১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নতুন শিক্ষাক্রম : মাঠের বাস্তবতা

-


বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দেশের স্বাধীনতার পর থেকে গত পঞ্চাশ বছরে শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে-কারিকুলাম, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি-সময়ে সময়ে নানারকম পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু এবারের পরিবর্তন একেবারে আমূল পরিবর্তন বলেই মনে হচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষণ-শিখন এবং মূল্যায়ন পদ্ধতিতে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। ২০২২ সালে এই পদ্ধতির পাইলট প্রকল্প হিসেবে দেশব্যাপী ৬১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চালু করার পর এবার ২০২৩ সালে সারা দেশেই প্রথম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে। শিক্ষাবিদদের মতে, ধারণাগতভাবে এবং সময়ের বিবেচনায় নতুন শিক্ষাক্রম ভালো। কিন্তু ঠিকমতো বাস্তবায়ন করা না গেলে সেই ‘ভালো’ কতটা কাজে দিবে, সেটাই প্রশ্ন (মোশতাক আহমেদ, প্রথম আলো: ১৩/০৩/২০২৩)।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় দুর্বলতা হলো, পঞ্চাশ বছর পরেও আমাদের শিক্ষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর শেষ হচ্ছে না। এই পর্যন্ত আমরা জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে কোনো সমন্বিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারিনি। গত পঞ্চাশ বছরে সব সরকারই কিছু কিছু পরিবর্তন পরিবর্ধন বা সংস্কার করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু কোনো সর্বজনীন টেকসই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ফলে বারবার আসছে পরিবর্তন। এগুলো অনেকাংশেই জোড়াতালির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। স্বাধীনতার পর থেকে যথেষ্ট যুগোপযোগী না হলেও মোটামুটিভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ একটি স্থায়ী ব্যবস্থায় চলছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম। এরপর ১৯৯২ সালে মাধ্যমিকে চালু হয় বহুনির্বাচনী প্রশ্ন। তৈরি হয় প্রশ্নব্যাংক পদ্ধতি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এর সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। ২০০৮ সালে প্রশ্নব্যাংক পদ্ধতি বাতিল করে শুরু হয় এমসিকিউ এবং সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি। এরই মধ্যে ২০০১ সালে সনাতন পদ্ধতির ফলাফলব্যবস্থা বাদ দিয়ে ‘জিপিএ’ পদ্ধতিতে শ্রেণিভিত্তিক এবং পাবলিক পরীক্ষাসমূহের ফল প্রকাশ শুরু হয়। এতে পুরো জাতি ‘জিপিএ-৫’ এর পেছনে ছুটতে থাকল। বাড়তি কোচিং, শুধুমাত্র মুখস্থবিদ্যার অনুশীলন, ‘এমসিকিউ’-এ সহজেই শিক্ষার্থীদের শতভাগ নম্বর নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরির অদক্ষতা ইত্যাদিতে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা একটি ‘হযবরল’ অবস্থায় পড়ে গেল। তদুপরি ২০০৯ সালের পর থেকে কর্তৃপক্ষের ‘জিপিএ-৫’ এর সয়লাব বইয়ে দেওয়ার প্রবণতা পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেওয়ার উপক্রম করে ফেলে। এরই মধ্যে আবার ২০০৯ সালে পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে চালু করা হয় পাবলিক পরীক্ষা। এতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষকসহ সবার ওপর বাড়তি বোঝা চেপে বসে এবং কোচিং বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে যায়। ফলে দেখা গেছে, ৮৬ শতাংশের বেশি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে হতো। আর ৭৮ শতাংশ সরকারি বিদ্যালয়ে কোচিং ছিল বাধ্যতামূলক (প্রথম আলো : ১৩/০৩/২০২৩)। অবশ্য বর্তমানে ছোটদের এসব পাবলিক পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়ে জাতির বুকের ওপর থেকে জগদ্দল পাথর নামানো হয়েছে। এইভাবে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম বারবার অদূরদর্শিতার সাথে পরিবর্তন করা হয়েছে। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারেনি।

এমন প্রেক্ষাপটে ২০২৩ সাল থেকে আবারো একটি নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তিত হয়েছে। এই শিক্ষাক্রম পদ্ধতিগতভাবে অত্যন্ত আধুনিক, যুগোপযোগী এবং বিজ্ঞানভিত্তিক। এই পদ্ধতিতে মুখস্থ নির্ভরতা বাদ দিয়ে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন-শেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে। মূল্যায়ন পদ্ধতিও পরীক্ষা নির্ভরতার বদলে যোগ্যতাভিত্তিক করা হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এর সবই ভালো। তবে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে শিক্ষাবিদগণ মনে করেন। গত পাঁচ বছর ধরে এই শিক্ষাক্রম নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা এবং প্রস্তুতি চলছিল। তবে সেই প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম বিশেষজ্ঞ এবং উচ্চ পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল। মাঠ পর্যায়ে শুধুমাত্র গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে বিস্তরণ করা হয়েছে। ফলে মনে হচ্ছে, ২০২৩ সালে হঠাৎ করেই নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে। সার্বিক বিচারে মাঠ পর্যায়ের প্রস্তুতির অপ্রতুলতার কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকগণকে খুবই দ্রুততার সাথে মাত্র এক সপ্তাহের একটি প্রশিক্ষণকে পুঁজি করে নামতে হচ্ছে বাস্তবায়নে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় মনে হচ্ছে, একটু তাড়াহুড়াই করা হচ্ছে। শিক্ষাক্রমের বড় ধরনের পরিবর্তন। অবশ্যই বিভিন্ন সভা, সেমিনার, আলোচনা, প্রচারণা ইত্যাদির মাধ্যমে জাতির মননকে তৈরি করেই তবে দরকার ছিল বাস্তবায়নে যাওয়া। কিন্তু বাস্তবায়ন শুরু করার পরে অভিভাবকদের অবহিত করা ও প্রেষণা দেওয়ার কাজটি মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে করতে হচ্ছে। সেজন্য সব ক্ষেত্রেই বেশ তাড়াহুড়ার একটি প্রবণতা সব পর্যায়েই পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাড়াহুড়া করে কোনো ব্যবস্থাকে চাপিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু বাস্তবায়ন করা যায় না। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদেরও এই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরুর তিন মাস পর প্রশিক্ষণ ও মোটিভেশন দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সেই সাথে যোগ হয়েছে করোনা মহামারীর শিখন-ঘাটতি পূরণে যথেষ্ট পদক্ষেপের অভাব। করোনায় দেশের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর যে অপূরণীয় শিখন ঘাটতি ঘটেছে তাকে বিবেচনায় রাখা হয়নি বলে মনে হয় এই শিক্ষাক্রমে। কারণ, যে শিক্ষার্থীটি আজ ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে, সে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীতে মোটেই পড়তে পারেনি আর পঞ্চম শ্রেণীতে আধাআধি পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। তাই তাকে পূর্বের ঘাটতিতে রেখেই আমরা সম্পূর্ণ নতুন একটি পাঠব্যবস্থায় অবতীর্ণ করছি।

প্রতিষ্ঠানগুলোও এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নে শ্রেণিকক্ষের আসনব্যবস্থা কিঞ্চিৎ পুনর্ব্যবস্থাপনা করা দরকার। কারণ, দলগত কাজসমূহ সফলতার সাথে সম্পন্ন করতে বর্তমান বেঞ্চসমূহ ব্যবহার একটু দুরূহ হবে। তাছাড়া বেশ কিছু শিক্ষাউপকরণ প্রয়োজন হবে যা সবই সরবরাহ করা অনেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব হবে না। এমনকি অভিভাবকগণের জন্যও কষ্টকর হবে। তার ওপর মূল্যের ঊর্ধ্বগতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন কোন বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের বাইরে শ্রেণীভিত্তিক বিভিন্ন স্থাপনা বা কল-কারখানা পরিদর্শনের প্রয়োজন হতে পারে, যার ব্যবস্থা করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। তাছাড়া এই শিক্ষাব্যবস্থায় অভিভাবক, সমাজের স্থানীয় বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার সরাসরি জড়িত থাকবেন। কিন্তু তাদের যথেষ্ট মোটিভেশন বা অবহিতকরণের বিষয়ে ঘাটতি রয়েছে। এর সাথে শিক্ষকের ঘাটতি একটি বড় অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে। সাধারণত ২০ থেকে ৩০ জন ছাত্রের জন্য একজন শিক্ষক নিয়ে শিখন-পঠনের একটি আদর্শ শ্রেণি কক্ষ হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩৯ জনের জন্য একজন এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে প্রতি ৪২ জনের জন্য একজন শিক্ষক নিয়োজিত রয়েছেন (প্রথম আলো : ১৫/০৯/২০২১)। এর বাইরে শিক্ষকদের যোগ্যতা ও দক্ষতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে। শিক্ষকরাই হলেন বাস্তবায়নের মূল কারিগর। সাধারণভাবে তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তদুপরি মাত্র সাত দিনের একটি প্রশিক্ষণ তাদেরকে কতটুকুই বা দক্ষ করে তুলতে পারবে? পূর্বের চলমান ব্যবস্থায় সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে একটি সমীক্ষায় দেখা যায় ৩৮ শতাংশের বেশি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পুরোপুরিভাবে সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না (প্রথম আলো : ১৩/০৩/২০২৩)। আসলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উপেক্ষিত থাকার কারণে শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বাস্তব চিত্র অত্যন্ত করুণ। সাধারণত মেধাবীরা এই পেশায়- বিশেষ করে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত-কমই আসেন। অনেকেই শিক্ষাজীবন শেষে অন্য কোনো ভালো চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত একটি বিকল্প আশ্রয় হিসেবে শিক্ষকতায় আসেন। যোগ্য শিক্ষকদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলতে হয় : সাধারণভাবে অন্য কোথাও কোনো চাকরির সুবিধা করতে অপারগ হয়ে কেউ কেউ শিক্ষকতার পেশাটি বেছে নেন। অবশ্যই এর ব্যতিক্রমও রয়েছে, যারা সত্যিকারার্থেই শিক্ষকতার মহান পেশাকে ব্রত হিসেবে নিয়ে আসেন। তবে তাদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান লিখেছেন, ‘শিক্ষকতা পেশা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দাবি রাখলেও অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলে শিক্ষকতা পেশা ক্রমেই মেধাবীদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে’ (প্রথম আলো : ০৫/১০/২০২১)।

নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়নপ্রক্রিয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে অনেকেই মনে করেন। এখানে বিদ্যালয়ভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং সামষ্টিক মূল্যায়নের প্রক্রিয়া রয়েছে। বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্যায়নে আমাদের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। ২০০৬ সালে এই ধরনের প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল। ২০২২ সালে মাউশির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ছয় হাজার ৭৮৪টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ধারাবাহিক মূল্যায়নের রেকর্ড সংরক্ষণ করেছেন ৩৩ হাজার ৫১ জন শিক্ষক। আংশিক সংরক্ষণ করেছেন ৩৮ হাজার ৭১৪ জন, আর রেকর্ড সংরক্ষণ না করা শিক্ষকদের সংখ্যা ১৩ হাজার ৫৬৭ জন’ (প্রথম আলো : ১৩/০৩/২০২৩)। কাজেই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে ধারাবাহিক মূল্যায়ন একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা অনেক শিক্ষকেরই এই মূল্যায়নপদ্ধতি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। কেউ কেউ রয়েছেন ধোঁয়াশায়। অন্য দিকে সামষ্টিক মূল্যায়নের বিষয়েও এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট বা সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশিকা প্রতিষ্ঠানসমূহে পৌঁছেনি বলে জানা যায়। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নাই। শতভাগ মূল্যায়নই হবে শিখনকালীন ধারাবাহিক মূল্যায়ন। আর ৪র্থ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ৬০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে ধারাবাহিক এবং ৪০ শতাংশ হবে পরীক্ষার মাধ্যমে। নবম ও দশম শ্রেণীতে ৫০ শতাংশ করে উভয় পদ্ধতিতে এবং একাদশ ও দ্বাদশে ৩০ শতাংশ ধারাবাহিকভাবে এবং ৭০ শতাংশ পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। অর্থাৎ গড়ে বেশির ভাগ মূল্যায়নই হবে শিখনকালীন মূল্যায়ন। কাজেই সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের মূল্যায়ন দক্ষতা ও যোগ্যতা, মোটিভেশন এবং ডেডিকেশনের ওপরই অনেকটা নির্ভর করবে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতাভিত্তিক এই নতুন শিক্ষাক্রম সফল হওয়া বা করা।

নতুন শিক্ষাক্রমের বেশ কিছু চমৎকার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। পরীক্ষাভীতির পরিবর্তে আনন্দঘন পরিবেশে নির্ভার হয়ে শিক্ষার্থীরা পঠন-শিখন পরিচালনা করবে। তাদের পাঠ্যপুস্তকের অতিরিক্ত বোঝা কমবে। দৈহিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা ও সৃজনশীল কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং জীবন ও জীবিকাঘনিষ্ঠ শিক্ষা ও যোগ্যতা অর্জন করে শিক্ষার্থীরা বৈশি^ক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার উপযোগী নাগরিক হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়নে মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন রকম! আমরা জাতিগতভাবেই কোনো নতুন পদ্ধতির প্রতি প্রতিরোধক হয়ে থাকি। শিক্ষকরাও জাতির বাইরের অংশ নয়। সাধারণভাবে শিক্ষকদের মাঝে মোটিভেশনের অপ্রতুলতা রয়েছে। সবাই প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় পদ্ধতিটি সাধারণভাবে জটিল বলে মনে করছেন অনেকেই। এমনকি প্রশিক্ষণ প্রাপ্তরাও এখনো ভালোভাবে পুরো পদ্ধতি বুঝে উঠতে পারছেন না। অনেকেই আগের মতো করেই নতুন পাঠ্যক্রম পরিচালনা করছেন বলে জানা যায়। পাঠদান পদ্ধতি আগের চেয়ে একটু বেশি প্রস্তুতি বা কর্মসম্পাদনের দাবি রাখে বিধায় কেউ কেউ এটাকে কষ্টসাধ্য পদ্ধতি হিসেবেই মনে করছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটু ব্যয়সাপেক্ষও বটে। আগের পদ্ধতিতে সাধারণভাবে শিক্ষকগণ একই প্রস্তুতিতে যুগ যুগ ধরে ছাত্রদের পড়িয়েছেন। এখন নিত্যনতুন চিন্তা করা ও পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়ে পড়ছে যা সময়, শ্রম এবং ব্যয়সাপেক্ষ বলে তারা মনে করছেন। তাছাড়া তারা এসব নতুন পদ্ধতির মূল্যায়নপ্রক্রিয়া ঝামেলাযুক্ত বলে মনে করছেন। ইতোমধ্যেই বুঝা যাচ্ছে যে, নতুন শিক্ষাক্রম পুরোপুরি চালু হলে প্রাইভেট টিউশনি বা কোচিং হয়তোবা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশে শিক্ষকদের বেতন বা সম্মানী অত্যন্ত অপ্রতুল হওয়ায় অধিকাংশকেই প্রাইভেট টিউশনি করে সংসার চালাতে হয়। এমতাবস্থায় তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছেন! এই পদ্ধতিতে তাদের সংসার কিভাবে চলবে? অন্যদিকে বর্তমানে চলমান ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রদের অভিভাবকরা মনে করছেন, সন্তানদের কোনো পড়ালেখাই হচ্ছে না! সন্তানেরা বাসায় আগের মতো করে পড়া মুখস্থ করছে না বা বাড়ির কাজ লিখছে না। আবার পরীক্ষার জন্য তেমন কোনো তোড়জোড় না থাকায় অভিভাবকরা আরো ভীত হয়ে পড়ছেন! ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব সাধারণভাবে পড়ছে সমাজে। আরো একটা ভয় কাজ করছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে। অনেক অঞ্চলেই সাধারণত অভিভাবকরা বিদ্যালয়ের পাওনা পরিশোধ করতে বিলম্ব বা গড়িমসি করে থাকেন। কাজেই প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষও অপেক্ষা করেন কখন পরীক্ষা আসে। পরীক্ষার সময় সব পাওনা পরিশোধ করে তবেই শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসতে অনুমতি পায়। এভাবে বকেয়া আদায়ের সুযোগ নতুন শিক্ষাক্রম পদ্ধতিতে কমে যেতে পারে বলে অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছেন।
সার্বিকভাবে নতুন শিক্ষাক্রম অত্যন্ত আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত এবং জীবন-জীবিকাঘনিষ্ঠ হওয়ায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যুগান্তকারী ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। কিন্তু এটি বাস্তবায়নে আমাদেরকে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। কারণ, আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গনে মাঠের বাস্তবতা পুরোপুরি অনুকূলে নয়। কাজেই তাড়াহুড়ো না করে বা চাপিয়ে না দিয়ে বাস্তবতাসমূহ বিবেচনায় নিয়ে যথোপযুক্ত কৌশল নিয়ে অগ্রসর হলে নিষ্কণ্টক এবং সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। তখন এই নতুন শিক্ষাক্রমের সুফল দেশ ও জাতি পুরোপুরি ভোগ করতে পারবে।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email: maksud2648@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement