২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মুসলিম ভ্রাতৃত্বের চেতনার অবক্ষয়

-

ইসলাম প্রচার ও প্রসারের অন্যতম মাধ্যম মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ। মহানবী সা: শতধাবিভক্ত আরব জাতিকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, গোত্রে গোত্রে প্রচলিত হিংসা বিদ্বেষ ও পারস্পরিক শত্রুতার অবলোপন ঘটিয়ে মুসলিম জাতিকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। পবিত্র কালামে পাকে ঘোষিত হয়েছে- ‘প্রত্যেক মুসলিম ভাই ভাই’। মহানবী সা: মদিনায় হিজরতের পর অসহায় মুহাজির বা দেশ ত্যাগী সাহাবিদেরকে আনসার সাহাবিদের সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন। ফলে আনসার সাহাবিরা তাদের সম্পদ থেকে ভ্রাতৃত্ববোধে আবদ্ধ মুহাজির বা দেশত্যাগী ভাইদের সম্পদের অংশ ভাগ করে দিয়েছিলেন। ভ্রাতৃত্ববোধের এমন নমুনা পৃথিবীতে বিরল। খেলাফতে রাশেদার যুগে মুসলিম খেলাফতের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছিল। এশিয়ার সীমানা পেরিয়ে মুসলিম খেলাফতের সীমানা আফ্রিকাতেও বিস্তার লাভ করেছিল। এমনকি খোলাফায়ে রাশেদার পরে মুসলিম খেলাফতের সীমানা আফ্রিকার সীমান্ত পেরিয়ে জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে ইউরোপে বিস্তৃত হয়েছিল। খেলাফতের এই ব্যাপক সীমানায় আঞ্চলিকতার ঊর্ধ্বে সাদা-কালো বা বর্ণবাদের ব্যবধান ঘুচিয়ে এক মুসলিম উম্মাহ বা জাতি গঠিত হয়েছিল। এই বিশাল খেলাফতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের যেকোনো প্রান্তে কোনো মুসলিম আক্রান্ত হলে পুরো মুসলিম জাতি তার প্রতিকারে ঐক্যবদ্ধ ছিল। আমরা জানি ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে মুসা বিন নুসাইর আফ্রিকার সীমানা পেরিয়ে জিব্রাল্টার প্রণালী পার হয়ে স্পেন বিজয় করেছিলেন। অপর দিকে, মুহাম্মদ বিন কাসিম ভারতবর্ষের সিন্ধু প্রদেশে অভিযান চালিয়ে তা অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ফলে মুসলিম খেলাফতের চরম বিস্তৃতি ঘটেছিল। ভারত অভিযানের কারণ হিসেবে আমরা জানি, সিন্ধুর রাজা দাহিরের অধীনস্থ জলদস্যুরা ভারত মহাসাগরে মুসলিম বণিকদের বাণিজ্যিক জাহাজ লুণ্ঠন করেছিল। সে জাহাজে অবস্থিত নারী ও শিশুদেরকে অপহরণ করেছিল। এ সংবাদ পেয়ে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের খলিফা আবদুল মালিক তার পূর্বাঞ্চলীয় গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে রাজা দাহিরের কাছে এ অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ জানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। হাজ্জাজ খলিফার পক্ষ থেকে দূত প্রেরণ করে রাজা দাহিরের কাছে ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম বণিকদের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলেন। রাজা দাহির ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। প্রতিক্রিয়ায় খলিফার নির্দেশে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তার ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা তরুণ মুসলিম সেনানায়ক মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সিন্ধু অভিযানে পাঠান। পরিণতিতে সিন্ধু মুসলিম খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। মূল কথা, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে কোনো মুসলিম বিপদাপন্ন হলে সব মুসলিমের কর্তব্য তাকে সর্বতোভাবে সহায়তা করা। বর্তমান মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিমরা নির্যাতিত। বিশেষত ফিলিস্তিন, কাশ্মির ও রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের দুঃখের শেষ নেই। বাংলাদেশ সরকার উদার মানসিকতা নিয়ে ১০ লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত আরাকানি মুসলিম বা রোহিঙ্গাদের দেশে আশ্রয় দিয়েছে যা মানবাধিকার ও মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের চরম বহিঃপ্রকাশ। এ লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসনে বাংলাদেশ সরকার হিমশিম খাচ্ছে। অথচ আমরা জানি, পৃথিবীতে মুসলিম জাতির সুরক্ষা দেয়া ও স্বার্থরক্ষার জন্য ওআইসি নামে আন্তর্জাতিক মুসলিম সংস্থা রয়েছে যাদের তৎপরতা অত্যন্ত সীমিত।

মুসলিম জাতির সমস্যা নিরসনে এ সংস্থার ভূমিকা অত্যন্ত গৌণ। যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব সীমিত সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে পুনর্বাসনের প্রস্তাব করেছে; সেখানে মুসলিম বিশ্বের প্রভুত জনবল সম্পদ ও সমরশক্তি থাকা সত্ত্বে¡ও তারা রোহিঙ্গা শরণার্থী পুনর্বাসনে উল্লেøখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখছে না। অথচ মুসলিম বিশ্ব যদি ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের সম্পদ ও শক্তির যথাযথ ব্যবহার করত তাহলে পৃথিবীতে মুসলিম জাতির সার্বিক ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটত। বর্তমানে সমরশক্তিতে মুসলিম বিশ্ব যথেষ্ট আগুয়ান। বিশেষত মিসর, তুরস্ক, পাকিস্তান, ইরান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সমরশক্তিতে যথেষ্ট শক্তিশালী। সার্বিক মুসলিম বিশ্বের সমরশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে পৃথিবীতে তা শক্তিশালী সামরিক জোট হিসেবে বিবেচিত হতো। আমরা জানি, পৃথিবীতে দুর্বলের কোনো স্থান নেই। পৃথিবীর ঐক্যবদ্ধ খ্রিষ্টান শক্তি কিছু দিন আগে ১৯৭৫ সালের ২৮ নভেম্বর ঐক্যবদ্ধভাবে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের স্বার্থরক্ষায় ইন্দোনেশিয়ার পূর্বাংশ পূর্ব তিমুরকে একটি দেশ হিসেবে আলাদা করে ফেলেছে যার রাজধানী দিলি। অথচ মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধভাবে মুসলিম জাতির স্বার্থরক্ষায় সামরিক শক্তি প্রয়োগ তো দূরের কথা, নির্যাতিত মুসলিম উদ্বাস্তুদের জন্য মানবিক সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। পৃথিবীতে খ্রিষ্টান উদ্বাস্তুর সংখ্যা নেই বললেই চলে। পৃথিবীতে ছোট-বড় প্রায় ৫০টি মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে যাদের প্রভূত ভৌগোলিক সীমারেখা রয়েছে। রয়েছে পর্যাপ্ত খনিজসম্পদ। রয়েছে পর্যাপ্ত মানবসম্পদ। আর্থিকভাবে মুসলিম বিশ্ব যথেষ্ট শক্তিশালী। মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ তো দূরের কথা, মানবতা ও মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ নিয়ে সহায়তা দিলে এসব উদ্বাস্তুকে পুনর্বাসন করা সহজেই সম্ভব হতো। আমরা জানি, পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকা।
আমেরিকার মূল আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ান। জনসংখ্যার অনুপাতে রেড ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা ২ শতাংশের কিছু বেশি। আমেরিকার বেশির ভাগ নাগরিক ইংল্যান্ড, স্পেনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে। বর্তমানেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রেণী ও পেশার মানুষকে আমেরিকা নাগরিকত্ব দিয়ে চলেছে। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত আমেরিকার এই সম্মিলিত জনগোষ্ঠীই আমেরিকার মূল শক্তি। বর্তমানে আমেরিকার নাগরিকরা নিজেদেরকে বহিরাগত না ভেবে আমেরিকার নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। তারা শিক্ষা ও জ্ঞানের সিঁড়ি বেয়ে উদারতা, মহানুভবতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের শিকলে আবদ্ধ হয়ে আমেরিকাকে উন্নতির চরম শীর্ষে পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছে। আমরা জানি, মহানবী সা: বিদায় হজের বাণীতে আরব ও অনাবরের ব্যবধান দূরীভূত করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বিশ্ব মানবতার মুক্তির জন্য তার এ অমর ভাষণে সাদা ও কালোর ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ এখনো শিক্ষায় অনগ্রসর আরবরা নিজেদের আরবি জাতীয়তাবাদে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। অনারবদের তারা এখনো অনেক ক্ষেত্রে জাতিগত কৌলীন্যের অজুহাত তুলে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। মূলত শিক্ষাই শক্তি, শিক্ষাই মুক্তি। জ্ঞান বা শিক্ষাই মানুষ ও পশুর মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করেছে। জ্ঞানহীনতার কারণে পশু একত্রে বসবাস করতে পারে না। নিজেদের মধ্যে সঙ্ঘাত ও কলহের সৃষ্টি করে। ঠিক তেমনি জ্ঞানের দৈন্যেয় ভোগা মানুষ সহজেই ঐক্যবদ্ধ জীবন যাপন করতে পারে না। জ্ঞানহীন লোকেরা নিজেদের স্বার্থ ব্যতীত অপরের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে বা সমুন্নত রাখতে সমর্থ হয় না। চলমান বিশ্বে মুসলিম জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে চলমান বিশ্বের মধ্যে জ্ঞানের জগতে নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই । সর্বোপরি আঞ্চলিকতা ও আত্ম অহমিকা পরিহার করে নিজেদের মধ্যে শক্তিশালী সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা অতীব জরুরি।
লেখক : গবেষক, কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
সিরাজগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের নৈশ প্রহরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার ৬ দাবিতে উত্তাল বুয়েট, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন মোরেলগঞ্জে মাছ ধরতে গিয়ে নদীতে ডুবে কিশোরের মৃত্যু আল-আকসায় কোনো ধরণের সহিংসতা ছাড়াই অনুষ্ঠিত হলো তৃতীয় জুমআর জামাত ‘পেশাগত স্বার্থে সাংবাদিকদের ঐক্যবব্ধ হতে হবে’ গাজাবাসীর প্রধান কথা- ‘আমাদের খাবার চাই’ অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশপ্রেমিক জনতার ঐক্যের বিকল্প নেই : ডা: শফিকুর রহমান সোনাগাজীতে জামাতে নামাজ পড়ে বাইসাইকেল পুরস্কার পেল ২২ কিশোর গফরগাঁওয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১

সকল