নামে পরিচিত গুগলের সাবেক কর্মকর্তা জিওফ্রে হিন্টনের নতুন সতর্কবার্তা। প্রাথমিক কিছু সতর্কতা থেকে ধারণা করা হয়েছিল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থানে বিশ্বে ৩০ কোটির বেশি মানুষ শুধু চাকরি হারাবে। ৩০ কোটির বেশি মানুষের চাকরি হারানোর কথাটি মার্কিন এক বিনিয়োগ ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে প্রকাশ করে। তাদের ধারণা, কর্মক্ষেত্রের প্রশাসনিক খাতের ৪৬ শতাংশ, আইনি খাতের ৪৪ শতাংশ জায়গা দখল করে নেবে এআই। এর আগে ‘গোল্ডম্যান স্যাকস’ তাদের অন্য এক প্রতিবেদনে জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মোট কর্মশক্তির এক-চতুর্থাংশ চাকরির জায়গা দখলে নিতে পারে এআই প্রযুক্তি। এসবের বাইরে আরো ভয়ঙ্কর ক্ষতির কথা বিস্তর গবেষণার মাধ্যমে ধীরে ধীরে জানা যাচ্ছে। ৭৫ বছর বয়স্ক জিওফ্রে হিন্টন যার জীবনের অর্ধেক সময় কেটেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাজে, তিনি নিজে এআইয়ের ভয়ঙ্কর ক্ষতির দিকটি জানান দিচ্ছেন। তিনি আগে গুগলের মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম সামলাতেন। ব্রিটিশ এই বিজ্ঞানী যাকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জনক বলা হচ্ছে, তিনি ভবিষ্যতের প্রযুক্তি নিয়ে ভয়ঙ্কর বার্তা দিচ্ছেন। তিনি এও বলছেন, ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মারাত্মক ক্ষতিকর যে দিকগুলো তিনি দেখছেন তার জন্য তার অনুতাপ হয়। তিনি হুঁশিয়ারি করে বলেন, এআই চ্যাটবট থেকে এমন কিছু হতে পারে যা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। এই মুহূর্তে তারা আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান নয়, কিন্তু শিগগিরই তারা তা হয়ে যাবে। তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, জিপিটি-ফোরের মতো জিনিসগুলো সাধারণ জ্ঞানের পরিমাণের দিক থেকে একজন মানুষকে অনেকখানি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এই প্রযুক্তি যেভাবে এগিয়ে চলেছে তাতে খুব দ্রুতই এর আরো উন্নতি ঘটবে। যা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। জিওফ্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষতির আরো ব্যাপকতা বুঝাতে বলেন, এআইয়ের ক্ষতি সারা বিশ্বে জলবায়ু বিপর্যয়ের ক্ষতি থেকেও ভয়াবহ হতে পারে। তিনি বলেন, জলবায়ু বিপর্যয়ে করণীয় কী তা আগে থেকে অনুধাবন করা যায়। যেমন- কার্বন পোড়ানো বন্ধ করলেই এ ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকি মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে আমরা কেউই স্পষ্ট কিছু জানি না। জিওফ্রের মতো একইরূপ সতর্কবার্তা দিয়েছেন মার্কিন মুল্লুকের শীর্ষ ধনকুবের ওয়ারেন বাফেট। তিনি বলেন, এআই প্রযুক্তি ‘পারমাণবিক বোমার মতো’। তবে চ্যাটজিপিটির নানান ক্ষতিকর দিকের বাইরে এর কিছু সুবিধার কথাও শোনা যায়। কেউ কেউ বলছেন, এর ফলে নতুন কিছু চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া শিল্প খাতে উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি পাবে। চ্যাটজিপিটি গান-কবিতা-উপন্যাস লেখা ও ছবিও আঁকতে পারে। এসব সুবিধার কথা মাথায় রেখেও ওয়ারেন বাফেট বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রযুক্তিবিদদের সতর্ক করে বলেন, এআই প্রযুক্তিকে সামনে এগিয়ে নেয়ার আগে সতর্কতার সাথে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তার ধারণা, যখন কোনো প্রযুক্তি সব ধরনের জিনিস করতে পারে তখন তা সত্যি চিন্তার। তিনি আরো আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একদিন সব কিছুই পরিবর্তন করে দেবে।

আতঙ্কিত প্রযুক্তিবিদরা এআই প্রসঙ্গে বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের কাজ যতটা সহজ করতে পারে তার থেকেও এর কুপ্রভাব নিয়ে তারা অধিক চিন্তিত। তাদের ধারণা, একটা সময় আসবে এআই উদ্ভাবন মানুষের বুদ্ধির পরিধিকেও ছাড়িয়ে যাবে। তাই যদি হয়, তবে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এআই প্রযুক্তি কি সৃষ্টি হিসেবে একদিন তার স্র্রষ্টার হন্তারক রূপে আবির্ভূত হবে? যেমনটি হয়েছিল ‘দ্য মডার্ন প্রথিমিউস’ খ্যাত ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গল্পে? অবশ্য প্রযুক্তিবিদদের অনেকে বলেন, প্রথম যখন কোনো নতুন উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয় তখন তার ইতিবাচক দিকটিই আগে লক্ষ করা হয়। পরে এর অপপ্রয়োগ শুরু হতে থাকে। এআই প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ ক্ষতির নানাদিক নিয়ে যারা চিন্তিত তারা অবশ্য ইতোমধ্যে এর বিরুদ্ধে জনমত গঠনে একজোট হয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন অ্যাপলের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্টিভ ওয়াজনিক, টেসলার কর্ণধার ইলন মাস্কসহ অনেক প্রযুক্তিবিদ ও গবেষক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মানব সভ্যতার সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়াতে জনমত গঠনে একটি খোলা চিঠি লেখা হয় যেখানে আগামী ছয় মাসের জন্য এআই উন্নয়ন প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এআই প্রযুক্তি নিয়ে যারা তৎপর এবং এ নিয়ে যারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তারা এত এত আশঙ্কা ও আতঙ্কের বার্তাকে কিভাবে গ্রহণ করবেন সেটিই এখন দেখার বিষয়। তবে গোটা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের আশা, সৃষ্টির নেশায় তারা এমন কোনো বীভৎস দানব নিশ্চয় সৃষ্টি করবেন না যা খোদ তার স্রষ্টার হন্তারকরূপে আবির্ভূত হয়।
লেখক : কলামিস্ট
mostafizur188@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৩৭ বাংলাদেশে নতুন করে বাড়ছে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা হিট অ্যালার্ট নিয়ে আবহাওয়া অধিদফতরের নতুন বার্তা ভান্ডারিয়ায় পিকআপ চাপায় বৃদ্ধ নিহত হোচট খেল লিভারপুল, পিছিয়ে গেল শিরোপা দৌড়ে যোদ্ধাদের দেখতে প্রকাশ্যে এলেন হামাস নেতা সিনওয়ার! ফের পন্থ ঝড়, ঘরের মাঠে গুজরাটকে হারাল দিল্লি ইউক্রেনকে গোপনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র গ্রেফতারের পর যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনপন্থীদের বিক্ষোভ আরো বেড়েছে ইউক্রেন যুদ্ধে দুর্নীতি, পুতিনের নির্দেশে গ্রেফতার রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী!  আমেরিকানরা কি ধর্ম থেকে সরে যাচ্ছে?

সকল