২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`
সমকালীন প্রসঙ্গ

রুচির দুর্ভিক্ষ এবং হিরো আলমের উত্থান

-

নাট্যজন মামুনুর রশিদের একটি মন্তব্য নিয়ে সারা দেশে রীতিমতো তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। সম্প্রতি অভিনয় শিল্পী সংঘের একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের নাটক-সিনেমা তথা সংস্কৃতি অঙ্গনের নামকরা ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশিদ মন্তব্য করেন যে, আমরা একটা রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি। সেখান থেকে হিরো আলমের মতো একটা লোকের উত্থান হয়েছে। যে উত্থান কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির, তেমনি আমাদের সাংস্কৃতিক সমস্যাও।
মামুনুর রশিদ বাংলাদেশের অত্যন্ত আলোচিত গুণী শিল্পী। শাসক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার পারিবারিক সম্পর্ক বহু দিনের। তার ছোট ভাই আওয়ামী লীগ জমানায় বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্বদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন। আওয়ামী লীগের কোনো কর্মের বিরোধিতা জনাব মামুনুর রশিদ করেছেন বলে আমি শুনিনি। বরং দল ও সরকারের সমর্থনে অনেক কর্ম করেছেন যা কি না তার সাম্প্রতিক বক্তব্যের সাথে বেমানান বলে তার সমালোচনাকারী মূলধারার গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে রীতিমতো মহা হইচই বাঁধিয়ে দিয়েছেন। আমি জনাব মামুনুর রশিদের বক্তব্যের যে অংশে তিনি রুচির দুর্ভিক্ষের জন্য রাজনীতির সমস্যা এবং সাংস্কৃতিক সমস্যা দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন তা নিয়ে যথাসাধ্য আলোচনা করার চেষ্টা করব।
আলোচনার শুরুতেই আমি নাট্যজন মামুনুর রশিদকে ধন্যবাদ জানাতে চাই তার আত্ম উপলব্ধির জন্য। একই সাথে হিরো আলমের উত্থানকেও স্বাগত জানাই। কারণ হিরো আলম-আরাভ-পাপিয়া-ক্যাসিনো-সংস্কৃতির যে রূপ, তা ফুটে উঠেছে। আমাদের আবহমান বাংলার চলমান রূপ মাধুর্য এখন আর মামুনুর রশিদ কিংবা আব্দুল্লাহ আল মামুন, আতিকুল হক চৌধুরী কিংবা আলী যাকের-আসাদুজ্জামান নূর প্রমুখের প্রতিভূ নয়। তারা যদি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি টুঁ শব্দ বর্তমান জমানায় করতেন তবে তাদের সংস্কৃতির প্রকৃত রুচি কতটা অরুচিতে রূপান্তরিত হতো তা ফুটিয়ে তোলার জন্য শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সাহায্য দরকার হতো।

হিরো আলমের উত্থান-আরাভকে নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ইত্যাদি যা কিছু কলি যুগে ঘটছে তার অন্তর্মূলে রাজনীতির বিকৃত রুচি যেমন দায়ী তেমনি পচা দুর্গন্ধময় রাজনীতির বর্জ্য ও বমন লেহনকারী তথাকথিত কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় নেতা, সাংবাদিক, আমলা-কামলা-ব্যবসায়ীরাও কম দায়ী নন। ক্ষমতার মসনদে বসে দুর্বৃত্তায়ন সব সমাজেই ছিল। কিন্তু যে সমাজ বা কাল দুর্বৃত্তায়নকে মেনে নিয়েছে সেখানেই সাধারণ মানুষের বোধ-বুদ্ধির ওপর মহামারী শুরু হয়ে গেছে।
আমি বিশ্বাস করি, শাসক দল আওয়ামী লীগের সব লোক ধড়িবাজ মতলববাজ কিংবা ফন্দিবাজ প্রকৃতির নিকৃষ্ট প্রাণী নন। দলের মধ্যে অনেক সুধিজন আছেন- কিংবা নতুন নতুন সুধিজন তৈরি হচ্ছেন যারা কি না বহু দিন পর হলেও অনুধাবন করতে পারছেন যে, রাজনীতির দুর্গন্ধে আমাদের জাতীয় বিবেক-বুদ্ধি এবং রুচিতে দুর্ভিক্ষের মড়ক লেগেছে। কাজেই সরকারের সুবিধাভোগীদের কেউ যদি ইতিবাচক কোনো কথা বলেন তবে তা ইতিবাচক অর্থেই গ্রহণ করা উচিত বলেই আমি মনে করি। কিন্তু সমস্যা হলো, দেশে রুচির দুর্ভিক্ষ যখন শুরু হয়ে যায় তখন বেশির ভাগ জনগণ ভালোমন্দের পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে না। তখন তাদের নিকট আদি মাল-পচামাল-রুই-কাতলা-চ্যাপা শুঁটকি অথবা পচা পটকা মাছের স্বাদ একই রকম মনে হয়। তাদের নিকট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, আয়েত আলী খাঁ, আকবর আলী খাঁ, পণ্ডিত রবি শংকর, বিসমিল্লাহ খাঁ, আল্লাহ রাখা খাঁ, জাকির হোসেন প্রমুখকে মেধা মননশীলতায় হিরো আলমদের চেয়েও হীনতর মনে হয়।
এখন প্রশ্ন হলো- জাতীয় সংস্কৃতি কী এবং সেই সংস্কৃতির রুচি কিংবা অরুচি অথবা বিকৃত রুচি কী। এ ব্যাপারে অতি সংক্ষেপে কিছু বলে তারপর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব- কিভাবে জাতীয় সংস্কৃতি বিকৃত এবং দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে পড়ে এবং সেই অঙ্গন থেকে কীটপতঙ্গ বের হয়ে আসে। সবশেষে বলব, কীটপতঙ্গের কামড়ে কিভাবে মানুষের রুচির অরুচি ঘটে যা কি না শেষ পর্যন্ত বিকৃত-বিকলাঙ্গ-অসার এবং নির্জীব হয়ে পড়ে।
আমরা কমবেশি সবাই জানি যে, একটি জাতির যা কিছু কল্যাণকর এবং যা কিছু নির্মল আনন্দের তাই সংস্কৃতি। জীবনের তাল-লয়-ছন্দ কম্পনে যখন প্রাণের স্পন্দন থাকে এবং সেই কম্পনের সাথে যখন সুর এবং রং লাগে এবং যা কি না অনুরণিত হয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশে আনন্দময়তা ছড়িয়ে দেয়, তাই সংস্কৃতি। সংস্কৃতির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দরতম অংশগুলো নিয়ে তৈরি হয় ঐতিহ্য। আমাদের জারি-সারি, যাত্রা পালা সঙ্গীত নৃত্যের শত শত বছরের স্বর্ণালী সৃষ্টি গল্প কবিতা, উপন্যাস, চিত্রপটের শত বছরের হৃদয় তোলপাড় করা অংশটুকুই সংস্কৃতির ঐতিহ্য। আমাদের গামছা-নেংটি-ধুতি-লুঙ্গি-শাড়ি-গয়না ইত্যাদি যেমন সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে তেমনি সেসব সংস্কৃতির মধ্যে যেগুলো অনাগত দুনিয়া স্মরণ করবে এবং ধারণ করতে গর্ব অনুভব করবে সেগুলোই সংস্কৃতির ঐতিহ্য।

সংস্কৃতির উদ্ভব হয় কল্পনা থেকে। সেই কল্পনার বাস্তবতা শুরু হয় সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে। সাহিত্য প্রতিষ্ঠা পায় শিক্ষার মাধ্যমে। কেবল উন্নত শিক্ষাই জীবনের মাধুর্যকে পাহাড়-নদী-সমুদ্রে ছন্দাকারে ছড়িয়ে দেয় এবং ছন্দময় জীবনের আনন্দই সংস্কৃতির রূপ নিয়ে প্রকৃতিতে সুর তোলে। অন্য দিকে অশিক্ষা-কুশিক্ষা দুর্গন্ধ ছড়ায় এবং সেই দুর্গন্ধজাত বিকৃত বিনোদন ও সংস্কৃতি কখনো ঐতিহ্য বলে বিবেচিত হয় না। ইতিহাস থেকে একটি ছোট উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। জাহেলিয়াত যুগে আরবের সংস্কৃতি ছিল মদ্যপান, হইহল্লা, উলঙ্গপনা, অবাধ ও যথেচ্ছ যৌনাচার, ধর্ষণ কিংবা পায়ুকাম। তো সেই সব আইয়ামে জাহেলিয়াতের সংস্কৃতিকে আরব জাতির ঐতিহ্য বলা হয় না। আরবের মরুভূমির বিশালতা, মরুবাসীর উদারতা, বীরত্ব মেহমানদারী এবং গল্প কবিতা উপন্যাসের সৌকর্যই হলো আরবীয় ঐতিহ্য।
উল্লিখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলা যায় যে, হিরো আলম, ড. মাহফুজ, দরবেশ, পাপিয়াকাণ্ড, শেয়ার লুট, ভোট চুরি, টাকা পাচার, জুলুম, অত্যাচার, গুম, হত্যা, অপহরণ, গ্রেফতার, মামলা, হামলা, চাঁদাবাজি, আয়নাবাজি, মদ, গাঁজা, ইয়াবা, প্রতারণা, জাল-জালিয়াত, মিথ্যাচার, অনাচার, জোচ্চুরি, তেলবাজি, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি, দখলদস্যুতা, ভণ্ডামি, মোনাফেকি, প্রভৃতি শব্দমালা সারা বাংলায় ততটা আলোচিত যা বই পুস্তকে লিখিত অন্য কোনো সুকুমার শব্দমালার সাথে তুলনীয় নয়। দেশের নামকরা সাংবাদিক অপহৃত হলো, সাহিত্যিক কবি মুক্তিযোদ্ধা আলেম ওলামা জুলুম অত্যাচারের শিকার হলো, না খেয়ে মরল কিংবা বিনা বিচারে জেল খাটল ইত্যাদি খবরের চেয়ে মানুষ যখন আন্তর্জাতিক পর্নো তারকা সানি লিয়ন ও নৃত্যশিল্পী নোরা ফাতেহীর বাংলাদেশ আগমন নিয়ে মাতোয়ারা হয় তখন সংস্কৃতির রুচি অরুচি বিকৃত কিংবা আবিকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় থাকে না।
আমাদেরকে ভাবতে হবে, কেন মানুষ অভিযুক্ত পলাতক খুনি রবিউলকে আরাভ খানরূপে পেয়ে সহানুভূতি আগ্রহ ও উদ্দীপনা প্রকাশ করে। কেন আরাভ খানের স্বর্ণের ঈগল অথবা বাজপাখি নিয়ে আলোচনা শুনতে চায়। আরাভ খানের অর্থ-বিত্তের উৎস সম্পর্কে অতিমাত্রায় উৎসুক হয়ে কেন লোকজন মাতোয়ারা হয়। মানুষের এই যে, বিবর্তন, সেটি কেন হলো কিভাবে হলো কার মাধ্যমে হলো সেসব বলতে গেলে বহু সময় লাগবে। সুতরাং অতি সংক্ষেপে যা বলা যায় তা হলো- মানুষ বুঝে গেছে- মিথ্যায় কাজ হয়, চোরও রাজা হতে পারে, প্রতারক সাধু সেজে মজা লুটতে পারে এবং অবিদ্যা দ্বারা বিদ্বানের মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটানো সম্ভব। মানুষ আরো বুঝে গেছে যে, বিখ্যাত হওয়ার জন্য শিক্ষার দরকার নেই, শ্রেষ্ঠত্বের জন্য দক্ষতা অভিজ্ঞতা সততা ন্যায়নিষ্ঠতা সাহস শক্তি বুদ্ধিমত্তার কোনো প্রয়োজন নেই। সব চেয়ে বড় চোর, চোরের সঙ্গী এবং অন্ধকারের রাতের কারসাজির অংশ হতে পারলে সব কিছু আলাদিনের চেরাগের মতো হাতে এসে যাবে। সুতরাং সমকালে যারা অবৈধ বিত্ত-বৈভব পরিচিতির অর্ধকর্তা তাদের অনুসরণ করে পরিশ্রমবিমুখ মানুষ সহজে সব কিছু হাসিল করার জন্য যে কর্মকাণ্ড করছে, তা যে চলমান সংস্কৃতি নয়, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

আমরা আজকের আলোচনার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। শুরুর দিকে নাট্যজন মামুনুর রশিদের বক্তব্যের একটি অংশ নিয়ে আলোচনা করব বলে কথা দিয়েছিলাম। তিনি রাজনীতির সমস্যার কারণে যে বিকৃতির উদ্ভব হয় বলে মতামত দিয়েছেন আমি তার সাথে একমত। কিন্তু তিনি সংস্কৃতির সমস্যার কথা বলতে গিয়ে অপশিক্ষা কুশিক্ষা ও কুসংস্কৃতি সম্পর্কে যে ইঙ্গিত দিয়েছেন তার সাথে আমি একমত নই। আমার মতে, জনাব মামুনুর রশিদ সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে এক করে ফেলছেন, যেভাবে বেশির ভাগ সমালোচনাকারী হিরো আলম, মামুনুর রশিদকে এক করে দেখতে শুরু করেছেন এবং মানুষের সেই বিভ্রাটটি শুরু হয়েছে অশিক্ষা ও কুশিক্ষা থেকে। সুতরাং বুদ্ধিবৃত্তিক মহামারীটা শুরু হয় দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার ক্রমাগত পতনের মাধ্যমে।
এখানে একটি কথা বলা অবশ্যক যে, শিক্ষা বলতে কেবল শিক্ষালয়ে গমন, বইপুস্তক পঠন এবং গলাধকরণকে বুঝায় না। বরং মানুষ তার পাঁচটি ইন্দ্রিয় দিয়ে যা দেখে শুনে অনুভব করে স্পর্শ করে আঘাত পায় এবং সর্বোপরি যা পাওয়ার জন্য কসরৎ করে তাও শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং গত এক যুগে কী দেখেছি কী খেয়েছি কী শুনেছি কী পেয়েছি কী হারিয়েছি- ইত্যাদি স্মরণ করে আমাদের দেহ মন মস্তিষ্কতে যে কাম ক্রোধ উৎসাহ উদ্দীপনা রাগ অনুরাগ হতাশা জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয় তাও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিরাট অনুসর্গ। সুতরাং সেই সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার উপজাত সমাজ সংসার দেশ জাতিকে যেভাবে গ্রাস করেছে তার জন্য কোনো একক ব্যক্তিকে দায়ী না করে বরং সমস্যার শুরুটা যে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নে শুরু হয়েছিল- সেখানে সাহস করে আঘাত না করা পর্যন্ত শিক্ষা সংস্কৃতির উপজাত বমনের হাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement
‘প্রত্যেককে কোরআনের অনুশাসন যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে’ মতলব উত্তরে পানিতে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের শেষ ধাপের পরীক্ষা শুক্রবার লম্বা ঈদের ছুটিতে কতজন ঢাকা ছাড়তে চান, কতজন পারবেন? সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩

সকল