২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ফসলের জাকাত বা ওশর

-

ইসলামী অর্থনীতি পুঁজিবাদ বা সম্পদের অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত বিকাশ কে সমর্থন করে না। আবার সমাজতান্ত্রিক আদর্শের শ্রমিকশ্রেণীর মালিকানার কথা বলে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত অসম অর্থনীতিকেও সমর্থন করে না। ইসলামী অর্থনীতি পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মাঝামাঝি ব্যক্তিমালিকানাকে স্বীকার করে অর্থের নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাকে বা সুষম বণ্টন সমর্থন করে। সে লক্ষ্যে ইসলামী অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত অর্থ ব্যবস্থা বা সুষম বণ্টন ব্যবস্থার জন্য জাকাত আদায়কে ফরজ হিসেবে ঘোষণা করেছে। পবিত্র কালামে পাকের একাধিক আয়াতে নামাজের বিধানের পরেই জাকাত আদায়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা জানি, হাদিস শরিফের বর্ণনা অনুসারে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্নিত, নবী করিম সা: মুয়াজ রা:কে (গভর্নর করে জাকাত আদায়ের জন্য) ইয়ামেনে পাঠালেন এবং তাকে বললেন, তুমি (প্রথম) তাদেরকে এ সাক্ষ্য দিতে বলবে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ্ নেই। এবং আমি (মুহম্মদ সা:) আল্লাহর রাসূল। যদি তারা এটাও মেনে নেয় তবে তাদের জানিয়ে দেবে আল্লাহ তাদের ওপর তাদের ধন দৌলতে জাকাত ফরজ করেছেন। তা তাদের ধনীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে গরিবদের প্রদান করা হবে (বুখারি)।
মহানবী সা:-এর যুগে সুনির্দিষ্টভাবে জাকাত আদায় করা হতো। মহানবীর ইন্তেকালের পর ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর রা: শাসনামলে স্বাধীনচেতা আরবরা জাকাত আদায় করতে অস্বীকার করে। হাদিস শরিফের বর্ণনা, হজরত আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সা: ইন্তেকালের পর এবং আবু বকর রা: খিলাফতের সময় আরবের কোনো কোনো কবিলা বা গোত্র কাফের হয়ে গেল। তখন (আবু বকর রা:) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সঙ্কল্প করলে ওমর রা: বললেন, আপনি কিভাবে লোকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবেন (যারা) কেবল জাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অথচ রাসূল সা: বলেছেন, আমি লোকদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য আদিষ্ট হয়েছি, যে পর্যন্ত না তারা বলে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ আর যে ব্যক্তি এটা বলল সে তার জান মাল আমার হাত হতে নিরাপদ করল। অবশ্য আইনের ব্যাপার স্বতন্ত্র এবং তার প্রকৃত বিচারের ভার আল্লাহর ওপর। তখন আবু বকর রা: বললেন, আল্লাহর কসম যে ব্যক্তি নামাজ ও জাকাতের মধ্য পার্থক্য করবে, আমি অবশ্যই তার বিরুদ্ধে জিহাদ করব। কেননা জাকাত হলো মালের হক। আল্লাহর কসম, যদি তারা আমাকে এরূপ একটি বকরির বাচ্চা প্রদানেও অস্বীকৃতি জানায় যা তারা রাসূল সা:কে প্রদান করত, তবে তাদের এ অস্বীকৃতির জন্য আমি অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। ওমর রা: বললেন, আল্লাহর কসম ব্যাপারটি এটি ছাড়া অন্য কিছু নয় যে, আবু বকর রা:-এর অন্তর বা হৃদয় আল্লাহ প্রসারিত করে দিয়েছেন। তখন আমি পরিষ্কার উপলব্ধি করলাম যে, নিশ্চয় এটিই সঠিক (বুখারি)। ইসলামের সেই সঙ্কট মুহূর্তে হজরত আব বকর রা: জাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে কঠিন হস্তে জাকাত আদায় করেছিলেন।

আমরা সমাজে ও রাষ্ট্রে সুস্থ ধারার অর্থনীতি বিকাশের কথা বলে থাকি। পুঁজির অবাধ বিকাশকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বুলি কপচিয়ে থাকি। অথচ ইসলাম প্রদর্শিত সুষম বণ্টন নীতির আলোকে অর্থনীতির বিকাশে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। জাকাত আদায়ের ব্যাপারে ইসলামী শরিয়তে রাষ্ট্রের ওপর দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারিভাবে ট্যাক্স বা কর আদায় করা হয়। অথচ আল্লাহ প্রদত্ত বিধানকে মেনে নিয়ে জাকাত আদায়ের বিষয়ে সরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। নামকাওয়াস্তে ইসলামী ফাউন্ডেশন ও প্রশাসনের মাধ্যমে সামান্য ঐচ্ছিক জাকাত আদায় করা হয়। অথচ জাকাত কোনো ঐচ্ছিক কর নয়। বরং তা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরজ বিধান। আমাদের সমাজে সাধারণ ধারণা প্রচলিত আছে যে, বার্ষিক আয়-ব্যয় হিসাব অন্তে কেবল নগদ অর্থ বা ব্যবসায়িক মুনাফার অর্থের শতকরা ২.৫০ ভাগ জাকাত প্রদান করা কর্তব্য। অথচ ইসলামী শরিয়তে ফসলের জাকাতকে ফরজ বা ওয়াজিব বলে ঘোষণা করা হয়েছে যে বিষয়ে বর্তমানে আমাদের সমাজে ধর্মীয় মাহফিলে বা অন্য কোথাও সামান্যই আলোচনা হয়ে থাকে।
আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে নির্দেশিত একটি ফরজ বা ওয়াজিব নির্দেশের বিষয়ে এমন মানসিকতা অত্যন্ত দুঃখজনক। ফসলের জাকাত আদায়ের লক্ষ্যে ইসলামী শরিয়তে ভূমিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১. ওশরী ভূমি ও ২. খারাজি ভূমি। পৃথিবীর আদি সম্পদ হলো ভূমি। মানুষ জন্মের পরই ভূমি উৎপাদিত দ্রব্যাদি দিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবন নির্বাহ করে থাকে। এমনকি একটি শিশু জন্ম গ্রহণের পর যে মাতৃ দুগ্ধ পান করে, সে দুগ্ধেরও পরোক্ষ জোগান দাতা ভূমি উৎপাদিত খাদ্য শস্য। তাই বলা যায়, ভূমি হলো মানব জীবন-যাপনের আদি ও অকৃত্রিম উপাদান। এ হতে বড় সম্পদ পৃথিবীতে আর হতে পারে না। পৃথিবীর ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্রীয় সঙ্ঘাতের মূল কেন্দ্র ভূমি। সম্পদের জাকাত হবে অথচ ভূমি উৎপাদিত পণ্যের জাকাত হবে না এটা কোনো যুক্তির কথা নয়। জাকাত আদায়ের বিধান অনুসারে ভূমি দুই ভাগে বিভক্ত। খারাজি ভূমি ও ওশরি ভূমি। মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিভুক্ত জমি ওশরি জমি হিসেবে বিবেচিত হবে। অমুসলিম সম্প্রদায়ের অধিভুক্ত জমি খারাজি জমি হিসেবে বিবেচিত হবে।

ইসলাম ভূমির ওপরে জাকাত নির্ধারণ না করে ভূমি উৎপাদিত ফসলের ওপরে জাকাত নির্ধারণ করেছে। কারণ এ পদ্ধতিতে মানুষের পক্ষে জাকাত আদায় করা সহজ হবে। ফসলের বৃদ্ধি হলে জাকাতের বৃদ্ধি হবে, ফসলের কমতি হলে জাকাতের কমতি হবে যা মানুষের পক্ষে আদায় করা সম্ভব। শরিয়তের বিধান মতে, পাঁচ ওসক বা চল্লিশ মণ ফসলের কোনো জাকাত নেই। প্রান্তিক আয়ের কৃষকদের জন্য আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে তাদের এ বিষয়ে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। চল্লিশ মণের ওপরে ফসল হলে তার ওপরে জাকাত দেয়া ফরজ। প্রাকৃতিকভাবে আকাশের বৃষ্টির সাহায্যে উৎপাদিত ফসলে শতকরা দশ মণ হারে জাকাত দেয়া ফরজ। কৃত্রিমভাবে সেচের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলে শতকরা বিশ মণ হারে বা এক শত মণে শতকরা পাঁচ মণ জাকাত দেয়া ফরজ। কোনো কোনো ইসলামী ফিকাহ্বিদদের মতে অত্যন্ত ব্যয়বহুল কৃষি উৎপাদনের জমিতে বিশেষ ক্ষেত্রে শতকরা ৪০ ভাগ হারে বা ১০০ মণে ২.৫০ মণ জাকাত দেয়া ফরজ।
অথচ আজকের সমাজ ব্যবস্থায় ভূমির জাকাতের বিষয়ে কোনো আলোচনা নেই। এমনকি জাকাতের আলোচনার বিষয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভূমির জাকাতকে আড়ালে রেখে দেয়া হচ্ছে। শরিয়তের বিধান পরিপূর্ণ আদায় করতে হলে ভূমির জাকাত আদায় করা অবশ্যই কর্তব্য। তাহলে সমাজে ও রাষ্ট্রে ইসলামী শরিয়তের বিধান প্রতিষ্ঠা হয়ে অর্থনৈতিক সুষম বণ্টন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হবে। জাকাত আদায় যেমন আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে ফরজ তেমনিভাবে জাকাত বণ্টনের ক্ষেত্রে ও পবিত্র কালামে পাকে আল্লাহপাক সুনির্দিষ্ট খাত বা বিধান জারি করেছেন। জাকাত প্রাপ্যতার দিক দিয়ে সর্ব প্রথম হকদার ফকির ও মিসকিন, অতঃপর সমাজের অন্যান্য দরিদ্র শ্রেণী। এভাবে জাকাত বণ্টনের খাতকে আট ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক জীবনে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করার লক্ষ্যে জাকাত আদায় করা অবশ্য কর্তব্য।
লেখক : গবেষক, কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement