২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কৃষি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সম্পর্ক

-

কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন
দূরত্ব, জনঘনত্ব, জীবনমান ও উন্নয়নের স্তর বিবেচনায় দেশে সব পল্লী এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থান সমান নয়। সেই কারণে সব পল্লী এলাকায় একই উন্নয়ন কৌশল উপযোগী হবার নয়। উন্নয়নশীল দেশের অনেক এলাকা মূলত এখনো অনুন্নত ও কৃষি জীবনধারণভিত্তিক। এসব অনুন্নত এলাকাতে উন্নত কৃষিপ্রযুক্তি প্রয়োগে তাৎপর্যপূর্ণ হারে উৎপাদন বাড়ানো যাবে। এতে পল্লী অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। কৃষির বিভিন্ন উপখাতও এতে অবদান রাখতে পারবে। যেমন; মাছ, গোশত ও দুগ্ধজাত পণ্য এবং সনাতন রফতানি পণ্য বা আমদানি বিকল্প পণ্য; যেমন কফি, চা, তুলা ও ফুলের মতো উদ্যান পণ্যের উৎপাদন। কৃষক তাদের উৎপাদনে বিভিন্নমুখীনতা ও বৈচিত্র্য নিয়ে আসতে পারলে, কোনো না কোনো ভাবে তারা পল্লীর কৃষিবহির্ভূত অর্থনীতির সাথে সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সংযোগসূত্র বা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

কৃষি ও শিল্পখাতে শ্রমিকের চাহিদা ও উৎপাদনশীলতা
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, অর্থনীতি তিনটি প্রধান খাত নিয়ে গঠিত : কৃষি, শিল্প ও সেবা। সাধারণত অনুন্নত অর্থনীতির দেশে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের গতি সঞ্চারের প্রাথমিক স্তরে (টেক অফ স্টেজ) ঐ দেশের শ্রমশক্তির সিংহভাগ কৃষি খাতে নিয়োজিত থাকে। উন্নয়নের শুরুতে অনুন্নত দেশে শিল্প খাতে শ্রম নিয়োগের পরিসর খুব ছোট থাকে। তবে শিল্প খাতের শ্রম উৎপাদনশীলতা, কৃষি খাতের তুলনায় অনেকখানি বেশি। এই হার শিল্প খাতের বেলায় অনেকটা জ্যামিতিক, আর সে তুলনায় কৃষি খাতের উৎপাদনশীলতা অনেকটা গাণিতিক। শ্রম নিয়োজন ও উৎপাদনশীলতার দিক থেকে সেবা খাতের অবস্থান কৃষি ও শিল্প খাতের মাঝামাঝি। শিল্প, সেবা ও কৃষি খাতে শ্রমিক কর্মীদের মজুরির তুলনামূলক বিচার করলে সহজেই এর প্রতিফলন পাওয়া যায়। কৃষি খাতে শ্রম উৎপাদনশীলতা নির্ণয়ের কাজটি সহজসাধ্য নয়। তাই কৃষি খাতে মোট কৃষি উৎপাদনকে, মোট নিয়োজিত কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে, সেই ভাগফল হবে কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতার হার।
বিশ শতকের শেষার্ধে বিভিন্ন সময়ে বহু এশীয় দেশে রাষ্ট্রীয় নীতি কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে লক্ষ করা যায়। তবে সমস্যা হলো, কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা ও প্রবৃদ্ধি বাড়ার সাথে শ্রমিকের চাহিদা কমে যায়। তবে তাল মিলিয়ে বেড়ে যায় শিল্প ও সেবা খাতের সামর্থ্য। একই সাথে কৃষি খাত থেকে উদ্বৃত্ত শ্রমিকদের শিল্প ও সেবা খাতে কাজ করার সুযোগ বেড়ে যায়। তবে এও লক্ষণীয় যে, শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সমাজে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য অসহনীয় পর্যায়ে বেড়ে যায়। কৃষি থেকে শিল্পায়নের এই পর্যায়ে যদি কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায় তাহলে অতিরিক্ত সম্পদ সৃষ্টি হয়। এই বর্ধিত সম্পদ সমাজে বৈষম্য রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বর্ধিত কৃষি উৎপাদনশীলতা খাদ্যপণ্যের সত্যিকারের মূল্য কম রাখতে সক্ষম। এতে শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরি কম রাখা সম্ভব হয়। ফলে নব প্রতিষ্ঠিত শিল্প উৎপাদনের ব্যয়ও কম থাকে এবং শিল্প উৎপাদন প্রতিযোগিতামূলক থাকে। স্থানীয় বাজারে উৎপাদিত পণ্যে, আমদানিকৃত সমজাতীয় পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় সক্ষম হয়। আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জন করে। তাতে রফতানি ও শ্রমের চাহিদা বেড়ে যায়। সেই সাথে একটা নির্দিষ্ট গতিতে কৃষি ও শিল্প শ্রমিকের মজুরি বাড়ে। পাশাপাশি বেকারত্ব কমে যায়, শ্রমিকের আয় বাড়ে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।

কৃষি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন
উন্নয়নশীল দেশে কৃষি খাত কেবল সার্বিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস নয়; বরং রফতানি খাতেও রাজস্বের অন্যতম উৎস। আগেই বলা হয়েছে যে, কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বাড়লে, শিল্প ও সেবা খাত জোরদার হয়ে উঠে। সেই সাথে সার্বিক উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষি খাতের অবদান না কমলেও, হিস্যা নাটকীয় হারে কমে যায়। হিস্যা কমে গেলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি খাতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ব্যাপকতর প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের প্রাথমিক স্তরে দারিদ্র্য ও অসমতা কমানো, উভয়ক্ষেত্রে কৃষি জোরালো ভূমিকা পালন করে। অতএব কৃষি খাতের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও চীন, এ দেশগুলোতে উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষি উৎপাদনশীলতা ও প্রবৃদ্ধিকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেয়া হয়। তারপর উন্নয়নের স্বাভাবিক ধারাবিন্যাসে শিল্পায়নের প্রসার ঘটে। সেই সাথে সেবা খাতও জোরদার হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির রূপান্তর (খাতওয়ারি অবদান) ১৯৭২-২০২০
ক) টিকা :
১. জনসংখ্যা - মিলিয়নের হিসাবে।
২. শহর-নগরের জনসংখ্যা - মোট জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে।
৩. মোট জিডিপি - বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
৪. চাল উৎপাদন - মিলিয়ন টন।
৫. দরিদ্রতা - জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে।
৬. আয়ু - গড় আয়ু।

খ) সূত্র: ১. Bureau of Statistics Bangladesh-1984,1990, 2014 & 2017
২. Bangladesh Economic Review -2010, 2016, 2017 & 2022
৩. Bangladesh Bank Year Book 2010-2021
৪. UNFPA Report -DIS(2015)

উপরোক্ত সারণি থেকে দেখা যায় যে, ১৯৭২ সালে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) ছিল ৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সাল নাগাদ ৫৯ গুণ বেড়ে ৩৭৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি ১৯৭৫ সালে জিডিপিতে কৃষি খাতের হিস্যা ছিল ৫৫-৬০ শতাংশ। অথচ ২০২০ সালে ১২.৫২ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্য দিকে ১৯৭২ সালে শিল্প খাতের হিস্যা ছিল ১০ শতাংশ। অথচ ২০২০ সালে প্রায় ৩৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং প্রতি বছর বেড়ে চলেছে।
১৯৭২-এ চালের উৎপাদন ছিল আনুমানিক ১০ মিলিয়ন টন। ২০২০ সালে উৎপাদন হয়েছে ৩৮.৬৯ মিলিয়ন টন। আবাদি জমির পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকার বিবেচনায় চালের উৎপাদন বৃদ্ধির হার প্রায় সাড়ে তিনগুণ যদিও সত্যিকার অর্থে কৃষি জমি কমেছে। একই সাথে কৃষি খাতে শ্রমের ব্যবহার, ১৯৮০ সালে ৫৯ শতাংশের তুলনায়, ২০২০ সালে ৪১ শতাংশে নেমে এসেছে।
১৯৬০-এর দশক থেকে বোরো মৌসুমের সূচনালগ্ন থেকে (নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার) একই জমিতে একমাত্র ফসলের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার ফলে যে উৎপাদন বেড়েছে, সেটা যথার্থ অর্থে বিজ্ঞানসম্মত বা সঠিক অর্থে উৎপাদনশীলতা নয়। কেননা, ট্রাক্টর, টিলার, রোপণযন্ত্র, ¯েপ্র বা ছিটানোর যন্ত্র, কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার, মাড়াই যন্ত্র, সেচপাম্প ও উন্নততর নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং উৎপাদন, ফসল তোলা ও নিংড়ানোর সময় বিভিন্ন ধরনের চালকযন্ত্র (মেশিন) ব্যবহারের কারণে কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে যুগপৎ মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছরের কম। সেটা ২০২০-এ এসে ৭২ বছরেরও বেশিতে উন্নীত হয়েছে। শহর-নগরের জনসংখ্যা ১৯৭২ সালে ছিল ১০ শতাংশ। ২০২০ সালে বেড়ে ৩১.৫১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আর দরিদ্রতার হার ১৯৭৫ সালে ৮৩ শতাংশ থেকে ২০২০ সালে ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়ার সাথে সাথে দারিদ্র্যের সংখ্যাও কমেছে। অন্য দিকে যেমন খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টির জোগান বেড়েছে, তেমনি দরিদ্রতার হার কমার সাথে সাথে জনগোষ্ঠীর গড় আয়ু বেড়েছে।
জাতিসঙ্ঘ জনসংখ্যা তহবিল (UNFPA) এর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘২০৫১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ন্যূনতম ২১০ মিলিয়ন (২১ কোটি); সর্বাধিক ২৪৫ মিলিয়ন (সাড়ে চব্বিশ কোটি)। আরো অনুমান করা হয়েছে যে, ভবিষ্যতে ‘অর্থনীতি, শিল্পায়ন ও নগরায়ণের পথে আরো এগিয়ে যাবে। এ কারণে অর্থনীতিতে কৃষির হিস্যা আরো কমে যাবে।’ সে জন্যই কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ দ্রুততর হওয়া দরকার। এছাড়া বাস্তবতা হলো, বিদ্যমান প্রযুক্তির উন্নয়ন ও নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে এবং কৃষি গবেষণায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি। প্রযুক্তির উন্নয়ন ও নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সরেজমিনে প্রয়োগ করার লক্ষ্যে সরকার ও বেসরকারি খাত উভয় এক যোগে কাজ করা অত্যাবশ্যক। অতীত ইতিহাস প্রমাণ করে যে, কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বাড়লে পল্লীর অকৃষি (কৃষিবহির্ভূত) অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি দ্রুততর হয়। পল্লী অঞ্চলে বলিষ্ঠ অকৃষি অর্থনীতি ও কৃষিতে উৎপাদনশীলতা, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়নের গতিকে দ্রুততর করবে।
ইতিহাসের সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে নিঃসংশয়ে বলা যায়, কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা; শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও আধুনিকায়নের প্রাথমিক ভিত্তি নির্মাণে যে পরিবেশ প্রয়োজন, তার ভিত্তি তৈরিতে কৃষি খাত অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আজকের অধিকাংশ উচ্চ আয় ও শিল্পায়িত দেশে উন্নয়নের প্রাথমিক স্তরে এবং পরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও দরিদ্রতা হ্রাসে কৃষি খাত মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এটি প্রমাণিত যে, নানা ধরনের সংযোগ তথা যোগসূত্রের মাধ্যমে, কৃষি খাতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি, শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। এ জন্যই জিডিপিতে বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষির যে বিবৃত হিস্যা দেখানো হয়, তার চেয়ে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষির অবদান আরো বেশি বলে বিবেচিত হওয়া আবশ্যিক। অনেকে সেটাই মনে করেন।

আয় বাড়ার সাথে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন
বিশ্বের জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ২০৫০ নাগাদ মোট বিশ্ব জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৯০০ কোটিতে। সবুজ বিপ্লব, যে প্রযুক্তির ব্যবহারে ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে সেটা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। এ প্রযুক্তির ব্যবহারে অতিরিক্ত উৎপাদনশীলতার সম্ভাবনা সীমিত হয়ে পড়েছে। দিনের পর দিন অতিমাত্রায় একই উপকরণ ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো কঠিন। এ ছাড়াও, রাসায়নিক সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে আবাদি জমির মৃত্তিকার উর্বরতা কমছে। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে কৃষি জমি দিন দিন কমছে। জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। এখানে-সেখানে চরম-নিদারুণ আবহাওয়া নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবহাওয়া এখন আর কৃষি মৌসুমের সাথে খাপ খাচ্ছে না। এদিকে, ফলনে অনিশ্চয়তা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। অন্য দিকে মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। বাড়তি আয় ও নগরায়ণের সাথে সাথে, খাদ্যাভ্যাসও বদলাচ্ছে। এখন কেবল প্রধান খাদ্যশস্য বা দানা শস্যের (ধান) উৎপাদন বাড়ালেই হবে না। চাহিদা মাফিক অন্যান্য খাদ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে বর্ধিষ্ণু ও সমৃদ্ধ জনসমষ্টির চাহিদা মেটাতে হবে। বর্তমানে নানা ধরনের মিশ্র খাদ্যকে যথার্থ খাদ্য বলে মনে করা হয়। খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। নাগরিকরা আশা করে, খাদ্যাভ্যাসের সাথে তাল মিলিয়ে সরকার তাদের এই মৌলিক চাহিদা পূরণে সহায়তা করবেন।

খাদ্যাভ্যাসের সাথে তাল মিলিয়ে কৃষি পণ্য উৎপাদন
মূল খাদ্য ছাড়া অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর বিষয়ে আমাদের চিন্তা, ধ্যান-ধারণা, জ্ঞান ও প্রযুক্তির বিরাট ঘাটতি রয়েছে। এটা যেমন এক দিকে বিরাট সুযোগ, অন্য দিকে আবার বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তার জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সুযোগ নিতে পারে বিজ্ঞানী সমাজ, বেসরকারি খাত, সরকার এবং একে অপরের সহযোগিতায়। খাদ্যের গুণগত মান, পরিমাণ বৃদ্ধি ও খাদ্যাভ্যাসের সাথে ভারসাম্য রেখে কৃষি পণ্য উৎপাদনের জন্য আমাদের অবশ্যই একটা কৌশলগত স্বপ্নকল্প থাকতে হবে। দেশের রাজনীতিক ও কর্মকর্তারা হরদম বলে চলেছেন ‘আমরা খাদ্যে স্বনির্ভর’। আর আমরা সবাই উৎকর্ণ হয়ে ভাবছি, চালের উৎপাদন বাড়িয়েই খাদ্য সমস্যা দূর করা যাবে। এতে চালের জোগান হতে পারে যথেষ্ট, তবে খাদ্য সমস্যা দূর হবে না। তাই চালও প্রতিনিয়ত আমদানি করতে হয়।
এই আত্মতৃপ্তি অদূরভবিষ্যতে বর্ধিষ্ণু ও বিত্তবান নাগরিকদের খাদ্য সমস্যাকে বহু গুণে বাড়িয়ে দেবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী স্ফীত হচ্ছে। পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাসের ফলে তারা ইতোমধ্যে বিরাজমান খাদ্যচাহিদা ও পণ্য উৎপাদনের মাঝে একটি অদৃশ্য চাপ সৃষ্টি করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাড়তি আয় সাধারণ রীতিতেই ভিন্ন ভিন্ন খাদ্যের ওপর ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলে। বেনেটের সূত্রে (১৯৫৪) বলা হয়েছে, ‘মাথাপিছু আয় বাড়ার পাশাপাশি এগিয়ে যায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন। সাথে সাথে ভোক্তারা দানা শস্যের ওপর একান্ত নির্ভরতা থেকে ক্রমবর্ধমান হারে সরে যায়। সেই সাথে চাহিদা বাড়তে থাকে, ফলমূল, সবজি, রান্নার তেল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও প্রাণীজ প্রোটিনের ( ডিম, গোশত, দুধ ও মাছ)।’

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা
১৯৫০-এর দশকে পৃথিবীর বহু দেশ একই ধরনের খাদ্য সমস্যার মোকাবেলা করে। তখন সমস্যার সমাধান খুঁজতে বারবার নানা প্রশ্নের অবতারণা করা হয়। তার নানা প্রতিফলন সর্বত্র পরিলক্ষিত। শেষ পর্যন্ত ওই সব প্রশ্নের সমাধানে সবাই একমত পোষণ করেন যে, ‘‘কৃষি খাতে আরো বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন এবং উৎপাদিত পণ্যে বৈচিত্র্য আনা জরুরি।’ অতঃপর নীতি-নির্ধারকদের সব মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল ‘অধিকতর খাদ্য উৎপাদনে’। বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। এই বিনিয়োগের সুফলে জন্ম নেয় ‘সবুজ বিপ্লব’। ফলে খাদ্য উৎপাদন বেড়ে যায়। আকাল-মন্বন্তর বিদায় নেয়। দরিদ্রতা হ্রাস পায়। জীবনধারণে পুষ্টিমান বাড়ে। এ সবের কল্যাণে মানুষ আজ ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী এবং অনেক বেশি উৎপাদনশীল। অতএব, ভবিষ্যতে ভাত-মাছ-তরকারিই একমাত্র খাদ্য থাকবে না। কেননা সমাজের আধুনিকায়ন ঘটবে। মানুষ প্রাচুর্য্যরে অধিকারী হবে। আয় উত্তরোত্তর বাড়তে থাকবে। দেশ আরো শিল্পায়িত হবে ও নগরায়ন বাড়বে। সেই সাথে তাল মিলিয়ে দেশের মানুষ আরো প্রোটিন (আমিষ) ও পুষ্টিকর খাদ্য দাবি করবে। এ কারণেই আগামীর চাহিদা মেটাতে অবশ্যই নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। দেশে শর্করা খাদ্যের অভাবজনিত আকাল সম্ভবত আর দেখা দেবে না। তবে এখন থেকে উৎপাদনের কৌশল না বদলালে, আমিষ ও পুষ্টিকর খাদ্যের দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। কেবল চাল উৎপাদন বাড়িয়ে ‘আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে রাস্তায় চিৎকার দিতে থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না বরং আরো বাড়বে।’

কৃষি খাতে বিনিয়োগ
সবুজ বিপ্লবের সুফলে নতুন জাতের ফসলের প্রবর্তন করা হয়। অগ্রসর প্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষি উৎপাদনের রীতি-পদ্ধতি বদলে যায়। সেই সাথে খাদ্য সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটে। সব কিছু মিলে কৃষি উৎপাদন ও খাদ্যের লভ্যতা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। বর্তমানে অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে, যেমন জলবায়ুর পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ন, জীবনমানে উন্নয়ন ও খাদ্যাভ্যাস বদলে যাওয়া, ইত্যাদি।
যেভাবেই মূল্যায়ন করা হোক, বিগত দশকে কৃষি খাতের গবেষণায় বিনিয়োগ অনেকাংশে কমে গেছে, বা স্থির হয়ে আছে। ইতোমধ্যে ‘সবুজ বিপ্লব’ তার শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে। উচ্চ ফলনশীল বীজ, সেচসুবিধা, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক সবুজ বিপ্লবের ভিত্তি ছিল। একই প্রযুক্তিতে ফসলের বীজ আর উন্নত হবে না, উৎপাদনশীলতাও আর বাড়বে না। যতই পানি, সার, কীটনাশক ব্যবহার করা হোক না কেন, ফলনও তেমন বাড়বে না। তাছাড়া বহু দেশে পানির উৎস শুকিয়ে ক্রমেই দুর্লভ হয়ে উঠছে, জলাধারে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে ও পানি দূষিত হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক, পরিবেশ দূষণও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক বলে প্রমাণিত হয়েছে। রাসায়নিক সারের ব্যাপক প্রয়োগে মৃত্তিকা মানের অবনতি ঘটেছে। মৃত্তিকার পুষ্টি কমে যাওয়ায় ফসলের ফলন কমছে। তাই এখন চ্যালেঞ্জ হলো কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর নতুন উপায় বের করা। অর্থাৎ জমি, পানি, শ্রম, সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে কম। কিন্তু খাদ্য উৎপাদন করতে হবে বেশি। নতুন সমস্যার সমাধান করতে হলে, উদ্ভাবন করতে হবে আরো বেশি জৈব ও অজৈব চাপ সহ্য করার শক্তিসম্পন্ন জাতের উদ্ভিদ। প্রাণবিজ্ঞানের (Bio-Science) আওতায় প্রাণপ্রযুক্তি (Bio-technology), উদ্ভবসম্বন্দ্বীয় প্রকৌশল (genetic engineering), উপাত্ত (data) ও কম্পিউটার বিজ্ঞান, এই তিন প্রযুক্তি একত্রে সমাবিষ্ট হয়ে ইতোমধ্যেই কৃষি খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আমার ধারণা, প্রতিশ্র“তিময় প্রাণপ্রযুক্তি দিয়েই আগামীতে কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা ও খাদ্যাভ্যাসের সাথে তাল মিলিয়ে খাদ্য উৎপাদনের সমস্যা মোকাবেলা করা হবে। এই প্রযুক্তি এখন মানুষের হাতের মুঠোয়।

নতুন বিজ্ঞান-প্রাণপ্রযুক্তি
১৮ শতকে কয়লা ব্যবহারের প্রযুক্তি ও কয়লা চালিত বাষ্পীয় ইঞ্জিনের উদ্ভাবনের পর থেকে সভ্যতার এক নতুন দিগন্ত শুরু হয়। বিশ শতকের শেষের দিকে ছয়টি নতুন প্রযুক্তি, যেমন; মাইক্রো-ইলেকট্রনিক্স, কম্পিউটার, টেলি-যোগাযোগ, মানুষের তৈরি কৃত্রিম উপাদান (প্লাস্টিক, নাইলন, পলিয়েস্টার) ইত্যাদি মিলে মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছে নতুন করে আরেক বাস্তবতা। যোগ করেছে নতুন মাত্রা, যা এর আগে ছিল অচিন্তনীয় ও অভাবনীয়। বিগত কয়েক দশক ধরেই মানুষ রাত-দিন তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি দেখেছে, শুনেছে এবং বর্তমানে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করছে। সম্ভবত ইন্টারনেট আবিষ্কার ও সার্বজনীন ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের এক অভাবনীয় আশা পূরণ হয়েছে। খাদ্য উৎপাদনে সবুজ বিপ্লবের মতো এটাকে বলা যায় ‘যোগাযোগ বিপ্লব অথবা তথ্য-প্রযুক্তি বিপ্লব।’
এখন বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক ও আবিষ্কারকরা তিনটি প্রযুক্তির অগ্রগতি সাধনে ব্যস্ত। এগুলো হলো; প্রাণ-প্রযুক্তি, রোবোটিক্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ও ন্যানো প্রযুক্তি। ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে পদার্থের মৌলিক একক ইউনিটের কর্ম-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃতি বা সৃষ্টিকে বোঝার চেষ্টা করা; যেমন ফোটন হলো আলোক কণা বা আলোকের একক ইউনিট। আর ন্যানোর অর্থ হলো, ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ বোঝাবার জন্য ব্যবহৃত উপসর্গ। এ প্রবন্ধে মূল বিষয় কৃষি। সাম্প্রতিককালে প্রাণ-প্রযুক্তির অগ্রগতি কৃষি খাতের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বহন করে বিধায় এ প্রবন্ধে এ বিষয়ে বিষদ আলোচনা অপরিহার্য।
বিগত কয়েক বছরে সবচেয়ে বিশাল ও নাটকীয় অগ্রগতি ঘটেছে সম্ভবত প্রাণপ্রযুক্তিতে। এই প্রযুক্তি বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যখন আমাদের মতো বয়স্ক কিন্তু বিজ্ঞানে অমনস্ক, মাথা মোটা মানুষরা একমাত্র মৌলিক বা জন্ম সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান (genetic) নিয়ে টুকটাক কথাবার্তা বলছি। পাশাপাশি আরেক দল, যারা বিজ্ঞানমনস্ক, উন্নত মেধার লোক, যারা সুস্থভাবে বেশি আয়ু নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য নিজ নিজ দেহে ভাইরাস ও জীবাণুর প্রবেশ করাচ্ছে। বিজ্ঞানের সাময়িক পত্রিকাগুলোতে একটু চোখ বোলালেই এ ব্যাপারে কারো মনে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবে না।
এই নতুন প্রযুক্তি অদূর ভবিষ্যতে যে কোনো প্রাণী, উদ্ভিদ, পোকা-মাকড় ভাইরাস ও জীবাণুর চরিত্রবৈশিষ্ট্য বদলে দিতে পারে। নতুন এই প্রযুক্তি সব জীবাণুর বেলায় প্রযোজ্য। এই বিজ্ঞানের বদৌলতে আমরা এখন জানি যে, আণবিক পর্যায়ে বা আনুভূমিকত্বে (Molecular level) জীবকোষ কার্যত একইভাবে কাজ করে। প্রতিটি জীবকোষে রয়েছে তার জীবন বা প্রাণের নীল নকশা। এ হলো জীব-কোষের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই নকশার নাম ডিএনএ (ডিক্সিরাইবোনিউক্লেয়িক অ্যাসিড), বাংলা অভিধান মতে, জীবের সূক্ষ্ম সূত্র বা তন্তু। এটা দেখতে একটা লম্বা মই আকৃতির যুগল পরমাণুসমাবেশ সদৃশ ছড়ের (strand) মতো। এই রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অণু-মাফিক পদার্থ (Molecular) দিয়ে ডিএনএ গঠিত। এ জন্য অনেকে সহজ করে ডিএনএ-কে বলেন জীব-জীবাণুর ‘রাসায়নিক বর্ণমালা’। এই রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তন্তু জীবকোষে সর্পিলসদৃশ প্যাঁচানো অবস্থায় থাকে। এই পেঁচানো তন্তুর (সূক্ষ্ম সূত্র) লপ্তে লপ্তে (Stretch) সাজানো (বিন্যস্ত) রয়েছে অনেক স্বতন্ত্র, স্পষ্ট ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জিন (gene) বা বাংলায় বলা যায় বংশানু। এই বংশানু (জিন) যে কোনো জীবের নির্দিষ্ট বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য (heritance) বা প্রলক্ষণগুলোকে (traits) পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। এক কথায় বলা যায় যে, জীবের জীবন বৈশিষ্ট্যের সব কিছু নির্ধারণ করে। অর্থাৎ ডিএনএ‘র ছড়গুলোতে (সূক্ষ্ম সূত্র বা তন্তুতে) রয়েছে গোটা জীবন নির্দেশনার সেট। এই নির্দেশনা সেটে রয়েছে জীবসত্তার সব কিছুর ব্যাখ্যা। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে এই নির্দেশনাকে বিন্যাস ও পুনর্বিন্যাস করা যায়। বিজ্ঞানীরা এখন এসব বংশানুর (জিন) ব্যাখ্যা বহুলাংশে পড়তে ও বুঝতে পারেন। সেই সাথে নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে বিজ্ঞানীরা জীবের দেহের আকৃতি, প্রকৃতি, রং, বুদ্ধিমত্তা, বলতে গেলে, প্রায় সব কিছু বুঝতে পারেন। এমনকি সংশোধন, পুনঃসংশোধন ও রদবদল করে দিতে পারেন।
আজকাল যদি কেউ প্রশ্ন করে; ‘তোমার গায়ের রং কেন তোমার মায়ের মতো, তোমার খাওয়ার অভ্যাস তোমার বাবার মতো কিভাবে হলো বা তুমি তোমার দাদার মতো খাটো কেন- এসব প্রশ্নের জবাব অতি সহজেই পাওয়া যাবে ‘জিনে বা বংশানুতে’। এর অর্থ, আমাদের চামড়ার রং, খাদ্যাভ্যাস, দেহের উচ্চতা, চরিত্রের সব বৈশিষ্ট্য জিন দ্বারা নির্ধারিত ও পরিচালিত। এই জিন (বৈশিষ্ট্য বা প্রলক্ষণ) এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে স্থানান্তরিত হতে থাকে। অর্থাৎ এই সব বৈশিষ্ট্য, পূর্বপুরুষ থেকে দাদা-দাদী, তারপর পিতা-মাতার মাধ্যমে পরবর্তী বংশধরে, অর্থাৎ এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে নিরন্তর স্থানান্তরিত হতে থাকে। অতএব, সত্যি যে, মানুষের বৈশিষ্ট্য বা প্রলক্ষণ পূর্ব পুরুষদের থেকে পাওয়া। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে সেটাই জীবের উত্তরাধিকার (heritance) সূত্রে পাওয়া গুণাবলী (জন্মগত বৈশিষ্ট্য)। এ প্রক্রিয়া সব জীব-জীবাণুর বেলায় প্রযোজ্য।

সাম্প্রতিককালে বিজ্ঞানীরা এই রাসায়নিক বর্ণমালাগুলোকে (ডিএনএ) বিশেষ আকারে ধারাবিন্যস্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। সহজভাবে বলা যায় যে, বিজ্ঞানীরা এখন মানুষের দেহকোষের ভেতরে থাকা ৩০০ কোটি রাসায়নিক বর্ণমালার যুগল ইউনিট ও ২৫০০০ বংশানুকে অনুক্রমিকভাবে সাজাতে পারেন। জিনের এই ধারাবিন্যস্ততা বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় জিনোমি সিকিয়োনসিং (genome sequencing) বা সৃষ্টিগ্রন্থ। একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ সূত্রেই দাবি করেছেন, আমরা প্রকৃতির ভাষা পাঠ করতে পেরেছি। বিজ্ঞানীরা এখন ডিএনএ-ছড়ের (Strand) মধ্যে থাকা বংশানুকে আলাদা করে দেখতে পারে এবং ঐ বংশানুতে বিরাজমান তথ্যের দূরদর্শন করতে পারেন। অর্থাৎ ঐ জিনের কর্ম-ক্রিয়া-প্রক্রিয়া বুঝতে সক্ষম। এই প্রযুক্তি এখনো অগ্রসরমান। আমরা মাত্র শুরু দেখছি। শেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, এ কথা এখনো বলা যাবে না। একমাত্র আল্লাহ জানেন।
তবে সর্বশেষ অগ্রগতি পর্যালোচনা করলে ধারণা করা যায়, সেই দিন বেশি দূরে নয়, যখন মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অংশ মেরামতের মূল হাতিয়ার হিসেবে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে। অচিরেই হয়তো মানুষ তার নিজ পছন্দ অনুযায়ী আকার, আকৃতি ও পছন্দসই রঙের শিশুর জন্য ফরমায়েশ দিতে পারবেন। বিদেশী গোলাপ ফুল বা ফল দেখলেই এ বিষয়ে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। আগের তুলনায় এখন গোলাপ ফুলের আকার, আকৃতি, প্রকৃতি, রং বদলে যাচ্ছে। এ ধরনের সৃষ্টি ও নিজ আবর্তন-বিবর্তন মানব সভ্যতাকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা কেবল সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আল্লাহ নিজেই জানেন। তবে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে, সৃষ্টিলগ্ন থেকে শুরু করে এই প্রথমবারের মতো মানুষ তার নিজের দেহের সব কিছু বদলে দেয়ার সামর্থ্য অর্জন করতে চলেছে।
নতুন প্রজন্মের সিকোয়েন্সিং মেশিন (NGS), ২০০০ সালের মেশিনের তুলনায় বহুগুণে শক্তিশালী। দেড় দশক আগে যখন মানব জিনের ধারাবিন্যাসের কাজটি করা হয় তখন বহু দেশের, বহু বিজ্ঞানী ও গবেষণাগার একত্রে কাজ করেছে। বলাবাহুল্য, এ কাজ শেষ করার লক্ষ্যে ঐসব দেশের সরকার শত শত কোটি মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছে। গোড়ার দিকে হিসাব করা হয়েছিল মানব জিনোমির ধারাবিন্যাস করতে দশ বছরের মতো সময় ও সাত থেকে দশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হবে। তবে মাঝপথে অধিক শক্তিশালী ও গতিসম্পন্ন যন্ত্র ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে, গোটা ধারাবিন্যস্ত করার কাজটি মাত্র তিন বছরে সম্পন্ন হয়।
২০১০ সালে বাংলাদেশ পাটের জিনোমির ধারাবিন্যস্তকরণ করে। বিদেশী বিজ্ঞানী ও গবেষণাগারের সাহায্যে এক বছরেরও বেশি সময় নিয়ে কাজটি সম্পন্ন করা হয়। এ কাজ সম্পন্ন করতে খরচ হয় কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৫ সালে বাংলাদেশী মহিষের জিনোমির ধারাবিন্যস্তকরণ করা হয়। এ কাজে সহায়তা করে চীনের বেইজিং জিনোমি ইনস্টিটিউট। ঐ সময়ে এই কাজটি ছয় মাসে সম্পন্ন করা হয়। তখন খরচ হয় ৩ লাখ মার্কিন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হিউম্যান জিনোমি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বক্তব্য অনুযায়ী। এ ধরনের ধারাবিন্যস্ত কাজের জন্য ২০০১ সালে ব্যয় হতো ১০ কোটি মার্কিন ডলার ও তিন বছর, সেই একই কাজটি করার জন্য বর্তমানে প্রয়োজন মাত্র ১০০০ মার্কিন ডলার ও সময় লাগে মাত্র ২ থেকে ৩ দিন। এ থেকে বোঝা যায় যে নতুন এই প্রযুক্তির কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে। তবে এখনো অগ্রসরমান। আগেই বলা হয়েছে, জিনোমি হলো জীবের ‘উদ্ভব (সৃষ্টি) সম্বন্ধীয় উপাদান বা উপকরণের পরিপূর্ণ সাজানো সেট।’ খাঁটি বাংলায়- ‘জীবন বা সৃষ্টি সম্বন্ধীয় সর্ব মাল-মসলা।’
লেখক : এমএসসি- কৃষি অর্থনীতি
সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই


আরো সংবাদ



premium cement
সকল কাজের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি থাকতে হবে : মাওলানা হালিম বিএনপি জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি করে : ড. মঈন খান সাজেকে পাহাড়ি খাদে পড়ে মাহিন্দ্রচালক নিহত জমি রেজিস্ট্রি করে না দেয়ায় বাবার কবরে শুয়ে ছেলের প্রতিবাদ ইসরাইলি হামলায় গাজায় আরো ৭১ জন নিহত পানছড়ি উপজেলায় চলমান বাজার বয়কট স্থগিত ঘোষণা আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করেছে : দুদু যুক্তরাষ্ট্র টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের এন্ডারসন লড়াই ছাড়া পথ নেই : নোমান জার্মানির অর্থ যেভাবে সিরিয়ায় যুদ্ধাপরাধে ব্যবহার হচ্ছে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোশাররফ হোসেনের মেয়াদ বাড়ল

সকল