২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সামনে কোন মডেলের নির্বাচন?

-

কেবল সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নয়, সামনে একটি নতুন মডেলের নির্বাচন দেয়ার কথা বেশি বেশি করে বলা হচ্ছে সরকারের তরফে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের অবিরাম তাগিদের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দল ও সরকার থেকে বলা হচ্ছে- এ নিয়ে বিদেশীদের এত ভাবনার দরকার নেই। বাংলাদেশের নির্বাচন বাংলাদেশই করতে সক্ষম এবং সামনে তা-ই করা হবে।
সরকারের এমন আশ্বাসপূর্ণ ওয়াদার ভেতরের দিক নিয়ে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৮সাল পর্যন্ত মানুষ নির্বাচনের নানা মডেল দেখতে দেখতে ক্লান্ত। বিনাভোটে ১৫৪ জন এমপি হয়ে যাওয়ার মডেল মানুষ দেখেছে। আগের রাতে ভোট হয়ে যাওয়ার নির্বাচনের রেকর্ড বা মডেলও দেখেছে। এরও আগে হ্যাঁ-না ভোট, মিডিয়া ক্যুর ভোট তো আছেই। ১৫ ফেব্রুয়ারি মডেল, মাগুরা, মীরপুর মডেলও বাদ যায়নি। মাস কয়েক আগে হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মডেল। সামনে আর কী মডেল বাকি আছে? এ প্রশ্নের মধ্যে একটি ধারণা ছুঁড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ক ম জামাল উদ্দিন। তার নির্বাচন ছাড়াই আরেকটি সরকারকে নির্বাচিত করে ফেলার তত্ত্ব¡টি সরকারের দিক থেকে বাজারে ছাড়া হয়েছে, নাকি তিনি বলার জন্যই বলেছেন- এখনো তা স্পষ্ট নয়। বিনাভোটে নির্বাচন হতে পারলে বিনানির্বাচনেও নির্বাচন হতে পারে- এমন একটি বার্তা ও যুক্তি রয়েছে তার থিওরির মধ্যে। ব্যাপারটি বেশ ইন্টারেস্টিং।
নির্বাচন ছাড়া এ সংসদ ও সরকারকে আরো পাঁচ বছর টেনে নেয়ার ফর্মুলাটির পক্ষে ভেতরে ভেতরে অনেকের সায় আছে। সামনে আর ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন সম্ভব নয়, তা নিশ্চিত হয়ে একটি মহল এ ফর্মুলাটি এসিড টেস্টের মতো বাজারে ছেড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ক ম জামাল উদ্দিন তার ফর্মুলার মাধ্যমে একটি ধারণা দিয়েছেন মাত্র। ধারণাটি বাস্তবায়ন করা যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মহামারীর কারণ দেখিয়ে। প্রধানমন্ত্রী বা সরকারি দল চাইলেই জাতীয় সংসদে এই সংসদের মেয়াদ আরো পাঁচ বছরের জন্য বৃদ্ধি করা সম্ভব। আসন বিচারে সংসদে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়েও বেশি আছে সরকারের।

এমন তত্ত্বের সমর্থকরা বলতে চান, ২০১৪ সালে বিনাভোটে ১৫৪ জনকে জয়ী করা মানে একটি সরকার প্রায় গঠিত হয়ে যাওয়া। বাকি থাকে শুধু শপথ গ্রহণ। আচানক ধরনের ওই মডেল নিয়ে কিছুদিন সমালোচনা হলেও পরে সব ঠিক হয়ে যায়। বিএনপির তা মানা-না মানায় কিছু যায়-আসেনি। কেবল দেশের রাজনৈতিক দল নয়, বিদেশী শক্তিগুলো তা মেনে নিয়েছে। ওই মডেলে নির্বাচনের সরকারকে সমর্থনও দিয়েছে। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে, গ্যারান্টি দিয়ে বলা হয়েছে- বিনাভোটে এমপি হয়ে যাওয়ার মডেলের নির্বাচন আর হবে না। ঠিকই তা হয়নি। আগের রাতে ভোট সেরে ফেলার মডেল বা অভিযোগ যোগ হয়েছে। তাতেও সমস্যা হয়নি। আজ যেসব বিদেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছে, তারাও ওই নির্বাচনকে মেনে নিয়েছে। সরকারকেও সমর্থন দিয়ে এসেছে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিশ্চয়তা দিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানিয়ে বলছে, আগামী নির্বাচনে গেলবারের মতো আগের রাতে ভোট হবে না। এ রকম একটি পরিস্থিতির মধ্যে সরকার বলছে, আগামীতে মডেল নির্বাচন হবে বাংলাদেশে। সেই মডেলটি কী বা কী রকম হতে পারে- এ বিষয়ক কোনো ধারণা এখনো মিলছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সেখানে একটি টোকা দিয়েছেন মাত্র। সামগ্রিক অবস্থা যে জায়গায় চলে গেছে, সেখানে সরকার কী বলল, নির্বাচন কমিশন কী চাইল, আর বিরোধীদল কোন আশায় ঘুরছে তা আর ম্যাটার করছে না। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন এখন মোটাদাগের সাবজেক্ট হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ অনেকের দৃষ্টি এ নির্বাচনের দিকে। যুক্তরাষ্ট্র এতদিন বলেছে, তারা বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের অপেক্ষা করছে। এখন আর অপেক্ষার কথা বলছে না। জানিয়ে দিয়েছে, যারা সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দেবে তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদেরও যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে না। তাৎক্ষণিক জবাবে বাংলাদেশ থেকে বলা হয়েছে, এসবে বলার বা করার কিছু নেই। সরকার এ নিয়ে মাথা ঘামায় না।

কথার পিঠে কথার অন্তরালে আসলে দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। চলমান আন্দোলন ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অন্তরালে ঘুরছে নানা ছক-অঙ্ক। রাজনীতির সাথে কূটনীতির সঙ্ঘাতও ব্যাপক। রাজনীতি জিতবে না কূটনীতি জিতবে- এ ফয়সালা নিয়ে টানাটানি। বিশ্ব প্রেক্ষাপট তথা চলমান কোল্ড ওয়্যার দৃষ্টে স্থানিক রাজনীতি আর আন্তর্জাতিক কূটনীতির একটি কেমেস্ট্রি করার প্রক্রিয়া চলছে। রাজনীতি-কূটনীতি-অর্থনীতি মিলিয়ে দেশ এখন এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে। তার ওপর সরকার আর রাখঢাক না রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টাগ অব ওয়্যারে চলে গেছে। তা জেনে-বুঝেই করেছে সরকার। সামনে আরো স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে গুজব-গুঞ্জন তুঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রকে পাল্টা স্যাংশন দেয়া, তাদের সাথে কেনাকাটা না করার মতো হুমকির পর এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদেরও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে সতর্ক করা উচিত বলে বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণেও বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের সতর্ক করা উচিত বলে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। এর যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাস্তায় গোলাগুলি হয় না, কিংবা কেউ কাউকে মারে না। সেই বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ বা চলাফেরাও ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশ বিদেশী কোনো রাষ্ট্রের চোখ রাঙিয়ে কথা বললে ঘাবড়ে যায় না- এমন কঠিন কথাও বলেন তিনি। এর আগে, গোলমালটা বাধে ঢাকাসহ সারা দেশে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের সতর্কতার সাথে চলাফেরার পরামর্শ দিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাসের সতর্কতা জারি নিয়ে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ সতর্কতা জারি করা হয়। মার্কিন দূতাবাসের ‘ডেমোনস্ট্রেশন অ্যালার্ট’ শিরোনামে প্রচারিত হালনাগাদ করা ভ্রমণ সতর্কবার্তাটি দেয়া হয়। এতে বলা হয়- মার্কিন নাগরিকদের জন্য জারি করা ওই সতর্কবার্তা ঢাকা এবং বাংলাদেশের অন্য শহরগুলোর জন্যও প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারির আগে বা ওই সময়ে হওয়ার কথা রয়েছে। মার্কিন দূতাবাসের বার্তাটিতে বাংলাদেশ যেকোনো সময় সঙ্ঘাতপূর্ণ হয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এতে মার্কিন নাগরিকদের বড় সমাবেশ ও বিক্ষোভের স্থানগুলো এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হয়। মার্কিন বা যেকোনো দেশের এমন সতর্কবার্তা হোস্ট কান্ট্রির জন্য অপমানের। এমন অপমানের জবাব দিতে গিয়েই পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝেড়েছেন। এসবের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বর্তমান সরকারের সম্পর্ক এমন জায়গায় চলে গেছে, সেখান থেকে ইউটার্নের লক্ষণ সাদা চোখে দৃশ্যমান নয়। গোটা বিষয়টি চলে গেছে কূটনীতির সাবজেক্টে। ভূ-রাজনীতি, জাতীয় নির্বাচনসহ অভ্যন্তরীণ আরো নানা কারণে বাংলাদেশের দিকে এমনিতেই গত কিছু দিন ধরে গোটা দুনিয়ার দৃষ্টি। তার ওপর চলছে বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধ। এর মধ্যে সরকারকে ভীষণভাবে সহায়তাকারী কয়েকটি দেশও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকে কেয়ার না করলে কিছু হবে না- এমন সাহস দিচ্ছে চীন-রাশিয়াসহ কিছু দেশ। নির্বাচন প্রশ্নে সরকারকে উত্তর কোরিয়া মডেল বাতলে দেয়ার দেশী-বিদেশী শক্তিও গজিয়েছে।

উত্তর কোরিয়ার নির্বাচনকে দেশটিতে সুষ্ঠু-স্বাভাবিক, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক বলা হয়। সেখানে সংসদের নাম ‘সুপ্রিম পিপলস অ্যাসেমব্লি’-এসপিএ এবং এতে ভোটদান বাধ্যতামূলক। সরকারি তালিকার বাইরে এতে অন্য কোনো প্রার্থী বেছে নেয়ার সুযোগ থাকে না। অবাধে সেখানকার নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার শতভাগ। সরকার যে জোট তৈরি করে সেই জোটকেই সর্বসম্মতভাবে ভোট দেয়, দিতে হয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও কিম পরিবার বংশপরম্পরায় এই দেশটি শাসন করছে। শাসক পরিবার ও ক্ষমতাসীন নেতার প্রতি অবাধে আনুগত্য দেখায় জনগণ-প্রশাসনসহ সব মহল। তাদেরকে সেভাবে অভ্যস্ত করে নেয়া হয়েছে। সুষ্ঠু-সুন্দর, অংশগ্রহণ-সুশৃঙ্খলভাবে তারা কেবল ভোটই দেয় না, সরকারের সমর্থনে উল্লাস প্রকাশ করা উত্তর কোরীয়দের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এ দায়িত্বের প্রমাণ হিসেবে তারা কাকডাকা ভোরে ভোটকেন্দ্রে চলে যায়। বিশাল লম্বা লাইন ধরে।
ভোটকেন্দ্রে ঢুকে একটি মাত্র ব্যালটে একটি টিক চিহ্ন দিয়ে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে চলে যায় না। অন্যান্য ভোটারের সাথে মিলে আনন্দ প্রকাশ করে। কে ভোট দিতে যায়নি, সেটি ধরে ফেলার টেকনোলজি সরকারের কাছে আছে। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর উত্তর কোরিয়ার জনগণ উৎসবের সাথে এভাবে অবাধ-শান্তিপূর্ণ ভোট দেয়। আজব নিরপেক্ষ নির্বাচনের দেশটিতে কোনো বিরোধীদল নেই বা থাকে না- এমনও নয়। একাধিক বিরোধী দল বা জোট সরকারের ছকমতো ভূমিকা রেখে ধন্য হয়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement