২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রোজা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায়

-


মস্তিষ্ক হলো শরীরের সবচেয়ে জটিল বুদ্ধিবৃত্তির জাদুর বাক্স : গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে ২০০-৪০০ বিলিয়ন তারকা বিদ্যমান আর মানব মস্তিষ্ক ৮৬ বিলিয়ন নিউরন কোষ দিয়ে তৈরি। এই ৮৬ বিলিয়ন নিউরন আবার এক হাজার ট্রিলিয়ন কানেকশন দিয়ে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে সারাক্ষণ কাজ করতে থাকে।
মানুষের মস্তিষ্ক তুলনামূলকভাবে শরীরের ওজনের অনুপাতে অন্যান্য সব প্রাণীর মস্তিষ্কের চেয়ে বড়।
মস্তিষ্কের মধ্যকার বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদানকালে তা গড়ে ২৬৮ মাইল প্রতি ঘণ্টায় অতিক্রম করে।
মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ প্রতি সেকেন্ডে অন্য নিউরন কোষে এক হাজার নার্ভ ইম্পালস পাঠাতে পারে। তাই মস্তিষ্ক হলো তাৎক্ষণিক চিন্তার এক বৈদ্যুতিক জেনারেটর যা ২৩ ওয়াট পরিমাণ ইলেকট্র্রিসিটিও জেনারেট করতে পারে।


মস্তিষ্ক কোষ জীবিত রাখার জন্য মস্তিষ্কে প্রতি মিনিটে ৭৫০ থেকে এক হাজার মিলিলিটার রক্ত ৪০০ মাইল বিস্তৃত রক্তনালীর মাধ্যমে প্রবাহিত করার দরকার হয়।
মানব মস্তিষ্কের ইনফরমেশন জমা রাখার ক্ষমতা অনেকটাই অসীম। মস্তিষ্ক ১০ (১৬) পরিমাণ কাজের প্রসেস প্রতি সেকেন্ডে করতে পারে। এর ক্ষমতা আইবিএম সেকোয়ার মতো শক্তিশালী কম্পিউটারের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বেশি বলে ধারণা করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ প্রতি মিনিটে গড়ে ৪৮.৬টি নতুন নতুন চিন্তা করতে পারে। সে হিসাবে প্রতিদিন মস্তিষ্ক ৭০ হাজার নিত্যনতুন চিন্তা তৈরি করে।
মস্তিষ্কের ৭৫ শতাংশই পানি। মস্তিষ্কের ৬০ শতাংশ শুধু ফ্যাট দিয়ে তৈরি অথচ এই ফ্যাট থেকে সরাসরি এনার্জি কাজে লাগাতে পারে না। শরীরের ২৫ শতাংশ কোলেস্টেরল থাকে মস্তিষ্কের ভেতর।


বিস্ময়কর বিষয় হলো, মানুষের ব্রেনে কাজ করার যত উদ্দীপনা জাগ্রত হয় তার প্রায় ৭০ শতাংশই অতিরঞ্জিত, একপেশে, ভয়াবহ ধরনের হয়ে থাকে। আবার এমনিভাবে মানুষের কাজের ৭০ শতাংশ কাজ গভীরভাবে চিন্তা করে নয়; বরং অবচেতন মনে করে থাকে। সুতরাং বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগানো ও নৈতিকতার কোনো বাধন না থাকলে মানুষ সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল করে বেশি।
মস্তিষ্কের শক্তি সঞ্চয় করে রাখার ক্ষমতা নেই বললেই চলে। কাজ করার জন্য ব্রেনকে পুরোপুরি রেডিমেইড এনার্জির ওপর নির্ভর করতে হয়। এই রেডিমেইড এনার্জি সাপ্লাই দেয় গ্লুকোজ। শরীরের অন্যান্য অর্গান যেমন- লিভার, মাংসপেশীর শক্তির জন্য গ্লুকোজ ছাড়াও আরো অনেক পথে শক্তি জোগানোর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ব্রেনের একটি মাত্র বিকল্প রাস্তা আছে আর সেটি হলো ফাস্টিং বা অন্য আরো কিছু কারণে কিটোন বডি তৈরির মাধ্যমে।
মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা সুপার কম্পিউটারকেও হার মানায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ সাধারণত তার মস্তিষ্কের ক্ষমতার মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করে। তার মানে মানুষ তার মস্তিষ্ককে খুব কমই কাজে লাগায়।


মস্তিষ্ক কোষের এনার্জির উৎস মূলত : গ্লুকোজ, বিকল্প উৎস একমাত্র কিটোন বডি : একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের বেঁচে থাকার জন্য দুই থেকে আড়াই হাজার কিলোক্যালরি তাপ দরকার। তবে এর ২০ শতাংশ ক্যালরি খরচ হয় মাত্র এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ গ্রাম ওজনের (পুরো শরীরের ওজনের মাত্র ২ শতাংশ) ব্রেনের নানাবিধ কাজের জন্য। প্রতি মিনিটে ৫.৬ মিলিগ্রাম গ্লুকোজ ও ৩.৫ মিলিলিটার অক্সিজেন দরকার হয় প্রতি ১০০ গ্রাম ব্রেন কোষের শক্তি জোগাতে। শরীরে বাহিত ২০ শতাংশ অক্সিজেন ও রক্ত প্রবাহ কেবল মস্তিষ্কের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। আমরা যখন বিশ্রামে থাকি, ঘুমন্ত থাকি ও চিন্তা করি তখন বরং ব্রেন, হার্ট, লিভার, ফুসফুস ও কিডনি ইত্যাদি ভাইটাল অর্গান সবচেয়ে বেশি এনার্জি খরচ করে। অথচ এই সময়ে মাংসপেশী ও হাড় সবচেয়ে কম এনার্জি খরচ করে। আবার মানুষ যখন দিবাভাগে নানা কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে তখন মাংসপেশী ও হাড়গুলো সবচেয়ে বেশি এনার্জি খরচ করে।


আমরা জানি, ব্রেনের শক্তি জোগানোর মূল উপাদান গ্লুকোজ। কোষে গ্লুকোজ ঢুকতে ইনস্যুলিন আবশ্যক। কিন্তু শরীরের এমন কয়েকটি স্পর্শকাতর টিস্যু এবং কার্যরত অবস্থা আছে যেখানে গ্লুকোজ কোষে ঢুকতে কোনো ইনস্যুলিন লাগে না। এগুলো হলো- ব্রেন, খাদ্যনালীর লাইনিং এপিথেলিয়াল কোষ, কিডনির টিউবিইউলের এপিথেলিয়াল কোষ, লোহিত রক্ত কণিকা, চোখের রেটিনা, চোখের লেন্স এবং শরীরচর্চারত মাংসপেশী ইত্যাদি। এই অবস্থার সুবিধা হলো- রক্তে পর্যাপ্ত গ্লুকোজ কিন্তু ইনস্যুলিন কম থাকলেও এই সমস্ত অর্গানের কোষগুলোর ভেতর গ্লুকোজ ঢুকে কাজ চালিয়ে যেতে সমস্যা হয় না।
ব্রেন এমনই একটি ব্যতিক্রমী অর্গান যার মূল খাবার গ্লুকোজ হলেও এর ব্রেন কোষে ঢুকতে যেমন ইনস্যুলিন আবশ্যক নয়, তেমনি ফাস্টিংয়ের সময়ে গ্লুকোজের অভাবে কাজ চালিয়ে যেতে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কিটোন বডি ব্যবহার করতে পারে অনায়াসে। আর কিটোন বডি তৈরির কাজটি লিভারে হয় মানুষ যখন লম্বা সময় ধরে ফাস্টিংয়ে থাকে তখন। এই কিটোন বডি রক্তের মাধ্যমে ব্রেইনে ঢুকে শক্তির জোগান দেয় যা গ্লুকোজের চেয়েও বেশি শক্তিশালী ও স্থায়ী। ফলে না খেয়ে থাকাবস্থায় একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্রেনের কাজ সাধারণ অবস্থার চেয়ে বেশি ভালো হয়।


মানুষ যখন চিন্তা ও গবেষণায় রত থাকে তখন ব্রেনে সবচেয়ে বেশি গ্লুকোজ খরচ হয়। খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, কোনো কাজ করলেন না, শুধু দুই-তিন ঘণ্টা মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাতেই অনেক ক্ষুধা অনুভূত হয়। যদি ফাস্টিংয়ের কারণে রক্তে গ্লুকোজের অভাবে ব্রেনের বিকল্প জ্বালানি ব্যবস্থা না থাকত, তা হলে মানুষ রোজা রেখে চিন্তা করে কোনো কাজ করতে পারত না। অথচ বিকল্প জ্বালানির উৎস কিটোন বডি থাকার কারণে ব্রেনের কাজ করতে সমস্যা তো হয়ই না; বরং আরো ভালোভাবে কাজ করতে পারে।
রোজার মাত্র ছয় ঘণ্টার মধ্যে শরীর মানব বৃদ্ধির হরমোন, গ্রোথ হরমোন বেশি নিঃসরণ শুরু করে। এই হরমোন প্রোটিন ব্যবহারের চেয়ে চর্বি পোড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। ফ্যাট বার্নিংয়ের কারণে ব্রেন স্বাভাবিক অবস্থায় গ্লুকোজ বার্ন করে যে এনার্জি পায়, রোজা অবস্থায় তার চেয়ে অনেক বেশি এনার্জি পায়।

যেভাবে মস্তিষ্ক বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করে : গ্লুকোজ উৎস থেকে ব্রেন শক্তি সংগ্রহ করতে পারে না রোজার কারণে। সে ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের এনার্জি মূলত ফ্যাটি এসিড থেকেই পাওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নেচারালি মস্তিষ্কে ফ্যাটি এসিড ঢুকতে পারে না। কিন্তু ফ্যাটি এসিড থেকে সৃষ্ট কিটোন বডি ব্রেনের শক্তি জোগায়।
ফ্যাট বার্নের সময় ফ্যাটি এসিড থেকে যে এসিটাইল কো-এ তৈরি হয়, তা গ্লুকোজ থেকে আসা অক্সালোএসিটেডের উপস্থিতিতে সাইট্রিক এসিড সাইকেলে ঢুকে শক্তি উৎপাদন করে। কিন্তু রোজা থাকার কারণে অনেক বেশি গ্লুকোজের অভাবে সাইট্রিক এসিড সাইকেলে ঢোকার জন্য যে পরিমাণ অক্সালোএসিটেড থাকা দরকার তা থাকে না। ফলে ফ্যাটি এসিড সাইট্রিক এসিড সাইকেলে ঢুকতে পারে না। কিন্তু এসিটাইল কো-এ সাইট্রিক এসিড সাইকেলে ঢুকতে না পেরে কনডেন্সড হয়ে লিভারে কিটোন বডিতে পরিণত হয়। এই কিটোন বডি লিভারে তৈরি হয় বটে কিন্তু লিভার তা ব্যবহার করতে পারে না। কিটোন বডি লিভার থেকে রক্তে চলে আসে। কিটোন বডি পানিতে দ্রবণীয় হওয়ার কারণে রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ঘুরে বেড়ায় এবং ব্লাড ব্রেন ব্যারিয়ার ক্রস করে সহজেই ব্রেনে ঢুকে পড়ে এবং এনার্জি দিতে থাকে যা গ্লুকোজের চেয়েও অনেক বেশি। ফলে ব্রেইন কোষগুলো ঠিকঠাক মতো বেশি বেশি কাজ করতে পারে।


একান্ত দায়ে না পড়লে প্রোটিন থেকে এনার্জি হয় না। যেহেতু রোজার কারণে তৈরি কিটোন বডি থেকেই মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত এনার্জি পেয়ে যায়, সেহেতু প্রোটিনগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোষ মেরামত ও মস্তিষ্ক-কোষের কার্যকারিতার উন্নতির জন্য ব্যবহৃত হয়। এখানে রোজায় ফ্যাটের যথাযথ ভূমিকার কারণে ব্রেনের ভেতর প্রোটিন তার নিজস্ব কাজ সেল রিপেয়ার ও অন্যান্য কাজ ঠিকমতো করতে পারছে। রোজা থাকাবস্থায় শরীরের খাদ্যনালী অন্যান্য অংশে কাজ কমে যাওয়ার কারণে ব্রেনসহ অন্য সমস্ত কোষের গারবেজ অপসারণ, রিপেয়ার ও রিজেনারেশনের কাজ বেশি হয়। ফলে ব্রেন নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে নতুন উদ্যমে কাজ করার ক্ষমতা পায়।
রোজায় চালু হওয়া অটোফেজিক কার্যক্রম রক্ত ও কোষের পরিশোধক হিসেবে কাজ করে। অটোফেজি প্রক্রিয়ায় সেল পরিষ্কারের কারণে ব্রেনে সেল টু সেল যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। এখানে রোজায় স্টিমুলেটেড হয়ে অতিরিক্ত উৎপাদিত বিডিএনএফ ডিমেন্সিয়া বা বৃদ্ধাবস্থার পাগলামি রোধ ও এজিং প্রসেজকে দেরি করায়। সুতরাং বিডিএনএফের নিউরোপ্রটেক্টিভ ভূমিকার কারণে রোজা রাখা মানুষ দীর্ঘায়ু সুবিধাও পেতে পারে। ব্রেনের হিপোক্যাম্পাসের প্রোটিন অ্যাক্টিভ থাকার কারণে রোজার মাধ্যমে লার্নিং ক্ষমতা, স্মরণশক্তি ও কাজে সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।


ফাস্টিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা : ফাস্টিংয়ের মাধ্যমে এপিলেপসির চিকিৎসা দুই শ’ বছরের প্রাচীন রীতি যা এখনো বিদ্যমান। স্বল্পকালীন উপবাস এলজেইমারস ডিজিজ, পারকিসন্স ডিজিজ ও হান্টিংটন্স ডিজিজের উন্নতি ঘটায়।
ব্রেন ক্যান্সারের চিকিৎসায় ফাস্টিং অবস্থায় কেমোথেরাপি দিলে তা ব্রেনের জন্য বেশি সহনীয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফাস্টিং নিউরোডিজেনারেশন ও ব্রেন ড্যামেজ দেরি করায়, স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর দ্রুত কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনে। ফলে স্ট্রোকের আশঙ্কা অনেক কমে যায়। তবে নিয়ম মেনে রোজা করলেই কেবল এসব উপকার পাওয়া যেতে পারে। সেই নিয়ম হলো- পুষ্টিকর খাবার ও পানীয় গ্রহণ, পর্যাপ্ত বিশ্রাম-ঘুম নিয়মিত শরীরচর্চা।
জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসাইন্সের অধ্যাপক মার্ক ম্যাটসন দীর্ঘদিন ফাস্টিংয়ের ওপর গবেষণা করছেন। তার গবেষণা ‘ঐড়ি ভধংঃরহম ংষড়ংি নৎধরহ ধমরহম’-এর মতে, আমাদের ব্রেন থেকে অন্তত চারভাবে রোজার উপকারিতা পেতে পারি।
ব্রেন সেল রিজেনারেশন করে, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক উন্নতিগত সুবিধা করে, নিউরোলজিক্যাল যোগাযোগ (সিনাপ্টিক কমিউনিকেশন) বৃদ্ধি করে ও এজিং প্রসেজ বিলম্বিত করে।
তিনি আরো বলেছেন, রোজা মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও মোড বাড়িয়ে তোলে, ঘুম ভালো হয়, এনার্জি ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। এর বিপরীতে অতিভোজন, ডায়াবেটিস এবং যেকোনো কারণে ইনস্যুলিন রেজিস্ট্যান্স মস্তিষ্কের বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রমকে দুর্বল করে।
লেখক : প্রজেক্ট ডাইরেক্টর, সিজেডএম কিডনি ডায়ালাইসিস অ্যান্ড ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার, শ্যামল বাংলা রিসোর্ট,
কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement