২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আইএমএফে সরকারের দম : জনগণ যাবে কোথায়

-

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়াকে কৃতিত্ব ও গৌরব হিসেবে দেখছে সরকার। বলছে, ফেরত দেয়ার সক্ষমতা আছে জেনেই আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে, নইলে দিত না। সরকার সমর্থিত অর্থনীতিবিদদের অনেকেও জোর গলায় তা-ই বলছেন। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য সরকার আইএমএফের দ্বারস্থ হলে সংস্থাটি গত ফেব্রুয়ারি মাসে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করে। এই ঋণটি দেয়া হবে তিন বছর ধরে। ঋণের প্রথম কিস্তি চার কোটি ৫০ লাখ ডলার ইতোমধ্যে ছাড়ও করা হয়েছে। ঋণের জন্য আইএমএফের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি শর্ত দেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে আন্তর্জাতিক আইএমএফের দ্বারস্থ হওয়া বাংলাদেশের এবারই প্রথম নয়। আইএমএফের ঋণে কোনো দেশ উপকৃত হয় না; কথাটিও পুরোনো। এসব কথার বাস্তবতা আছে। উদাহরণ প্রচুর।
স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না থাকায় বিভিন্ন সময় তাদের কাছে ঋণ চাইতে হয়েছে। বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে প্রথমবার ঋণ নিয়েছিল ১৯৭৪ সালে। ঋণের জন্য সংস্থাটির কাছে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি গেছে ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালে। এই ১০ বছরে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে পাঁচবার অর্থ নিয়েছে।
যখনই বাংলাদেশকে তারা কোনো ঋণ দিয়েছে তখনই কিছু শর্ত বা পরামর্শ দিয়েছে। এসব শর্তের কিছু বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে আবার কিছু মেনে নেয়নি। ঋণের ক্ষেত্রে ১৯৯০ সালে আইএমএফের বেশ কয়েকটি শর্ত ছিল। সেসব শর্তের আলোকে বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর চালু করা হয়। এ ছাড়া বাণিজ্য উদারীকরণ, ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের শর্তও এসেছিল। এসব প্রক্রিয়ার সাথে বিশ্বব্যাংকও জড়িত ছিল।

ভ্যাট চালু করার পর প্রথম সাত থেকে আট বছর বেশ ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। বড় ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তখন বাংলাদেশের আমদানি পরিস্থিতির উন্নতি হয়। রফতানি বাণিজ্যেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তিও ব্যাপকভাবে যাওয়া শুরু হয়। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার তেমন একটা ঘাটতি ছিল না। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের ঋণ সহায়তার প্রয়োজন ছিল না। উল্লেখ্য, ১৯৯১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে কোনো ঋণ নেয়নি। বাংলাদেশ আবার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেয় ২০০৩ সালে। সেবার বড় শর্ত ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান কমিয়ে আনার। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে বাংলাদেশে লোকসানের মুখে থাকা পাটকল বন্ধ করা স্মরণীয় ঘটনা।
আদমজী জুটমিলের জায়গায় এখন আদমজী ইপিজেড। সেখান থেকে যে রাজস্ব আসছে, কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে, তা আদমজী জুটমিল থেকে পাওয়া যেত না। সর্বশেষ ঋণ নিয়েছিল ২০১২ সালে যার পরিমাণ ছিল প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। এখন দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে বড় রকমের ঘাটতিতে পড়ে আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। এবার বাংলাদেশ বেশ আগেভাগে আইএমএফের ঋণ চেয়েছে, শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশে হয়নি।
বরাবরই আইএমএফের দেয়া শর্তগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সরকারকে নিস্তার দেয়। আর নিদারুণ দুর্গতিতে ফেলে সাধারণ মানুষকে। ঋণ মঞ্জুরের আগেই সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমানো ও সুদের হার বাড়ানোর কিছু কাজ করিয়ে সরকারের সামর্থ্যরে প্রমাণ নেয়। আর নানান নীতি সংস্কার করায়। আইএমএফের প্রেসক্রিপশনের প্রধান উদ্দেশ্য, কোনো দেশকে সঙ্কট থেকে উদ্ধার করা নয়। তাদের অ্যাজেন্ডার মধ্যে প্রো-ক্যাপিটালিস্ট বায়াস থাকে। এর প্রভাবে মানুষের আয় বৈষম্য বাড়ে, ধনীদের সম্পদ অনেক বেশি বেড়ে যায়। আজকের ক্ষমতাসীনরা এক সময় এ কথাগুলো খুব আওয়াজ দিয়ে বলত। এক ধরনের ক্রেডিট নিত। ২০১২ সালের পর আর আইএমএফের ঋণ নিতেও যায়নি। কিন্তু, এবার অনেকটা উপায়হীন হয়ে এই ঋণ নিয়েছে।
তাদের ঋণে ভর্তুকি না দেয়ার মতো আর্থিক খাত সংস্কার, রাজস্ব বাড়ানোর শর্তও থাকে। এসবের মূল কারণ ঋণের টাকা যেন ঠিকমতো ফেরত পায়। কোনো দেশের অর্থনীতি ভালো হোক-খারাপ হোক ঋণের টাকা ফেরত পাওয়াই তাদের অগ্রাধিকার। আবার এ সত্যও তাদের জানা, কোনো দেশ বাধ্য হয়েই আইএমএফের ঋণ নেয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন রুখতে দেশগুলোর আর বিকল্প থাকে না।

আমদানির ওভার ইনভয়েসিং, রফতানির আন্ডার ইনভয়েসিং, রফতানি আয় দেশে না আনা এবং ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের অর্থ হুন্ডিতে পাচার হয়ে যাওয়ায় আমাদের বৈদেশিক অর্থভাণ্ডারে যে চাপ পড়েছে, তা রোখার আর কোনো সাধ্যও নেই সরকারের। এসব যেন প্রতিহত করা হয় সে ধরনের চাপ নেই আইএমএফের। তাদের অগ্রাধিকার অন্যদিকে। ওইসব দিক সামলাতে গিয়ে বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেলের দাম দফায় দফায় বাড়াচ্ছে সরকার। অবশ্য সরকার যেকোনো সময় এসবের দাম বাড়াতে পারবে- এ মর্মে বিধিবিধান করে নিয়েছে।
এবারের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণে সরকার আপাত স্বস্তিতে আছে। পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে দফায় দফায়। মূল্যবৃদ্ধির কারণে সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে। যন্ত্রণার পুরোটা জনগণের। ভর্তুকি কমানোর নামে জ্বালানি, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়টি তারা খুব কঠোরভাবে মনিটর করে কিন্তু দুর্নীতি কমাতে চাপ দেয় না। তার ওপর ভারতের শিল্পগোষ্ঠী আদানির সাথে বিদ্যুৎ চুক্তিতে কী আছে তা খোলাসা করা হচ্ছে না। দেশের জ্বালানি খাত পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। এ বিষয়েও আইএমএফের কোনো কথা নেই; বরং আন্তর্জাতিক পরিসরে বড় ব্যবসায়প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ রক্ষায় তাদের বদনামে নতুন করে প্রমাণ মিলছে।
বিভিন্ন দেশের ঋণের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ব্যাংক খাত, রাজস্বসহ অন্যান্য সংস্কারের কথা আইএমএএফ বলে। তবে সেগুলো বাস্তবায়ন না হলেও ঋণের কিস্তি বন্ধ হয় না। বড় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যায় এমন সংস্কার সরকার করতে না পারলেও আইএমএফের শর্ত পূরণে ভর্তুকি কমানোর মতো বিষয়গুলো বাস্তবায়নে ঢের সাফল্য দেখায়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকার এতে বেনিফিসিয়ারি। দায় সামলানোর ভাগ পুরোটা জনগণের। এরই মধ্যে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম দফায়-দফায় বাড়তি শোধ করছে। সামনে এসবের দাম আরো বাড়ানো হবে। জনগণ বাধ্য হবে বাড়তি টাকা গুনতে। দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। জিনিসপত্রের দামও অনেক বেড়েছে। মানুষ ভুগছে, আরো ভুগবে। এসবের জবাব চাওয়ার জায়গা পায় না জনগণ। প্রতিবাদেরও স্পেস নেই। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, নিয়মিত এ সবের চাঁছাছোলা জবাব দেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজেই। বিশ্বের নানান দেশ থেকে বাংলাদেশ কত ভালো আছে, তা জানান তিনি। অথচ এসব বিষয়ে জবাবের প্রথম-প্রধান দায়িত্ব অর্থমন্ত্রীর। তিনি এ সময়টায় একেবারে আড়ালে-আবডালে থাকেন। তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এখন কোনো প্রতিক্রিয়াও জানান না।

কেবল সাধারণ জনগণ নয়, ছোটখাটো ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদেরও কথা বলার জায়গা নেই। ব্যাংক ঋণের সুদহার বেঁধে রাখায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়প্রতিষ্ঠানগুলো চিড়াচ্যাপটার মতো পড়ে আছে। বড়রা কিন্তু কম সুদে সুবিধা হাতাচ্ছে। তেল, চিনি থেকে শুরু করে আমদানি পণ্যের দাম বাড়লেও তারা লাভবান যা সমাজে কেবল বৈষম্য বাড়ায়নি, সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ভারসাম্যের সর্বনাশ করে দিচ্ছে। একটি শ্রেণী অর্থসম্পদে ফুলেফেঁপে হাঙ্গর হয়ে উঠেছে। এবারের পরিপ্রেক্ষিতও ভিন্ন। তার ছাপ ছিল আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার কারণে ঋণের আবেদনের চিঠিতেও। জরুরি ভিত্তিতে লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রাখতে ও বাজেট সহায়তা বাবদ অর্থ চেয়ে গত বছরের জুলাইয়ে আইএমএফকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ এবং আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু করার অনুরোধ জানায়। আইএমএফ মিশন নিয়ে এসে সরকারি দফতরগুলোর সাথে বৈঠক করে ঋণ কার্যক্রম শুরু হয়। এখানে আরেকটি প্রশ্ন থাকছে। তা হলো, বরাদ্দকৃত এ টাকা কি সঙ্কট কাটানোর জন্য যথেষ্ট? এর কোন হ্যাঁ-না জবাব নেই। ছোট করে জবাব দেয়ার অবস্থাও নেই। তিন বছর ধরেই বৈশ্বিক দুই বড় ঘটনার প্রভাবে টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে দেশের অর্থনীতি। প্রথমে কোভিড-১৯ ও পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। উভয় কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। কমে যায় প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স)। তার ওপরে যোগ হয়েছে অভ্যন্তরীণ বহু কারণ। দেশে অনেক দিন ধরেই নীতিগত বিষয়গুলো ঠিক করা হয়নি। দেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে কিন্তু তা দেখা হয়নি। সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে হাতেগোনা কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী। তাদের কারণেই সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। একটি শ্রেণীর হাতে দেশের অর্থসম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়ায় তারা ফুলেফেঁপে উঠলেও সরকারের রাজস্ব বাড়ছে না; বরং প্রতি বছরই তা কমছে। সে কারণে জিডিপির অনুপাতে সরকারি ব্যয় কমে যাচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। ফলে আইএমএফ ঋণ ভোগ করবে সরকার কিন্তু ঋণের দায় শোধ করবে দেশের জনগণ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৪০ নিউইয়র্কে মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ফ্ল্যাট জব্দ করবে যুক্তরাষ্ট্র! টাঙ্গাইলে লরি-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষে নিহত ১ জিম্বাবুয়ে সিরিজে অনিশ্চিত সৌম্য

সকল