২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভিসানীতির বাস্তব প্রয়োগ দরকার

সময়-অসময়
-


বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কে বাইরের বিশ্বের সবাই জেনে গেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ভাবমর্যাদা এখন তাই তলানীতে ঠেকেছে। এর ফলশ্রুতিতে মার্কিন ভিসানীতি আরোপ হয়েছে। সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সরকারি ঘরানার বুদ্ধিজীবী ছাড়া দেশবাসী সবাই স্বীকার করছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন হয়েছে ভোটারবিহীন যার বাস্তবায়নে কারিগর দায়িত্ব পালন করেছে আমলারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নির্বাচন কমিশন ও সরকারি ঘরানার অতি উৎসাহী বুদ্ধিজীবীরাও এর সাথেই ছিল। এ ন্যক্কারজনক নির্বাচন পদ্ধতিকে বিশ্বের কেউ এখন সমর্থন করছে না। সব কিছু জেনেশুনেও বিচার বিভাগ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।
রক্তের অক্ষরে লেখা সংবিধান বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ও বিচার বিভাগের ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে তা পালনে ব্যর্থতা না অবহেলা এ বিষয়ে কথা বলা বা সমালোচনার আগে অবশ্যই তৎসময়ে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার প্রস্থান কতটুকু নির্মম ও অসাংবিধানিক তা বিবেচনায় নিতে হবে। সে কাহিনীও পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। সুপ্রিম কোর্ট অডিটোরিয়ামে এক ভাষণে গত ২১ মে তিনি বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতিকে নামিয়ে দিয়েছিলাম’। এটি সরকারের পক্ষ থেকে মেয়র মহোদয়ের দাম্ভিকতা অথবা সরল স্বীকারোক্তি না কি বর্তমান দায়িত্বরত বিচারপতি/বিচারকের প্রতি প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি, তা একটু চিন্তা করলেই প্রত্যেকের বিবেকের আয়নায় পরিষ্কারভাবে পরিস্ফূটিত হবে আশা করি।

মেয়রের বক্তব্য আদালত অবমাননাকর মনে করে ২৫ মে সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে শতাধিক আইনজীবী প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বটে, কিন্তু এ আর্টিকেল লেখা পর্যন্ত আপিল বিভাগের মতামত বা অ্যাকশন পাওয়া যায়নি। বিদায়ী নাটকে সরকার বলেছিল, বিচারপতি এস কে সিনহা ছিল একজন দুর্নীতিবাজ, যদি তাই হয় তবে একজন দুর্নীতিবাজকেই তো এই সরকার বাংলাদেশের সাংবিধানিক অভিভাবক তথা প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দিয়েছিল কোন স্বার্থে? অন্যদিকে বিচারপতি সিনহা নিজেকে ছাড়া রাজনীতিবিদ সবাইকে দুর্নীতিবাজ মনে করতেন বলে দুদক আইনের যত ফাঁকফোকর ছিল তা বন্ধ করে আইনটিকে একতরফাভাবে এমন শক্তিশালী করেছেন যাতে অভিযুক্ত সন্দেহাতীতভাবে দোষী প্রমাণিত না হলেও শুধু মনগড়া সন্দেহের ভিত্তিতে সাজা অবধারিত হয়, অথচ নিয়তির সে ভোগ উল্টো তার কপালেই সিলমোহর অঙ্কিত হয়েছে, কারণ ওই আইনেই তিনি এখন ১০ বছর সাজাপ্রাপ্ত।
ক্ষেত্র বিশেষে দুদক ভুয়া কাগজ তৈরি করে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে। এই কথা বিচারপতি সিনহা মানতে চাননি। দুদককেই তিনি ‘দুধে ধোয়া তুলসী পাতা’ মনে করতেন। সরকারের তাঁবেদারি তিনি কম করেননি, অথচ নিজের কুয়াতে (বিশুদ্ধ পানি সংরক্ষণের প্রাচীন পদ্ধতি) নিজেই পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন। প্রবাদ রয়েছে- কারো জন্য যদি কেউ গর্ত খোঁড়ে, সে গর্তে নিজেই পড়ে। মানি লন্ডারিং মামলায় তারেক রহমানকে খালাস দেয়া মাত্র সে বিচারক দুদকের নোটিশে এখন মালয়েশিয়া প্রবাসী। ফলে সংবিধান মোতাবেক দেশবাসী বিচার বিভাগ থেকে যা প্রত্যাশা করে তা পূরণ না হওয়ার পেছনে বর্ণিত উদাহরণ ও প্রেক্ষাপট অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে। শুধু আইন প্রণয়ন বা মুখভরা বুলি ছেড়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যাবে না। অবাধ গণতন্ত্রের অনুশীলন নিশ্চিত করার জন্য বিচার বিভাগের শক্ত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

সরকারি দলের সব অত্যাচার-অনাচার, জোর-জুলুম করে জমি, বাড়িঘর, ব্যবসায় দখলের প্রশ্রয়দাতা হচ্ছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ১৯ অক্টোবর ২০২০ নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ স্থানীয় ও জাতীয় নেতাদের উপস্থিতিতে আমার পৈতৃক বাড়িতে (জনতাভবন, রূপসী, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ) একটি সামাজিক অনুষ্ঠান চলছিল। ওই অনুষ্ঠানে যুবলীগ/ছাত্রলীগ দেশী-বিদেশী অস্ত্রে হামলা চালিয়ে অনুষ্ঠানটি পণ্ড করে দেয়। ওই দিন সন্ধ্যা ৬টায় দেশের প্রায় সব মিডিয়ায় এ সংবাদটি ফলাও করে প্রচারিত হয়। কিন্তু সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে রূপগঞ্জ থানায় ওসি ওই তারিখে রাত ৯টায় বলেছেন যে, ‘এ ধরনের কোনো ঘটনা আমরা শুনিনি’। এমনিভাবে সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া হওয়ায় শক্তি জোগাচ্ছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সরকারি দলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সময় পুলিশের চোখ তখন ‘কানা রোগে’ ভোগে।
সংবিধানের ৩৫(২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে- ‘এক অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তিকে একাধিকবার ফৌজদারিতে সোপর্দ ও দণ্ডিত করা যাবে না।’ অথচ একই ঘটনায় প্রতি জেলা থেকে একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে (যদি বিরোধী দলের হয়) ফৌজদারি মামলা হয়েছে। অথচ সরকারি দলের কেউ সম অপরাধ করলেও একটি মামলাও ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট আমলে নেয় না। সাংবিধানিক বিধি-নিষেধ জানা সত্ত্বেও আদালত অনুরূপ আইনকে অপপ্রয়োগ করছে। এ মর্মে জনগণ কি ধারণা করতে পারে? এটি কি আদালতের অসহায়ত্ব না দলীয়করণ? আদালত মানুষের শেষ আশ্রয়, সেখানে যদি পাবলিকলি দলীয়করণ প্রকাশ পায় তবে গণমানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে তো অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে, নাকি পারে না?
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন তাদের স্মারক নং-১৭.০০.০০০.০৩৪.৩৭.০০৫.২১-৫৯০, তারিখ : ৩০ নভেম্বর ২০২১ মোতাবেক নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) নির্বাচনী তফসিল মোতাবেক ১৬ জানুয়ারি ২০২২ সরকারি নগ্ন প্রভাবে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যাতে আমি স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ছিলাম। সম্প্রতি মার্কিন দূতাবাস তাদের ভিসানীতি ঘোষণা করে বলেছে, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনিক প্রক্রিয়ায় যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে তাদের মার্কিন দূতাবাস ভিসা দেবে না। গত নাসিক নির্বাচনে নিম্নবর্ণিত ঘটনাগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে কি না তা পাঠকের বিবেচনার জন্য উল্লেখ করা হলো :

১. ২০ ডিসেম্বর ২০২১ মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের পর জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ এবং পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম যৌথভাবে ডিসি অফিসে আমাকে ডেকে বললেন, কোনো প্রার্থীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবেন না এবং নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করবেন (আমার সাথে তখন উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামাল, বন্দর থানা বিএনপি সভাপতি হাজী নূর উদ্দিন এবং বন্দর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুল)। এ মিটিং করার কারণেই শোনা গেছে যে, জেলা প্রশাসককে বদলির আদেশ হয়েছে। সরকারি দলে নির্বাচনী আচরণ ভঙ্গের বিষয়ে আমি যে অভিযোগ করেছিলাম তার কোনো প্রতিকার তো করেনি; বরং উল্টো আমাকে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। ১৬ জানুয়ারি ২০২২ অর্থাৎ যে দিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে দিনই জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে হয়েছে।
২. নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবীর নানকের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সাথে সাক্ষাতের পর আমার ওপর খড়গ নেমে আসে। সেদিন রাতেই সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকায় আমার নির্বাচনী দায়িত্বপ্রাপ্ত মনিরুল ইসলাম রবিকে দু’টি মামলায় গ্রেফতার করে কারাবন্দী করে। নির্বাচনের পাঁচ-সাত দিন আগে থেকেই আমার সমর্থক ও সক্রিয় কর্মীদের গ্রেফতার অভিযান শুরু হয়। নির্বাচনের তিন দিন আগে নির্বাচনী কাজ শেষ করে আমার বাড়ি থেকে বের হওয়া মাত্রই সাদা পোশাকে ওঁৎপেতে থাকা পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। এজাহারে নাম না থাকা সত্ত্বেও গ্রেফতার করে, প্রতিবেদন দেয়, তাতে বলা, ‘মাসদাইর শেরেবাংলা রোড থেকে গ্রেফতার করা হয়।’ ওই ঠিকানায় আমার বসতবাড়ি অবস্থিত।

৩. বাংলাদেশের যেখানে নির্বাচন হয়েছে সব নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের দিন শিল্প-কলকারখানা, গার্মেন্ট বন্ধ থাকার সরকারি বিধান রয়েছে। যে বয়সে ছাত্ররাজনীতি করার কথা সে বয়সে আমি বিভিন্ন শ্রমজীবী সংগঠন গড়ে তুলি। আমি প্রত্যক্ষ করেছি, শ্রমজীবী খেটেখাওয়া মানুষই আমার বেশি সমর্থক। কলকারখানা অধিদফতর, নারায়ণগঞ্জের সূত্র মতে, নারায়ণগঞ্জ জেলায় চার শতাধিক কলকারখানা রয়েছে যার মধ্যে গার্মেন্টশিল্প অন্যতম। নাসিক এলাকায় ন্যূনতম ১৫০ (গার্মেন্টসহ) শিল্পকারখানা রয়েছে। আমি জেলা প্রশাসন ও নির্বাচন রিটার্নিং অফিসার মাহফুজা আক্তারকে নির্বাচনের দিন গার্মেন্টগুলো বন্ধ রাখার জন্য বারবার আবেদন করে ব্যর্থ হয়েছি। ভোট দেয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বে¡ও গার্মেন্ট শ্রমিকরা ছুটি পায়নি। ফলে তারা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। গার্মেন্টসহ অন্য কলকারখানা চালু থাকায় খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষকে নাসিক নির্বাচনে ভোট দানে বিরত থাকতে হয়েছে। গার্মেন্টসহ কলকারখানাগুলো নির্বাচনের দিন বন্ধ থাকলে তাদের ভোট আমি পেতাম বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

৪. নির্বাচনের দু’দিন আগে আমার বাড়ির আশপাশে সাদা পোশাকধারী ওঁৎপেতে থাকা পুলিশ নির্বাচনী কাজে ব্যবহৃত দুই গাড়ির ড্রাইভার আহসান ও আবু তাহের এবং মাইকিংয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত পরিবহন শ্রমিকনেতা জামাল হোসেনকে গ্রেফতার করে। আমার বাড়ি থেকে বের হওয়া মাত্র সাদা পোশাকধারীরা আহসান উল্লাহ ভূইয়া, মনির হোসেন, মন্তাজ, বোরহান ও মানিক চন্দ্র মণ্ডলকে গ্রেফতার করে হেফাজতে ইসলামের মামলায় (সিদ্ধিরগঞ্জ থানা মামলার নং- ১(৪)২১ এবং ২(৪)২১) গ্রেফতার করে। মানিক চন্দ্র মণ্ডল একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। হিন্দুরা হেফাজতে ইসলামের রাজনীতি করে না। তার পরও তাকে হেফাজতে ইসলামের মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারা আমার নির্বাচনী কাজের দায়িত্ব পালন করছিল।
৫. হেফাজতে ইসলাম রাজনৈতিকভাবে সভা করে মেয়র পদে আমাকে সমর্থন করায় হেফাজত নেতা মাওলানা ফেরদৌসুর রহমানকে নির্বাচনের আগের রাতে ধরে নিয়ে র্যাব অফিসে আটক করে রাখে।

৬. নির্বাচনের দু’দিন আগে থেকেই গ্রেফতারের জন্য আমার সমর্থকদের বাড়িতে অভিযান চালায়। নির্বাচনের দিন হাতি মার্কায় (আমার প্রতীক) ব্যাজ পরা কর্মীদের আটক করে এবং রাতে থানা থেকে ছেড়ে দেয়, যার অন্যতম যুবদলের প্রভাবশালী নেতা মনোয়ার হোসেন শোভন।
এ বিষয়গুলো তৎসময়েই আমি মিডিয়াতে বলেছি এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আমি জানতে চাই, নির্বাচন কমিশন/পুলিশ/প্রশাসনের বর্ণিত কর্মকাণ্ড নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রতিবন্ধক কি না? এ ধরনের পরিস্থিতিতে মার্কিন ভিসানীতি কি কার্যকর ভূমিকা রাখবে? গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বা নির্বাচনে আইনের অপপ্রয়োগ করে যারা জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে তাদের সম্পর্কে মার্কিন ভিসানীতির প্রয়োগ সম্পর্কে জনগণের সামনে একটি পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement