২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

দীর্ঘমেয়াদি কোমর ব্যথায় করণীয়

-

কোমর ব্যথা সারা বিশ্বেই জনস্বাস্থ্যের জন্য এক বিরাট হুমকি। জীবনে একবারও কোমর ব্যথায় ভোগেননি এমন মানষ খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। আগে ভাবা হত কোমর ব্যথা উন্নত বিশ্বের একটি রোগ এবং যারা বসে কাজ করেন বা ভারী কাজ করেন শুধু তাদেরই কোমর ব্যথা হয়। কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল ল্যানচেটের গবেষণা বলছে, গত দশকে নিন্ম ও নিন্ম-মধ্যবিত্তের দেশগুলোতে কোমর ব্যথার প্রাদুর্ভাব আগের থেকে কয়েক গুণ বেড়েছে এবং এশিয়া ও আফ্রিকার নিন্ম ও নিন্ম-মধ্যবিত্ত দেশগুলো কোমর ব্যথা রোগের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হচ্ছে। প্লাস ওয়ান জার্নাল, এনালস অব মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি জার্নাল এবং জার্নাল অব অকুপেশনাল হেলথে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণাপত্র থেকে জানা যাচ্ছে বাংলাদেশে প্রায় প্রতি ২.৫ জন মানুষের মধ্যে একজন কোমর ব্যথাজনিত সমস্যায় ভোগেন। বিপুলসংখ্যক মানুষ যেমন কোমর ব্যথায় ভোগেন, ঠিক তেমনই এই সমস্যার চিকিৎসা খরচও অনেক বেশি। কোমর ব্যথার কারণে সারা পৃথিবী বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়।
কোমরব্যথা সাধারণত তিন ধরনের- স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। যে ব্যথার বয়স তিন মাস বা তার বেশি তাকে সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা বলে এবং কোমর ব্যথার বেশির ভাগ রোগীই দীর্ঘমেয়াদি ব্যথায় ভোগেন।

কী চিকিৎসা আছে
কোমর ব্যথা বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি কোমর ব্যথার চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল। এই ধরনের ব্যথার জন্য বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের চিকিৎসা প্রচলিত আছে। তবে নিরঙ্কুশভাবে কাজ করে এমন কোনো একক চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি কোমর ব্যথা ভালো করতে পারে না। তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এই ধরনের ব্যথার চিকিৎসায় পারসোনালাইজড চিকিৎসা ও সমন্বিত চিকিৎসার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

পারসোনালাইজড চিকিৎসা কী
আমরা সবাই জানি, আমাদের প্রত্যেকের আঙুলের ছাপ ভিন্ন। একজনের ফিঙ্গার প্রিন্ট বা আঙুলের ছাপের সাথে যেমন অন্যজনের ছাপের মিল নেই ঠিক তেমনি একেক জনের ব্যথা একেকভাবে শরীরে বাসা বাঁধে এবং তা ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। এখন বিভিন্ন শারীরিক, প্যাথলজিক্যাল ও রেডিওলোজিক্যাল পরীক্ষা ও রোগীর সাক্ষাৎকার গ্রহণের পর ব্যথার ধরন নির্ণয় করে যে চিকিৎসা দেয়া হয় সেটাই পার্সোনালাইজ চিকিৎসা। এ ক্ষেত্রে একেক জনের চিকিৎসা হয় একেক ধরনের। যেমন; অনেক রোগী আছেন যাদের বসার চেয়ার পরিবর্তন করে কয়েকটি বিশেষায়িত ব্যায়াম করলেই ব্যথা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে; আবার অনেকের প্রয়োজন হয় ইলেট্রোথেরাপির। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাইফস্টাইল মোডিফিকেশন বা জীবন ধারায় পরিবর্তন প্রয়োজন হয় ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে। এমনই ভিন্ন ভিন্ন চিকিৎসা ভিন্ন ভিন্ন রোগীর জন্য প্রয়োজন হয়, আর এর সবকিছুই নির্ভর করে রোগ নির্ণয়ের ওপর।

বাংলাদেশে এর চিকিৎসা কেমন
বাংলাদেশে কোমর ব্যথার চিকিৎসা মূলত ব্যথার ওষুধ বা পেইন কিলার-নির্ভর। এ দেশে পেইনকিলার যাকে অনেকে পেইন কিলিয়ার বা ব্যথা পরিষ্কারক নামে ডেকে থাকেন; তা খুবই জনপ্রিয়। ব্যথা হলেই রোগীরা ফার্মেসিতে গিয়ে ব্যথানাশক কিনে এনে খেতে থাকেন। সাধারণত ব্যথার ওষুধ কাজ না করলে রোগীরা চিকিৎসকের কাছে যান। তবে বাংলাদেশে কোমর ব্যথার চিকিৎসায় চিকিৎসকরা মেনে চলবেন এমন ধরনের কোনো নীতিমালা নেই। এ দেশে তাই কোমর ব্যথার চিকিৎসা বিভিন্নভাবে করা হয়। অনেক চিকিৎসক ব্যথার ওষুধ বা এনএসআইডি, গ্যাবাজেরিক, মাসল রিল্যাক্সেন্ট ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে থাকেন। অনেকে সার্জারির ওপর জোর দেন। অনেকে মেশিনের মাধ্যমে ফিজিওথেরাপি, ম্যানুয়াল থেরাপি বা থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কোমর ব্যথা ভালো করতে চান। ২০২২ সালে প্রকাশিত ফিজিওথেরাপি প্র্যাকটিস অ্যান্ড রিসার্চ জার্নালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে কোমর ব্যথার জন্য যেসব চিকিৎসাপদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, উন্নত বিশ্বে তা প্রায় সম্পূর্ণ অচল। এর ফলে কোমর ব্যথা রোগীরা উপকার তো পানই না বরং অনেক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন।

বিশ্ব পরিস্থিতি ও আমাদের সম্ভাবনা
বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটেছে। মানুষের উন্নত ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার প্রতি আগ্রহও বাড়ছে খুব দ্রুত। বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত হয়েছে বটে কিন্তু তা মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। সত্যি কথা বলতে, যারা উন্নত ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা চান তারা এদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর এখনো পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছেন না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেক চিকিৎসকই দীর্ঘমেয়াদি কোমর ব্যথার চিকিৎসায় সারা বিশ্বে অচল শর্ট ওয়েভ বা মাইক্রোওয়েভের মতো মেশিন দিয়ে চিকিৎসা করতে চান, যা রোগীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। এ ছাড়াও রোগ নির্ণয় না করেই নানা ধরনের অবৈজ্ঞানিক ব্যায়াম বা ম্যানিপুলেশন করে থাকেন অনেকেই। অনেকে আবার বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটারাইজড মেশিনভিত্তিক চিকিৎসা করে রোগী ভালো করতে চান যার কোনোটিই বিজ্ঞানসম্মত বা পারসোনালাইসড চিকিৎসা বলে পরিগণিত হয় না। এই সব কারণেই প্রতি মাসে বিপুল সংখ্যক রোগী বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চলে যান উন্নততর চিকিৎসার আশায়।

সরকারের করণীয় কী
অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা তো বটেই অনেক স্বল্পোন্নত দেশেও কোমর ব্যথার চিকিৎসা চলে সরকার অনুমোদিত নীতিমালার মাধ্যমে। এই সব নীতিমালা সাধারণত প্রস্তুত করা হয় ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়াল ও নির্ভরযোগ্য গবেষণার মাধ্যমে। এই নীতিমালাগুলো রোগীর স্বার্থ রক্ষা করে। কম খরচে সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা সাধারণত নীতিমালায় অনুমোদন পায় এবং চিকিৎসকরা এই নীতিমালার মধ্যে থেকেই চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে এই ধরনের নীতিমালা এখন সময়ের দাবি। দীর্ঘমেয়াদি কোমর ব্যথার রোগীরা যাতে ব্যবসার উপকরণে পরিণত না হন এবং তাদের শারীরিক ও আর্থিক স্বার্থ যাতে রক্ষা হয় সেদিকে খেয়াল রেখে বাংলাদেশ সরকারের উচিত নীতিমালা প্রণয়ন করা। সেই সাথে কোমর ব্যথা চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের উন্নত চিকিৎসা প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন যাতে তারা তাদের রোগীর জন্য সেরা চিকিৎসাটা বেছে নিতে পারেন।

রোগীরা এখন কী করবেন
রোগীদের সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশেও অনেক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। যথাসম্ভব একজন দক্ষ চিকিৎসক নির্বাচন করে তার পরামর্শ মতো চিকিৎসা নিতে হবে। যত্রতত্র ক্ষতিকর ব্যথানাশক ওষুধ, অবৈজ্ঞানিক ব্যায়াম, মেশিনের চিকিৎসা ও ম্যানিপুলেশন করা যাবে না। ইদানীং অনেকেই ইউটিউব দেখে নিজেই নিজের চিকিৎসা করা শুরু করেন যা বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই এসব ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
লেখক : কনসালট্যান্ট, ফিজিওথেরাপি বিভাগ, উত্তরা
আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
hprc2005@live.com


আরো সংবাদ



premium cement