২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
সুশাসন

দেশের স্থিতিশীলতায় নির্দলীয় সরকার অপরিহার্য

-

বাংলাদেশে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা ছাড়া অন্য কোনো দল বিজয়ী হয়ে কখনো সরকার গঠন করতে পারেনি। দলীয় সরকারের অধীন জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় না এমন অভিযোগে পঞ্চম সংসদ বহাল থাকাকালীন আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি দেশব্যাপী তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলে। গণআন্দোল বেগবান হলে একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা একযোগে সংসদ হতে পদত্যাগ করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি প্রতিষ্ঠায় অনড় অবস্থানে থাকে। পঞ্চম সংসদ হতে দল তিনটির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করলে অগত্যা তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি ওই নির্বাচন বর্জন করে। এতে একতরফা নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে জাতীয় সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান প্রবর্তন করে।
পঞ্চম সংসদে বিএনপির এককভাবে সংবিধান সংশোধনে প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় এবং আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি সম্মিলিতভাবে সংসদ হতে পদত্যাগ করায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমন্বয়ে সংবিধান সংশোধনপূর্বক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান প্রবর্তনের পথ রুদ্ধ হয়। সে সময় আওয়ামী লীগের সভানেত্রীও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত বক্তব্যে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আগামীতে জাতীয় সংসদের কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেয়া হবে না।
আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির বর্জনের মধ্য দিয়ে একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন-পরবর্তী ভেঙে দেয়া হলে সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন সংবিধান নির্দেশিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়। এ দুটি নির্বাচনের প্রথমোক্তটিতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এবং দ্বিতীয়টিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনপূর্বক নির্ধারিত মেয়াদ অবধি সরকার পরিচালনা করে। ইতঃপূর্বে বাংলাদেশে কোনো সংসদ নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি।

অষ্টম সংসদের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বাধীন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল তা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনবিষয়ক সব বিকল্প নিঃশেষিত না করে গঠিত হওয়ায় এর গঠন প্রশ্নের মুখে পড়ে। ফলে অসাংবিধানিক সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগমন ঘটে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরের নেতৃত্বাধীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারটিকে, সে সরকারের সুবিধাভোগী আওয়ামী লীগ সরকারটির অধীন অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে এককভাবে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে বিজয়ী হলেও সংসদটির মেয়াদকালে সে সরকারের কার্যকলাপকে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়ার বিষয়ে সচেষ্ট হয়নি বরং সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বৈধতাবিষয়ক রিট মামলার আপিলের রায়ে বিচার্য বিষয়বহির্ভূত অপ্রাসঙ্গিক আলোচনার অবতারণায় সে সরকারকে বৈধতা দেয়ার প্রয়াস নেয়। এরূপ বৈধতা কতটুকু আইনসিদ্ধ তা দেখার জন্য দেশবাসীকে আগামীর অনুকূল পরিবেশ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে এমটিই প্রতিভাত।
নবম সংসদ নির্বাচনে পূর্বনির্ধারিত দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন প্রাপ্তির সুযোগের অপব্যবহারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিষয়ক স্বীয় অবস্থান হতে বিচ্যুত হয়ে একটি মীমাংসিত বিষয়কে পুনঃবিরোধের আবর্তে ফেলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপ সাধন করেন। অতঃপর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে পুনঃবিজয় নিশ্চিতে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন সংসদ বহাল থাকাবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান প্রবর্তন করেন। অবশ্য, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রবর্তনকালীন ওই সংশোধনীর বিষয়ভুক্ত কতিপয় বিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট আয়োজনের আবশ্যকতা অপরিহার্য ছিল কিন্তু তা না করে সংবিধানের অবজ্ঞায় সংশোধনীটি কার্যকর করা হয়।
সংসদ গঠন বিষয়ে সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ৩০০ সদস্য এবং তাদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভোটে নির্বাচিত ৫০ জন মহিলা সদস্য সর্বমোট ৩৫০ সদস্য সমন্বয়ে সংসদ গঠিত হবে। দশম সংসদ নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ভোটের জন্য উন্মুক্ত ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ওই সদস্য সমন্বয়ে যে সংসদ গঠিত হয়েছে; তা যে স্পষ্টত সংবিধানের অত্যাবশ্যক বিধানের উপেক্ষা ও অবজ্ঞায় হয়েছে এ প্রশ্নে দ্বিমতের অবকাশ আছে কী? আর যদি অবকাশ না-ই থেকে থাকে, সে ক্ষেত্রে সংবিধানের সুস্পষ্ট বিধানের উপেক্ষা ও অবজ্ঞার বিষয়টি সুবিদিত।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট অনুষ্ঠানের দিন দিবসের কয়টা হতে কয়টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলবে তার বিশদ বিবরণ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এ উল্লেখ রয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দেখা গেল আনুষ্ঠানিক ভোটগ্রহণের দিবসের আগের রাতে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীরা প্রশাসন ও পুলিশের সহায়তায় ব্যালট পেপারে অগ্রিম সিল মেরে ভোটবাক্স পূর্ণ করে নিজেদের হেফাজতে রেখে দেন। এ ছাড়া ভোটগ্রহণের দিন কৌশলে ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ ঘটিয়ে গণনায় শামিল করে। এরূপ ভোটগ্রহণ পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। আর তাই নৈতিকতার উচ্চ শিখরে আরোহণকারী জাতির প্রতিনিধি বাংলাদেশস্থ জাপানি রাষ্ট্রদূতকে আক্ষেপ করে বলতে শোনা গেল- ‘ভোটগ্রহণের আগের রাতে ভোটের বাক্স ব্যালটে পূর্ণ করার ইতিহাস অন্য কোনো দেশের আছে কি না তার জানা নেই।’ তার এ উক্তি একটি দেশ ও জাতির জন্য কত যে লজ্জার ও অবমাননাদায়ক তা শুধু বিবেকবানরাই উপলব্ধিতে সক্ষম।
উপরিউক্ত তিনটি অনুচ্ছেদের আলোচনা হতে স্পষ্ট প্রতিভাত যে, নবম, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন সংবিধান ও আইনের ব্যত্যয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরূপ ব্যত্যয়কে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা জ্ঞাতসারে এড়িয়ে চললেও ভবিষ্যতে অনুকূল পরিস্থিতিতে এর সুরাহা সুবিধাভোগীদের কী ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলবে তা ভেবে অনেকে শঙ্কিত।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অত্যাসন্ন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অতীতের দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের মতো দলীয় সরকারের অধীন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনটি অনুষ্ঠানের বিষয়ে অনড়। অন্য দিকে, দেশের সাধারণ জনমানুষসহ মাঠের প্রধান বিরোধী দল ও এর অনুগামী দলসমূহ নির্বাচনটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠানের বিষয়ে অনড়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং দলটির অনুগত রাষ্ট্রপ্রধান বারবার সংবিধানের দোহাই দিয়ে নির্বাচনটি সংবিধানের বিদ্যমান বিধানাবলির অনুসরণে অনুষ্ঠানের বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বুলি আওড়ালেও দলটি ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় তাদের অধীন অনুষ্ঠিত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন যে সংবিধান ও আইনের সুস্পষ্ট বিধানের ব্যত্যয় ও লঙ্ঘনে অনুষ্ঠিত হয়েছে সে বিষয়ে নিরুদ্বেগ ও ভাবলেষহীন।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, ইতঃপূর্বে সংবিধানের অনুমোদনবিহীন কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচন এবং এ সরকারের কার্যকলাপ ও কর্মকালকে জনআকাক্সক্ষায় সংসদ কর্তৃক সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হলে সে বৈধতার বিষয়টি নিয়ে জনমনে কখনো কোনো ধরনের বিতর্কের উদ্ভব হয়নি। আর তাই পুনঃজনআকাক্সক্ষায় অত্যাসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনটি নির্দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হলে এর বৈধতা অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, কোনো ধরনের আইনি বেড়াজালে আবদ্ধ হবে না।
যেকোনো দেশের সংবিধান ও আইন জনআকাক্সক্ষা ও জনঅভিপ্রায়ে দেশ ও জনগণের মঙ্গল ও কল্যাণে প্রণীত হলে তা কখনো দেশের সচেতন জনমানুষকে বিভ্রান্ত ও বিচলিত করে না। কথাটি অনস্বীকার্য যে, আমাদের দেশের সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সন্নিবেশন দল মত নির্বিশেষে জনআকাক্সক্ষা ও জনঅভিপ্রায়ে হয়েছিল। আর তাই সন্নিবেশন পরবর্তী দেখা গেলো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল। সংবিধান হতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিয়োজন জনআকাক্সক্ষা ও জনঅভিপ্রায়ের বিপরীতে একক দলীয় সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতিতে হওয়ায় দেখা গেলো; বিয়োজন-পরবর্তী দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন একতরফা, প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন, ভোটারবিহীন, নিয়ম-শৃঙ্খলহীন এবং পেশিশক্তিতে বিলীন।
জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীন অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে জনমতের যে অবস্থান তা বিবেচনায় নিয়ে গণভোটের আয়োজন করা হলে অনেকটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় জনআকাক্সক্ষা ও জনঅভিপ্রায়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ভূমিধস সমর্থনে পুনর্ভাব হবে। সুতরাং একটি মীমাংসিত বিষয় নিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত ও বিচলিত না করে দেশের সার্বিক কল্যাণ ও মঙ্গল এবং স্থিতিশীলতা বিবেচনায় সবাই বিবেক দ্বারা তাড়িত হয়ে সময়োপযোগী ও সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন এটিই প্রত্যাশিত।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement