২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

কৃচ্ছ্রতা, সংযম ও আত্মশুদ্ধির মাসে বৈপরীত্য

-

সংযম সিয়াম সাধনার একটি অন্যতম পূর্বশর্ত। নির্ভেজাল এবং পারস্পরিক কল্যাণ ও সমঝোতার ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যবসায় বাণিজ্যকে ইসলাম গুরুত্বসহকারে শুধু অনুমোদনই করে না; বরং সে ব্যবসায় বাণিজ্য পরিচালনাকে কল্যাণকর আখ্যা দিয়েছে। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা: বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, সর্বাপেক্ষা পবিত্র রোজগার হচ্ছে ব্যবসায়ীদের রোজগার। তবে শর্ত হচ্ছে, তারা যখন কথা বলবে তখন মিথ্যা বলবে না। কোনো আমানতের খেয়ানত করবে না। কোনো পণ্য ক্রয় করার সময় সেটাকে মন্দ সাব্যস্ত করে মূল্য কম দেয়ার চেষ্টা করবে না। নিজের মাল বিক্রয় করার সময় সে মালের অযথা তারিফ করে ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করবে না। তার নিজের কাছে অন্যের ধার থাকলে পাওনাদারকে অযথা ঘুরাবে না। অপর পক্ষে, সে কারো কাছে কিছু পাওনা হলে তাকে উত্ত্যক্ত করবে না।’ বস্তুত যেসব ক্ষেত্রে ব্যবসার নামে সুদ, জুয়া, ধোঁকা-প্রতারণা ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে অন্যের সম্পদ হস্তগত করা হয়, সেসব পন্থায় সম্পদ অর্জন করা বৈধ ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং হারাম ও বাতিল পন্থা। তেমনি যদি স্বাভাবিক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও লেনদেনের মধ্যে উভয়পক্ষের আন্তরিক সন্তুষ্টি না থাকে, তবে সেরূপ ক্রয়-বিক্রয়ও বাতিল ও হারাম।
ইসলামে বৈরাগ্য সাধনার স্বীকৃতি নেই। ব্যবহারিক সংসার যাত্রার দাবিকে জীবনের জন্য অপরিহার্য বিবেচনা করা হয়। ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের দাবির প্রতিও দায়িত্বশীল হওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। নামাজ শেষ হলে ‘আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে’ বেরিয়ে পড়ার নির্দেশনার মধ্যে ব্যবহারিক জীবনের বাস্তব প্রয়োজনীয়তার প্রতি মনোযোগ দেয়াকে কর্তব্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। আজানের মধ্যে হাই আলাস সালাহ (নামাজের দিকে আসো) বলার পর বলা হয় ‘হাইআলাল ফালাহ’ (কল্যাণের দিকে এসো)। অর্থাৎ এই নামাজ আদায় বা এই রোজা পালনের মধ্যে রয়েছে প্রভূত কল্যাণের উৎস- উপায়-উপকরণ। যে ব্যবসায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের দ্বারা কল্যাণকর পণ্য বা সামগ্রী উৎপন্ন তথা বিপণন হয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, দেশজ সম্পদ উৎপাদনে গঠনমূলক অবদান রাখতে সক্ষম হয় সে ব্যবসায় বাণিজ্যকে কল্যাণকর অভিধায় আখ্যায়িত করা চলে। এ জাতীয় বাণিজ্য-বিনিয়োগ-ব্যবসায় দিয়ে মানুষের উপকারের সুফল যত দিন কায়েম থাকবে তত দিন বিশেষ সওয়াব হাসিল হতে থাকবে ওই বিনিয়োগকারীর। রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী হাশরের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সাথী হবে।’

রোজা পালনের মাধ্যমে প্রবৃত্তির ওপর আকলের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। এতে মানুষের পাশবিক শক্তি অবদমিত হয় ও রুহানি শক্তি বৃদ্ধি পায়। কেননা, ক্ষুধা ও পিপাসার কারণে মানুষের জৈবিক ও পাশবিক ইচ্ছা হ্রাস পায়। এতে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়। যেকোনো পরিস্থিতিতে ধৈর্য অবলম্বন, সহনশীলতা প্রকাশ, পারস্পরিক সম্ভ্রমবোধ ও সৌজন্য প্রদর্শন, সর্বোপরি সব কার্যকলাপে মুক্তবুদ্ধি বিবেচনাপ্রসূত মাত্রা ও মূল্যবোধের অনুসরণ ব্যক্তি তথা সমাজজীবনের অনিবার্য অবলম্বন হওয়া আবশ্যক। চলনে বলনে চিন্তা-চেতনায় আগ্রহ আকাক্সক্ষায় আবেগ উৎকণ্ঠায় আনন্দ সর্বনাশে সর্বত্র একটি মধ্যপন্থা অবলম্বনের ওপর আল-কুরআনে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এটি অনস্বীকার্য যে, যেকোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ভিন্নতর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। যেমন মাত্রা অতিক্রম করলেই সাহস হঠকারিতায়, আত্মোৎসর্গ আত্মহত্যায়, প্রতিযোগিতা হিংসায় পরিণত হতে পারে। অবস্থা বিশেষে সমালোচনা পরচর্চায়, প্রশংসা চাটুবাদে, তেজ ক্রোধে, দেশপ্রেম দেশদ্রোহিতায় এবং অতি ধর্মপ্রীতি ধর্মান্ধতার স্তরে নেমে আসতে পারে। পরিমিতি বোধের ব্যাপারে আল-কুরআনে বহুবার উপদেশ দেয়া হয়েছে। লোকমান হাকিম তার পুত্রকে উপদেশ দিচ্ছেন, ‘অহঙ্কারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করোনা। কারণ আল্লাহ কোনো উদ্ধত অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। তুমি পদক্ষেপ করিও সংযতভাবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করিও; স্বরের মধ্যে গর্দভের স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’ (সূরা লুকমান, আয়াত : ৮-১৯)
ক্যানভাসে রঙ ও তুলির সুষম সমন্বয়ে শিল্পের সার্থকতা ফুটে ওঠে। পারিপার্শ্বিক সব কিছুর পরিমিত অবস্থান ও শৃঙ্খলামণ্ডিত উপস্থাপনার মধ্যেই সৌন্দর্যের যথার্থ বিকাশ। নিয়মনিষ্ঠা ও সহনশীলতা যেকোনো পরিবেশ পরিস্থিতিতে মেজাজ-মর্জি, আস্থা ও অবস্থান এমনকি প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ক্ষেত্রেও দান করে এক অনুপম মর্যাদা। ওভারটেকিং প্রবণতায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘিত হলে যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় তাতে দুর্ঘটনাই ঘটে থাকে। দেহে রক্তচাপের স্বাভাবিক মাত্রা অতিক্রান্ত হলে নানান আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। সঙ্গীতে সাতটি স্বরের মধ্যে পঞ্চমটিই মিষ্ট ও সুষম; সপ্তম সুর তো চড়া সুর। রাত ও দিনের মধ্যবর্তী প্রভাত ও গোধূলি বেলা সবচেয়ে পেলব প্রশান্তির মুহূর্ত। নৌকার আরোহীদের ভারসাম্য বজায় রেখে নৌকায় চড়তে হয়। সবাই একদিকে অস্বাভাবিকভাবে ঝুঁকলে নৌকা ডুববে কিংবা এলোপাতাড়ি ও যত্রতত্র স্থান পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হলে ভাসমান নৌকা তো দুলতেই থাকবে এবং একে চালানো কষ্টকর হয়ে যাবে। অর্থনীতিবিদরা স্পষ্টতই মত প্রকাশ করেছেন- অর্থ সরবরাহে অসম আচরণ এবং স¤পদ বণ্টনে বৈষম্য মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ এবং মুদ্রাস্ফীতি অর্থনীতির অন্যান্য শৃঙ্খলাকে সংক্রামিত করে বিপর্যস্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অনভিপ্রেত প্রতিযোগিতা শৃঙ্খলা ও ভারসাম্যে হানে আঘাত-পরিবেশ প্র্রতিবেশ হয় কলুষিত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ব্যক্তি তথা সামষ্টিক জীবনে সব ক্ষেত্রে ও পর্যায়ে সংযম এবং সহনশীলতা প্রদর্শনের, যুক্তিনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ মধ্যপন্থা অবলম্বনের আবশ্যকতা রয়েছে। আল-কুরআনের ২৫তম সূরা ফুরকানে এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে- ‘যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না; বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে, মধ্যম পন্থায়’ (আয়াত-৬৭), কিংবা ১৭তম সূরা বনি ইসরাইলে- ‘সালাতে স্বর উচ্চ করিও না এবং অতিশয় ক্ষীণও করিওনা, এ দুয়ের মধ্যপথ অবলম্বন করো।’ (আয়াত-১১০)

বিশ্বাসে ও ব্যবহারে, জীবনযাপন ও মানবিকতায় মাত্রা অতিক্রমকারী বনি ইসরাইল, লুত ও ছামুদ জাতির অশুভ পরিণতির কথা কুরআনে প্রায়ই উদাহরণস্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। সংযম ও সহনশীল হওয়ার উপদেশ বারবার দেয়ার পর কুরআনে একাধিক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে- মাত্রা অতিক্রমকারীর অশুভ পরিণতি ও বলা হয়েছে আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন না। (সূরা মায়িদা আয়াত-৮৭, সূরা বাকারা, আয়াত-১৯০) কুরআনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে আচার-আচরণ, চিন্তা-চেতনায় ও কার্যকলাপে মাত্রা অতিক্রমকারীদের স্বাভাবিক সুচিন্তাবোধ ও বুদ্ধি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।’ বলা হয়েছে, ‘মানুষকে যখন দুঃখ দৈন্য স্পর্শ করে তখন সে শুয়ে বসে অথবা দাঁড়িয়ে আমাকে ডেকে থাকে; অতঃপর আমি যখন তার দুঃখ দৈন্য দূরীভূত করি, সে এমন পথ অবল¤বন করে, যেন তাকে যে দুঃখ দৈন্য স্পর্শ করেছিল তার জন্য সে আমাকে ডাকেইনি। যারা সীমালঙ্ঘন করে তাদের কর্ম তাদের কাছে এভাবে শোভন প্রতীয়মান হয়।’ (সূরা ইউনুস, আয়াত-১২)
অপচয় অপব্যয় ব্যষ্টি ও সমষ্টির সামগ্রিক অবয়বে অনির্বচনীয় দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্থান কাল পাত্র নির্বিশেষে এ কথা সর্বজনবিদিত যে, সময় সম্পদ ও সুযোগের সুষম ব্যবহারে সাফল্য সুনিশ্চিত হয়। আল কুরআনে অপচয় অপব্যয় ও অমিতাচার থেকে দূরে থাকার জন্য বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- ‘এবং যারা মানুষকে দেখানোর জন্য তাদের ধনসম্পদ ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করে না আল্লাহ তাদেরকে ভালো বাসেন না আর শয়তান কারো সঙ্গী হলে সে সঙ্গী কত মন্দ।’ (সূরা নিসা, আয়াত-৩৮) ‘অপচয় করবে না, কারণ আল্লাহ্ অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা আল আনাম, আয়াত-১৪১) ‘যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৬-২৭) এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না; বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়।’ (সূরা ফুরকান, আয়াত-৬৭) অপব্যয়ের ফলে স্বভাবত অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায্য দায় পরিশোধে বিঘœ সৃষ্টি হয়ে থাকে বলেই ব্যয় ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুষম অবস্থা অবলম্বনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। সম্পদ সসীম। চাহিদা অসীম। সসীম সম্পদের সুষম ব্যবহারের দ্বারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাহিদা মেটানো যেখানে জরুরি সেখানে অপব্যয়ের অবকাশ নেই। ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে অপব্যয় অভাব অনটনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। জাতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রেও একই কথা। অপব্যয় অপচয়ে জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হয়, বৈষম্য প্রকাশ্য হয়ে ওঠে ভোগ ও বণ্টন প্রক্রিয়ায়। পানাহারের ক্ষেত্রেও মধ্যপন্থা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ক্ষুধা ও প্রয়োজনের চেয়ে অধিক খাদ্যগ্রহণ অনুচিত। ফেকাহবিদরা উদরপূর্তি ও অস্বাভাবিক ভক্ষণ করাকে না জায়েজ লিখেছেন। হজরত ওমর রা: বলেন ‘বেশি পানাহার থেকে বেঁচে থাকো। কারণ অধিক পানাহার দেহকে নষ্ট করে, নানা রোগের জন্ম দেয় এবং কর্মে অলসতা সৃষ্টি করে। পানাহারের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করো। এটি দৈহিক সুস্থতার পক্ষে উপকারী এবং অপব্যয় থেকে দূরবর্তী।’

‘সরকারি তদারকি না থাকায় দেশের পোলট্রি খাতে হরিলুট চলছে’ বলে অভিযোগ করেছে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন। অ্যাসোসিয়েশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশে প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা তিন হাজার ৫০০ টন। প্রান্তিক খামারিদের ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ এখন কেজিপ্রতি ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা। আর করপোরেট প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যয় ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। তবে পাইকারি পর্যায়ে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত এসব মুরগি বিক্রি হয়েছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের (তাদের চুক্তিভিত্তিক ফার্মসহ) মাধ্যমে থেকে প্রতিদিন দুই হাজার টন মুরগি বাজারে আসে। সেই হিসাবে দিনে তাদের অতিরিক্ত মুনাফা হয় ১২ কোটি টাকা। এভাবে গত ৩১ জানুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত ৫২ দিনে ৬২৪ কোটি টাকা মুরগি বিক্রির মাধ্যমে লাভ করেছে কোম্পানিগুলো। আর এক দিনের মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে তাদের মুনাফা ৩১২ কোটি টাকা। দেশে প্রতিদিন বাচ্চা উৎপাদন হয় ২০ লাখ। এসব বাচ্চা কোম্পানিগুলো উৎপাদন করে। একেকটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে খরচ হয় ২৮ থেকে ৩০ টাকা, যা চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ছিল ১০ থেকে ১৫ টাকা। সেই বাচ্চা প্রতিটি এখন ৬২ থেকে ৬৮ টাকায় দেয়ার কথা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। প্রতিটি বাচ্চায় ৩০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করছে কোম্পানিগুলো।
আগে থেকেই উদ্যোগ নেয়ার কারণে এবার রমজানে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। দোকানে সব ধরনের পণ্যও মিলছে। সারা দেশে সরবরাহ পরিস্থিতিও স্বাভাবিক রয়েছে। তার পরও রোজার সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের কিছু পণ্যের দাম বাড়িয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে (‘পাত্তা দিচ্ছে না সিন্ডিকেট’, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৩ মার্চ-২০২৩)। চিনির শুল্ক কমানো হলেও পণ্যটির দাম এক টাকাও কমেনি। কারণ ছাড়াই পোলট্রি মুরগির দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দিচ্ছে; তবে এসবে পাত্তা দিচ্ছে না বাজার সিন্ডিকেট।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিনির দাম কমানোর জন্য শুল্ক প্রত্যাহার করতে এনবিআরকে সুপারিশ করা হয়েছিল। এখন এনবিআর থেকে মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে- কেন চিনির দাম কমছে না। ব্যবসায়ীরা যদি প্রতিশ্রুতি দিয়েও দাম না কমান, তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে সবাইকে ভাবতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রালয় থেকে চিনি ব্যবসায়ীরা সাত দিনের সময় নিয়েছেন। কেজিপ্রতি পাঁচ টাকা করে দাম কমানোর বিষয়েও প্রতিশ্রুতি রয়েছে। পণ্যের মজুদ ও সরবরাহ পরিস্থিতি সন্তোষজনক। তার পরও কেউ কেউ সুযোগ নিচ্ছে, তারা কারা তাদের ব্যবসায় বাণিজ্য ও বিনিয়োজিত তহবিলের উৎস, খাদ্যপণ্য আমদানির ব্যবস্থাপনা কাদের করায়ত্তে, সেই সিন্ডিকেট কেন সরকারকে পাত্তা দিচ্ছে না বিষয়টি রাজনৈতিক অর্থনীতির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা খতিয়ে দেখা দরকার। মিডিয়ার রিপোর্টে প্রকাশ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রমজানকে কেন্দ্র করে গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় সব জিনিসের দাম ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। উপরন্তু গত বছরের চেয়ে কোনো কোনো জিনিসের দাম শতভাগ বেড়েছে। এর কারণ বা দোষ করোনা ও ক্রেমলিন কিয়েভ যুদ্ধের ওপর চাপানো কতটা সমীচীন হবে বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে হবে এবং জনগণকে তা অবহিত করা আবশ্যক। কেননা, পণ্যের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষ যারা কার্ড করতে পেরেছেন, তারা টিসিবি ডিলারের দোকানে লাইন দিচ্ছেন। যাদের কার্ড নেই, তারা প্রয়োজনের অর্ধেক বা তারও কম পণ্য কিনে ঘরে ফিরছেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের হলগুলোতে সন্ধ্যার খাবারের মূল্য সাহরির সময় বারো আনা (৭৫ শতাংশ) বৃদ্ধি পায়। শিক্ষার্থীদের করুণ দুর্দশার কথা প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়। এফবিসিসিআইয়ের প্রধান প্রশ্ন রেখেছে দুবাইতে আমদানি করা গরুর গোশত ৫০০ টাকায় পাওয়া গেলে বাংলাদেশে নিজস্ব উৎপাদিত তা ৭৫০ টাকায় কেন কিনতে হবে। সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, রমজান মাসকে সামনে রেখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিদফতর, টিসিবিসহ সরকারের সংস্থাগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর পরও থেমে নেই বাজার কারসাজি। কিছু পণ্যের দাম সহনীয় থাকলেও রোজার আগেই পরিকল্পনা করে বাড়ানো হয়েছে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি পণ্যের দাম। নিত্যপণ্যের পাশাপাশি বেড়েছে কাঁচাসবজির দামও। এ ব্যাপারে (পণ্য বা সেবামূল্য তদারকি ও ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গঠিত) কমপেটিটিভ কমিশনের কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। তবে এটিও ঠিক বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ও ব্যবসায়ীদের যেমন দায়িত্ব আছে, একইভাবে ভোক্তাকেও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। তারা যেন কৃচ্ছ্রতা সাধনের মাস রোজার সময় হুমড়ি খেয়ে পণ্য না কেনেন। কারণ হঠাৎ কোনো পণ্যের চাহিদা বেড়ে গেলে তার দাম বেড়ে যায়। তাই ভোক্তারা যদি পণ্য কেনার ক্ষেত্রে সহনীয় আচরণ করেন, বাজারও সহনীয় থাকবে।

এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র নয় মাস বাকি। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। রমজান মাসজুড়ে ইফতার পার্টির মাধ্যমে দলীয় রাজনীতি চাঙ্গা করার পাশাপাশি জনদৃষ্টি আকর্ষণের কৌশল নিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ইতোমধ্যেই তারা নামী-দামি হোটেল, রেস্তোরাঁ ও কমিউনিটি সেন্টার বুকিং দিয়ে ফেলেছে। এবার ইফতার পার্টিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তোড়জোড় বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। জমজমাট হচ্ছে ইফতার রাজনীতি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এটিই শেষ রমজান। তাই রমজান মাসজুড়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ইফতার পার্টির আয়োজনের তোড়জোড়ও এবার অন্যান্যবারের চেয়ে অনেক বেশি। শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে রাজধানী, বিভাগ-জেলা শহরে শুধু নয়, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এবার গ্রামপর্যায়ে ইফতার পার্টির আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছে। এর মাধ্যমে নিজ নিজ দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে রাজনীতিতে সক্রিয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাশাপাশি গণসংযোগ জোরদার করাও। ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার কারণে রাজনৈতিক দলগুলো ইফতার পার্টির আয়োজন করেনি। এবার ইতোমধ্যে সারা দেশে নির্বাচনী আমেজ শুরু হয়ে যাওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর ইফতার পার্টি নতুন মাত্রা পাচ্ছে। এবার রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের ইফতার পার্টিতে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি, সমমনা রাজনৈতিক দল, সমমনা বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন ও সাংবাদিক সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রতিনিধিদের বেশি সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া বিদেশী কূটনীতিক ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের প্রাধান্য দিয়ে ইফতার পার্টির আয়োজন করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা দলীয় পর্যায়ে ইফতার পার্টি আয়োজনের পাশাপাশি প্রতিদিনই বিভিন্ন সমমনা দল ও সংগঠনের ইফতারে অংশ নিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নিজ দলের অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা চলছে, সংযম ও আত্মশুদ্ধি সাধনার এই মাসে। কে কার চেয়ে বেশি দলকে কাছে টানতে পারে, এ নিয়ে প্রতিযোগিতায় মাহে রমজানের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। রমজান মাস যেহেতু সংযমের, আত্মশুদ্ধিও, সে ক্ষেত্রে তথাকথিত তেলো মাথায় তেল দেয়ার ইফতার পার্টির আয়োজনের নামে ‘চাঁদাবাজি’কেও, এই চাঁদাবাজি ব্যবসায়ী বা পণ্য সরবরাহকারীদের কস্ট অব প্রডাকশন কিংবা ডুয়িং বিজনেস বাড়িয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে কিনা তা অগৌণে মাথায় আনতে হবে।
সিন্ডিকেটকে কেন কথা শুনানো যাচ্ছে না, জনগণকে ‘সেবা করার জন্য’ ক্ষমতায় থাকতে বা যেতে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার এই দলকানা পক্ষপাতিত্বেও এই বিড়ম্বনা জনগণকে সহ্য করতেই হচ্ছে। অথচ প্রত্যাশিত ছিল রাজনৈতিক অর্থনীতির এই সঙ্কটময় মুহূর্তে অপচয় অপব্যয় বাঁচিয়ে গোত্র-গুষ্ঠি দলমত নির্বিশেষে গণহারে ইফতারসামগ্রী বিতরণ, খাদ্য সহায়তা প্রদান, জামাকাপড় ও জাকাত বিতরণের মাধ্যমে মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement
কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’

সকল