১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সমকালীন প্রসঙ্গ

ক্ষমতার লোভের রাহুগ্রাস

-

পণ্ডিত নেহরুর বিখ্যাত একটি বই পড়েছিলাম বহু আগে। তিনি যখন জেলখানায় ছিলেন তখন প্রিয় কন্যা ইন্দিরার কাছে নিয়মিত ইংরেজিতে চিঠি লিখতেন। ইন্দিরা তখন সম্ভবত মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রী। পণ্ডিত নেহরু তার চিঠিতে যেভাবে সারা দুনিয়ার ইতিহাস সুখপাঠ্য করে কন্যার কাছে বর্ণনা করেছেন এমনতর ইতিহাসের গল্প আমি কোথাও শুনিনি। ভারতবর্ষ-চীন-মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্ব ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য অংশ একটির সাথে অপরটির সংযোগ ঘটিয়ে তিনি যে চিঠিগুলো রচনা করেছিলেন তা পরবর্তীতে দ্য গ্লিম্পজেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি নামে সঙ্কলিত হয় এবং বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর দুনিয়ার পাঠক মহলে হইচই শুরু হয়ে যায়।
ব্যক্তিগত জীবনে আমি খুব মনোযোগী পাঠক বটে- কিন্তু আমার প্রধান অসুবিধা হলো- পঠিত বিষয় খুব সহজে ভুলে যাওয়া। কিন্তু পণ্ডিত নেহরুর বইটির কথামালা আমার হৃদয়ে এমনভাবে গেঁথে গেছে যা আমার চিরায়ত অভ্যাসের বিপরীত। পণ্ডিতের বইয়ের মতো আরো কয়েকটি বই আমার মনমস্তিষ্কে গেঁথে রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অ্যাডগার রাইস বারোসের টারজান দ্য অ্যাপম্যান, হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের গল্পমালা, মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম, হিরোডোটাসের দ্য হিস্টিরিয়া, মোহাম্মদ আসাদের রোড টু মক্কা, খুশবন্ত সিংয়ের দিল্লি কোম্পানি অব ওম্যান, মাওলানা শিবলী নোমানীর সিরাতে রসূল সা:, উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রাসহ আরো কিছু বই।

আমার জীবনে যত বই পড়েছি তার বেশির ভাগই ঐতিহাসিক ঘটনাসমৃদ্ধ নাটক-উপন্যাস-গল্প এবং নিরেট ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল। ইতিহাসের বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য- ইতিহাস কেউ মনে রাখে না এবং ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। তা না হলে- ক্ষমতার মসনদে বসে কেন সবাই একই ভুল করে। আমি বাংলার অন্তত এক ডজন শাসকের নাম জানি- যারা সবাই ছিলেন মহাপণ্ডিত। তাদের ছিল মস্তবড় লাইব্রেরি। নিজেরা নিয়মিত অধ্যয়ন করতেন এবং নিজেদের জ্ঞান ও গরিমা শানিত করার জন্য রাজদরবারে বড় বড় দেশী-বিদেশী পণ্ডিত, বিজ্ঞানী, ধর্মবেত্তা, সুফি সাধক, সঙ্গীতজ্ঞ এবং প্রকৌশলীদেরকে আমির ওমরাহের মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রীয় বেতন-ভাতার মাধ্যমে নিয়মিত পুষতেন। কিন্তু ভুল করার ক্ষেত্রে তারা সবাই প্রায় একই আচরণ করেছেন। তাদের সেই ভুলগুলো কেন হতো তা বোধগম্য করার জন্য হাল আমলের বাস্তব একটি উদাহরণ দিচ্ছি।
ঘটনাটি ২০১১ সালের। সংসদ লাইব্রেরিতে বসে পড়ছিলাম। আরো কয়েকজন সংসদ সদস্যও পড়ছিলেন। ঠিক এমন সময় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনও সেখানে এলেন এবং আমার ঠিক পাশের চেয়ারটিতে বসলেন। ভদ্রলোকের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কে টানাপড়েন চলছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে সামাজিক ভদ্রতা এবং ব্যক্তিগত সৌজন্য প্রদর্শনের কোনো ঘাটতি ছিল না। অধিকন্তু তিনি সত্যিকার অর্থেই একজন ভদ্রলোক এবং আপাদমস্তক সহনশীল প্রকৃতির মানুষ হওয়ার কারণে আমার অনেক নির্মম সমালোচনা সত্ত্বেও আমার সাথে দেখা হলে আগে সালাম দিতেন এবং হাসিমুখে করমর্দন করতেন। ঘটনার দিন তিনি আমার একটি নিবন্ধ পড়ছিলেন যা সেদিনকার দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পড়া শেষ হলে তিনি আমার হাতটি ধরে মৃদু চাপ দিলেন এবং বললেন, আমার মেয়ের জামাই আপনার খুব ভক্ত- আমার মেয়েও আপনার টকশো দেখে এবং আপনার প্রশংসা করে। আপনার লেখাটি পড়লাম এবং মনে হলো- ঠিকই লিখেছেন।
ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি কোনো কিছু না বলে হাসিমুখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি পুনরায় বললেন- বইরের জগৎ এবং ক্ষমতার অন্দরমহল এক নয়। আমরা যখন মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে বসি তখন কেন জানি মনে হয়- আমরা সঠিক আর আমাদের সমালোচনাকারী এবং বিরুদ্ধ পক্ষ ভুল পথে হাঁটছে।

সৈয়দ আবুল হেসেনের উল্লিখিত বক্তব্যটি যদি আপনি ধর্তব্যের মধ্যে আনেন তবে হোয়াইট হাউজ থেকে বাকিংহাম প্যালেস অথবা রিয়াদ রাজপ্রাসাদ থেকে আমাদের গণভবন অথবা বঙ্গভবন- সর্বত্রই একই চিত্র দেখতে পাবেন। ওসব স্থানে এমন কিছু হয় যা বাইরে থেকে অনুধাবন তো দূরের কথা কল্পনাও সম্ভব নয়। ক্ষমতার চেয়ারকে কেন্দ্র করে বড় বড় মৌচাক এবং মধু মাছিদের গুঞ্জনে আপনার মনে হবে- সারা দুনিয়ায় দুধ ও মধুর নহর প্রবাহিত হয়েছে। অন্যদিকে, মধুকুঞ্জের বাসিন্দারা দুধ ও মধু ছাড়া অন্য কিছুর কথা শোনা, অন্য কিছু দেখা অথবা অন্য কিছু বোঝার জন্য যে মনুষ্যজাত গুণাবলি দরকার তা হারিয়ে ফেলে লোভ-লালসা-কামনা-বাসনা-ভোগ-বিলাস ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হতে হতে একসময় নিজেদের ওপর স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ফলে ক্ষমতার লোভের রাহুগ্রাস তাদের কিভাবে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরে তার কিছু ভুবন কাঁপানো উদাহরণ পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু তার বইতে উল্লেখ করেছিলেন।
পণ্ডিত নেহরু জানতেন যে, ক্ষমতায় গেলে কোনো মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন আবার কিছু ক্ষমতাধর মানুষের জীবনে কেন ক্ষমতার কালো ছায়া বিস্তার করতে পারে না। তিনি হয়তো স্বপ্ন দেখতেন যে, অনাগত দিনে তার কন্যাও মস্তবড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হবেন এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে মনুষ্যত্ব, শিক্ষা-দীক্ষা এবং ক্ষমতার লোভ-লালসার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করবেন। এর জন্য তার লিখিত পত্রে তিনি মহাকালের মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জীবনের আশ্চর্যসব কাহিনী বর্ণনা করে প্রিয় কন্যাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন যার একটি উদাহরণ বর্ণনা করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না।

উত্তর ভারতে সম্রাট হর্ষবর্ধনের রাজদরবারে সভাকবি হিসেবে কবি বানভট্ট দীর্ঘদিন যাবত কর্মরত ছিলেন। সম্রাট হিসেবে হর্ষবর্ধনের খ্যাতি সুদূর চীন ও পারস্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর বানভট্টের কাব্য প্রতিভার খ্যাতি ছিল দুনিয়া জোড়া যা বিশ্বসাহিত্যের মহাকালের ইতিহাসের অন্যতম মাইলফলকরূপে আজও মানুষকে বিস্মিত করে। তার রচিত হর্ষচরিত পৃথিবীর নামকরা গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম। তো এতবড় বিখ্যাত কবি যার গুণের কাহিনী বলে শেষ করা যাবে না তার সাথে সম্রাট হর্ষবর্ধন কী আচরণ করেছিলেন তা শুনলে অবাক না হয়ে পারবেন না।
সম্রাট হর্ষ বানভট্টকে নিয়োগ দিয়েছিলেন রাজদরবারের দৈনন্দিন ঘটনাপঞ্জি, যুদ্ধের কাহিনী এবং তার সাম্রাজ্যের ইতিহাস রচনার জন্য। কিন্তু বানভট্ট ওসব কর্মের চেয়ে সম্রাটের গুণকীর্তন তোষামোদি ইত্যাদি করার জন্য অতিমাত্রায় উৎসাহী ছিলেন। যেহেতু কবির বুদ্ধির স্তর ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি, তাই বানভট্টের কৌশল বুঝতে সম্রাট হর্ষকে বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়। প্রকাশ্য রাজদরবারে সম্রাটের তোষণের জন্য বানভট্ট চৌকশ একদল চাটুকার জোগাড় করে ফেলেন এবং সারা দেশে প্রচার করতে থাকেন, সে সম্রাটের অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে এবং কাব্য প্রতিভায় তিনি দুনিয়ার সেরা কবি। এজন্য নিজে কবিতা লিখে তা সম্রাটের নামে প্রচার করতে থাকেন। বিষয়টি সম্রাটের নজরে আসে এবং তিনি প্রকাশ্য রাজদরবারে বানভট্টকে ভর্ৎসনা করে তাকে সভাকবির পদ থেকে বহিষ্কার করেন এবং রাজধানী ত্যাগ করার নির্দেশ দেন।
বানভট্টের বিরুদ্ধে উল্লিখিত ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করতে গিয়ে সম্রাট হর্ষবর্ধন যে যুগান্তকারী মন্তব্য করেছিলেন তা যদি যুগ যুগান্তরের রাজা বাদশাহরা স্মরণ করতেন, সে ক্ষেত্রে ক্ষমতার লোভের রাহুগ্রাস থেকে হয়তো মুক্তি মিলত। সম্রাট হর্ষ বলেছিলেন- শাসকের জন্য সবচেয়ে বিপদের কারণ হলো চাটুকার। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিপজ্জনক চাটুকার ছাড়া কোনো শাসক চলতে পারে না।
রাজা হর্ষবর্ধনের রাজত্বের সময়কাল ছিল ৬০৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৪৭ খ্রিষ্টাব্দ। তার জমানাতেই আল্লাহর রাসূল সা: মদিনা রাষ্ট্র কায়েম করেছিলেন। চীনে ছিল তাং সাম্রাজ্য আর সম্রাট ছিলেন লি উয়ান। পারস্যে ছিলেন দ্বিতীয় খসরু যিনি জন্ম নিয়েছিলেন ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে এবং ৫৯ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। অন্য দিকে রোমান সম্রাট ছিলেন হেরাক্লিয়াস। আজকের ইউরোপে তখন এমন কোনো রাজা বাদশাহ ছিলেন না যাদের নাম স্মরণ করা যেতে পারে। আর আমেরিকা কানাডা অস্ট্রেলিয়া তখন পর্যন্ত সভ্য দুনিয়া কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়নি। বিশ্ব ইতিহাসের সমসাময়িক প্রেক্ষাপট যদি আপনি বর্ণনা করেন তবে দেখতে পাবেন যে, বেশির ভাগ উত্তম শাসক সমসাময়িক এবং মন্দ শাসকরাও সামান্তরালভাবে একই সাথে জন্ম নেয় এবং দুনিয়াকে একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে বিষময় করে তোলে।

আমরা আজকের আলোচনার শেষ পর্যায় চলে এসেছি। এবার শিরোনাম সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলে নিবন্ধের ইতি টানব। ক্ষমতার লোভ সেসব শাসককে তাড়িত করে যাদের মধ্যে শাসক হওয়ার সত্যিকার গুণাবলিগুলো থাকে না। অতি নি¤œমানের শিক্ষা, নীচু স্তরের মনমানসিকতা, চরিত্রহীনতা, বিকৃত রুচি এবং পাশবিক আশা আকাঙ্খা দ্বারা তাড়িত শাসকরা সর্বদা লোভী হয়ে থাকেন। লোভী শাসকদের প্রধান লক্ষণ হলো তারা অযোগ্য প্রতারক, ঠকবাজ এবং চরিত্রহীন, দুর্নীতিবাজদের নিজেদের আমির ওমরাহ, পাত্র-মিত্র, বিচারক, সেনাপতি, কোতোয়াল বানিয়ে নেন। এ অবস্থায় বানভট্টের মতো ধড়িবাজ মেধাবীরা লোভী শাসককে ঘেরাও করে ফেলে এবং নানা রকম আকর্ষণীয় কথামালা দিয়ে লোভী শাসকের অযোগ্যতাকে ফুলাতে ফাঁপাতে শুরু করে এবং লোভী শাসককে জমিনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও ভয়ঙ্কর প্রাণীতে পরিণত করে ফেলে। এ অবস্থায় ক্ষমতালোভী মানুষের প্রজনন জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে এবং লোভের রাহুগ্রাস পুরো জাতিকে অস্তিত্ব সঙ্কটের মধ্যে ফেলে দেয়।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ৭ দিন স্কুল বন্ধের দাবি চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বিএনপি সাম্প্রদায়িক শক্তি, এদের রুখতে হবে : ওবায়দুল কাদের সাদিক এগ্রোর ব্রাহামা জাতের গরু দেখলেন প্রধানমন্ত্রী ভারতে লোকসভা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ সারা বিশ্ব আজ জুলুমবাজদের নির্যাতনের শিকার : ডা. শফিকুর রহমান মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও বোয়ালখালীতে ৩ জনের মৃত্যু গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়াল শ্যালকের অপকর্মে দুঃখ প্রকাশ করলেন প্রতিমন্ত্রী পলক রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

সকল