২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

রমজানের অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

-

রমজান মাস পবিত্র; বরকতময়, সংযম ও আত্মশুদ্ধির মাস। বিশ্বমুসলিম অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন, প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এই মাসের জন্য। এই প্রস্তুতির ধরন অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন। যেমন, ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা রমজানে সর্বোচ্চ ইবাদতের প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন; এর মধ্যে রোজা রাখা, তারাবি পড়া, কুরআন অধ্যয়ন করা, জাকাত দেয়া, দান-সদকা করা, ওমরাহ করা, ফিতরা দেয়া ইত্যাদি। এর সাথে ঈদের আনন্দ করা, পরিবারের সবার জন্য সাধ্যমতো নতুন পোশাক পরিচ্ছদ ক্রয় ইত্যাদি তো রয়েছেই। অন্য দিকে ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে অসাধু ব্যবসায়ীরা সারা বছর অপেক্ষা করেন এই মাসে সর্বোচ্চ ব্যবসা করার জন্য। তবে সাধু এবং আল্লাহভীরু ব্যবসায়ীরা এই মাসে জিনিসপত্রের দাম সাধ্যমতো কমিয়ে, ব্যবসা কম করে রোজাদার মুসলমানদের সেবা করার চিন্তা করেন। অবশ্য এই মানসিকতার ব্যবসায়ী বাংলাদেশে বেশ কম, তবে বিশ্বের অনেক দেশ যেমন, কাতার, ইরান, সৌদি আরব, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাকসহ অনেক দেশে এমনটি দেখা যায়।
তবে সাধু-অসাধু সব ব্যবসায়ীই রমজান এবং ঈদ উপলক্ষে খাদ্যপণ্য, পোশাক পরিচ্ছদ, জুতা-স্যান্ডেল, প্রসাধনী, আতর, তসবিহ, সাহরি ও ইফতারের সামগ্রীসহ নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। ভিড় বেড়েছে নিত্যপণ্যের দোকানে। যদিও বিশ্বজুড়ে যুদ্ধবিগ্রহ এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই এবারের রমজান। নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দামে বিপাকে অনেক মুসলিম দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও গরিব মুসল্লিরা। কারণ এমনিতেই রমজানে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায় তার ওপর অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে প্রতিটি খাবারের দামই অন্তত তিনগুণ বেড়েছে। এই সঙ্কট শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশেই। চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়ে রমজান শুরু করছে লেবাননবাসী; তবুও রোজার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর মানুষও। পশ্চিমা দেশগুলোর মুসলিম বাসিন্দারাও নিচ্ছেন প্রস্তুতি।

অর্থনীতিতে রমজানের প্রভাব
রমজানের অর্থনীতির রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ মাসে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি বাড়ে। অনেক ভোজ্যপণ্যের ব্যবহার বেড়ে যায়। ফলে এসব পণ্যের উৎপাদন, পরিবহন ও বিপণন বৃদ্ধি পায়। ইফতার বাজার বসে রোজার মাসে। অনেকের সাময়িক কর্মসংস্থান হয়। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো চাঙ্গা হয়। নতুন অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ব্যবসা রোজার মাসে বহুগুণে বেড়ে যায়। তাদের পুঁজি, রক্ষণাবেক্ষণ এবং কর্মচারীদের বেতনসহ সব কিছু এ মাসের ব্যবসা দিয়ে চলে। রোজার মাসে অর্থের প্রবাহ ব্যাপকভাবে বাড়ে। ব্যাংকের অলস অর্থ থেকে কিছু অর্থ গ্রাহকদের হাতে এসে সক্রিয় হয়। তা থেকে দান-সদকা, হাদিয়া, জাকাত-ফেতরার মাধ্যমে কিছু অর্থ গরিবের কাছে আসে। পরবর্তী সময়ে তা আবার বাজারে যায়। বাজার থেকে ব্যবসায়ীর মূলধন হয় কিংবা ফের ব্যাংকে জমা পড়ে।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যে অর্থের প্রয়োজন, তার বড় একটা অংশ রোজার মাসেই আসে। এ মাসেই দেশের আলেম-ওলামারা অর্থনৈতিক বড় একটা সহযোগিতা পান। রাসূল (সা:) বলেন, ‘রমজানে ওমরাহ পালন করা হজের সমতুল্য।‘ (সুনানে ইবনে মাজাহ)। তাই রোজার মাসে ওমরা পালনের প্রবণতা অনেক বেড়ে যায়। সবাই রোজার মাসকে জাকাত দেয়ার মাস হিসেবে বিবেচনা করেন। তাই জাকাত আদায়ের প্রক্রিয়ায় রোজা অর্থনীতিকে বেশ সমৃদ্ধ করে।
রোজা শেষে আসে ঈদ। সাধ্যমতো নতুন পোশাক ও প্রসাধনী ক্রয়ের চেষ্টা সবারই থাকে; এর প্রভাবে অর্থনীতিতে গতি আসে। পরিবহন খাতেও ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ঈদ উপলক্ষে নগরবাসী গ্রামে ছোটে। রেল, বাস, লঞ্চের যাত্রী বহুগুণে বেড়ে যায়। ঈদে অনেকে পর্যটনমুখী হয়। ফলে অর্থনীতির সচলতা বাড়ে।

রমজানে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমে
সমাজে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে আকাশপাতাল অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে রোজার ভূমিকা অপরিসীম। এ মাসে গরিব-দুঃখীদের প্রতি সম্পদশালীদের সহানুভূতি জাগে, ব্যাপকভাবে দানের হাত সম্প্রসারিত হয়। রোজাদার ধনী ব্যক্তি রমজান মাসে জাকাত প্রদান এবং মুক্তহস্তে দান-খয়রাত ও সদকা আদায় করেন, যা সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘তাদের (ধনীর) সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার।‘ (সূরা আল-যারিআত, আয়াত ১৯)। ফলে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেকটা দূর হয় এবং সবাই ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে সিয়াম সাধনা তথা রোজা পালন করেন। রমজানে ধনী ব্যক্তি বেশি পরিমাণে ধন-সম্পদ জমিয়ে রাখতে পারেন না, ফলে পণ্যের সরবরাহ বাড়ে।
রমজানকে অনেকে ব্যবসার মাস বলে গণ্য করেন। হালাল পন্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য করা ইবাদতের শামিল; কিন্তু বাতিল পন্থায় আয় উপার্জন করা হারাম। কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না, কিন্তু পরস্পর সম্মতির ভিত্তিতে ব্যবসা করা বৈধ।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত ২৯)। তবে বর্তমান সমাজে রমজানের এই অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের ব্যবস্থাকে ঠিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য বলা যায় না, কারণ এটা সাময়িক। তারপরেও রমজানে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কিছুটা হলেও দূর হয়। এভাবে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে রমজানের রোজা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

রমজানের অর্থনীতি ও বাংলাদেশের বাস্তবতা
বাজার অর্থনীতিতে সাধারণত চাহিদার তুলনায় বাজারে জোগান কমে গেলে পণ্যের দাম বাড়ে। কিন্তু পণ্যের দাম বাড়ানোর জন্য অবৈধ মজুদদারির মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয় কৃত্রিম সঙ্কট। মনোপোলাইজ করা হয় বাজারকে। এই মনোপলি বিজনেসের সঙ্গে হিডেন কস্ট বা উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন অতিরিক্ত খরচ যোগ হলে দ্রব্যমূল্য আরো বাড়ে। সাধারণত বাংলাদেশে রমজানকে ঘিরে এ বাস্তবতা প্রকট। অর্থাৎ কতিপয় অসাধু পাইকারি ব্যবসায়ী পণ্যের অতিরিক্ত মজুদ রাখে। এর পাশাপাশি পরিবহনে চাঁদাবাজি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বখশিশের খরচ ইত্যাদি যোগ হয়। একশ্রেণীর অসাধু মজুদদার ব্যবসায়ী এই সময় রোজাদারদের কেনাকাটার চাহিদা লক্ষ করে বাজারে খাদ্য ও পণ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দেয়। অধিক হারে মুনাফা লাভের জন্য তারা রোজাদারদের আর্থিক কষ্ট দেয়। অথচ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ক্রিসমাস বা ঈদ উপলক্ষে দ্রব্যমূল্য হ্রাস পায়। তারা পণ্যসামগ্রীর মূল্যে ভর্তুকি দিয়ে মাহে রমজানে হ্রাসকৃত মূল্যে বিক্রি করে। সেখানকার নীতিবান ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য থাকে সঠিক মূল্যে রোজাদারের হাতে নির্ভেজাল পণ্যটি সরবরাহ করা। অথচ একমাত্র বাংলাদেশেই রমজান ও ঈদ উপলক্ষে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যায়; এক দিকে পণ্যের দাম বেড়ে যায়, অন্য দিকে পণ্যে ভেজাল ও ওজনে কম দেয়। এ জন্য রাসূলুল্লাহ সা: সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘পাপী ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কেউ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দুষ্প্রাপ্যতার সময় গুদামজাত করে না।‘ (মুসলিম)।’

যা করণীয়
বাংলাদেশের রমজান ও ঈদ অর্থনীতি চিরকাল মুদ্রাস্ফীতির জালে জর্জরিত। এ সময় মনোপলি বিজনেস ও হিডেন কস্ট নিয়ন্ত্রণ করে কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস হ্রাস করতে হবে। আর তা না হলে মুদ্রাস্ফীতির চাপে নিষ্পেষিত মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত তাদের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে সমন্বয় করতে ব্যর্থ হয়। তা ছাড়া গণহারে প্রতিবেশী দেশে গিয়ে ঈদের কেনাকাটায় ধরতে হবে লাগাম। আর তা না হলে ঈদ-পূর্ববর্তী রমজানে মূল্যস্ফীতি ও ঈদের কেনাকাটায় বাণিজ্যঘাটতি বৃদ্ধি পেয়ে অর্থনীতিকে ঈদ-পরবর্তী মন্দায় ভোগাবে। তাই রমজান অর্থনীতি বিবেচনায় নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা ও বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসে সরকার ও ব্যবসায়ীদের আন্তরিক কার্যকর পদক্ষেপ জনগণ আশা করে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসন, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটির প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা, সারা দেশে টিসিবির পণ্যসামগ্রী ভোক্তাপর্যায়ে ন্যায্যমূল্যে বিক্রির কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। ব্যবসায়ীরা রমজানে অন্যান্য মাসের তুলনায় একটু কম লাভে বিক্রি করতে পারে। ফলে ভোক্তারা সহনশীল দামে ভোগ্যপণ্য ক্রয় করতে পারবে। বাজারে বিভিন্ন অপতৎপরতা রোধে এবং দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ব্যবসায়ীদের সমন্বিত আন্তরিক প্রচেষ্টা আবশ্যক। বিশেষত সময়োপযোগী পদক্ষেপ যেমন: ঢাকায় পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশের ক্ষেত্রে সেতু অতিক্রম ও ফেরি পারাপারে টোল প্রদানে বিলম্ব হ্রাস করা; টিসিবির ট্রাকসেলের মাধ্যমে শহর ও মফস্বলের হতদরিদ্র এলাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বিক্রি; পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি ও যানজট নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; পণ্যদ্রব্যের অনিয়ন্ত্রিত মজুদ চিহ্নিত ও বন্ধকরণে বাজার তদারককারী সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপ; দক্ষ ও পর্যাপ্ত বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা এবং দায়ী ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনা; দেশের সব বাজারে নিয়মিত মূল্য তালিকা হালনাগাদ করা এবং দক্ষ বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা।
এ ছাড়াও রমজান মাসটা যেন খাদ্যোৎসবের মাস, যেখানে রোজাদাররা বেশি বেশি খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত থাকে। দাম যতই বাড়ুক না কেন, বেশি দাম দিয়ে হলেও তা কিনতে হবে। ইফতার বা সাহরিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার না থাকলে রোজা যেন পূর্ণতা পায় না। কেউ কেউ রমজান মাসের কথা চিন্তা করে আগে থেকেই প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ঘরে মজুদ করতে থাকে। ঈদ সামনে রেখে শুরু হয় কেনাকাটার ধুম। রমজানের প্রকৃত ফজিলত নিয়ে তেমনভাবে ভাবনার বিষয়টি কম দেখা যায়। নিম্ন আয়ের মানুষ বছরের এ মাসটিতে কীভাবে রোজা রাখবে বা উচ্চমূল্য দিয়ে দ্রব্যাদি কিনে কিভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবন নির্বাহ করবে; এটি নিয়ে দেশের বিত্তশালীদের ভাবতে হবে। দেশে দারিদ্র্যের সার্বিক হার বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধসহ সব সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ী যেখানে বিশেষ ছাড় দিয়ে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে ধর্মীয় পর্বের উপহার নিয়ে আসেন সাধারণ ক্রেতার কাছে, সেখানে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা রমজানে দরিদ্রদের কথা না ভেবে ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় নামেন, যা কাম্য নয়।
বাজার গবেষকদের মতে, নিয়ন্ত্রণহীন বাজারে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য পাইকারি বাজারের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেন, অথচ একই খুচরা বাজারে দেখা যায় তিন দোকানে তিন রকম দাম। এর মানে হচ্ছে, বাজার মনিটরিং বলতে কিছু নেই। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, চিনি থেকে শুরু করে ভোজ্যতেল খাদ্য ও কৃষি খাতের সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। একই পরিস্থিতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল, কয়লাসহ প্রায় সব ধরনের জ্বালানি পণ্যের ক্ষেত্রে। এমনকি কৃষির অপরিহার্য উপকরণ সারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বিশ্ববাজারে ঊর্ধ্বমুখী মূল্য মানেই এসব পণ্য বাড়তি দামেই কিনতে হবে বাংলাদেশকে। সব মিলিয়ে সব কিছুর প্রভাব পণ্যের দামের ওপর বর্তায় এবং যার মূল্য ভোক্তাকে দিতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারের অত্যধিক নির্ভরতায় বারবারই দামজনিত অভিঘাতের সম্মুখীন হতে হয়, যার একটা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান জরুরি। সে ক্ষেত্রে দেশে নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে অন্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্যগুলোর অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো যায় তার দিকে নজর নিতে হবে।
পরিশেষে বলতে হয়, প্রতি বছরই রমজানে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয় বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের। এর একটি স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। এর জন্য প্রথমত বাংলাদেশের ওই সব অসাধু ব্যবসায়ী ও কুচক্রী মহলকে রোজার উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে হবে; রোজার শিক্ষা অন্তরে ধারণ করতে হবে; এবং বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। পাশাপাশি রোজার সময়ের প্রয়োজনীয় পণ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে; আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ বাড়াতে হবে; টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে প্রয়োজনীয় পণ্য অভাবীদের হাতের নাগালে পৌঁছে দিতে হবে। পণ্যসামগ্রীতে ভর্তুকি ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী মনিটরিং ব্যবস্থা সরকার প্রবর্তন করলে রোজাদারদের দুর্দশা ও কষ্ট লাঘব হবে। ফড়িয়া, মধ্যস্বত্বভোগী ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি রোধ করতে হবে। বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে, খাদ্যপণ্যের সরকারি মজুদ বৃদ্ধি ও সিন্ডিকেটের কারসাজির দিকেও কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। বাজারে চালাতে হবে নিয়মিত অভিযান, দায়ীদের চিহ্নিত করে নিশ্চিত করতে হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজারে রাষ্ট্রের কার্যকর নজরদারি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এককথায়, রোজার শিক্ষা কাজে লাগানোর পাশাপাশি বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো এবং মনিটরিং, সুপারভিশনই পারে এই এই দীর্ঘ দিনের সমস্যার একটি চিরস্থায়ী সমাধান দিতে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ই-মেল: mizan12bd@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement