২৩ মার্চ ২০২৩, ০৯ চৈত্র ১৪২৯, ৩০ শাবান ১৪৪৪
`

রমজানে অস্বাভাবিক ব্যয়বৃদ্ধির বার্তা!

-

ঢাকার একটি দৈনিকে সোমবার খবর বেরিয়েছে এবার রোজায় ব্যয় বাড়বে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে এমনিতে মানুষের জীবনে সীমাহীন দুর্ভোগ নেমে এসেছে। এর মধ্যে নতুন করে আবার ব্যয়বৃদ্ধির খবর মানুষকে আরো বিপদে ফেলে দেয়ার ইঙ্গিত।
গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে কয়েক দফা। কিন্তু তার পরও মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ থামছে না। সরকার দাম বাড়িয়ে চলেছে। কয়েক দিন আগে বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার আবার কেন বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে? এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুখ খুলেছেন। ঢাকার আগারগাঁওয়ে ‘বিনিয়োগ ভবন’ উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুতে আর কত ভর্তুকি দেওয়া যায়? এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় ১২ টাকা। সেখানে বিদ্যুতের দাম হিসাবে আমরা নিচ্ছি মাত্র ছয় টাকা। তাতে অনেক চিৎকার শুনি। গ্যাস-বিদ্যুৎ সাপ্লাই দেওয়া যাবে, যদি সবাই ক্রয়মূল্য যা হবে সেটি দিতে রাজি হয়, তাহলে দেওয়া যাবে।’ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, বিদ্যুতের দাম, গ্যাসের দাম এবং জ্বালানি তেলের দাম এই যে বেড়েছে সেটিই শেষ নয়, আগামীতে আরো বাড়বে। আইএমএফের কথা যদিও তিনি বলেননি। ভর্তুকির ওপরই জোর দিয়েছেন। বলেছেন, আর কত ভর্তুকি দেওয়া যায়? আগামীতে যে ভর্তুকি দেওয়া হবে না তাও তার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে। বলেছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের ক্রয়মূল্যে আগামীতে তা সরবরাহ করা হবে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো শুরু হয়েছে মাত্র। এটাকে গ্যাস-বিদ্যুতের উৎপাদন মূল্যের সমান নিয়ে যাওয়া হবে সেটাই বোঝা যাচ্ছে। আর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিটি পণ্যমূল্য বেড়ে যাবে। ফলে আগামীতে জনজীবন যে আরো কঠিন ও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে সে কথা অনায়াসে বলা যায়।

আগামী মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মাহে রমজান শুরু হচ্ছে। পবিত্র রমজান মুসলমানদের জন্য রোজা পালনের মাস। রমজান রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। কিন্তু মানুষ যে দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে, স্বাভাবিকভাবে আল্লাহর দরবারে এ মাসে ইবাদত-বন্দেগি করবেন সেই সুযোগটুকু পাওয়ার উপায় নেই। এক দিকে সরকারের ভুলনীতি ও বাস্তবভিত্তিক ও জনবান্ধব সিদ্ধান্ত না নেয়া, অন্য দিকে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে রমজানে জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। প্রতিবার রমজান এলে এমন হয়। তবে এবার আগেই আলামত শুরু হয়েছে; তাতে বোঝা যাচ্ছে দুব্যমূল্য কী অসহনীয় পর্যায়ে যাবে।
এবার রোজায় ব্যয় বাড়বে বলে পত্রিকায় যে খবর বেরিয়েছে তাতে বলা হয়, রোজায় চাহিদা বেড়ে যায় ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, ডাল ও খেজুরে। এর বাইরে চাল ও আটা-ময়দার চাহিদা সব সময় থাকে। চাল বাদে বাকি পণ্যগুলোর চাহিদার বেশির ভাগ মেটানো হয় আমদানি করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমদানি কম। ইতোমধ্যে তেল, চিনি, ছোলাসহ নিত্যপণ্যের দাম গত রোজার চেয়ে অনেক বেশি। রোজার বাকি আরো দেড় মাস। তখন পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, সেটিই দেখার বিষয়। ব্যবসায়ীরা আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারেননি ডলার সঙ্কটে। বর্তমানে ঋণপত্র খোলা শুরু হয়েছে। সামনে কতটা আমদানি সম্ভব হবে সেটাই দেখার বিষয়।
গত রোজায় খুচরা বাজারে ছোলার দাম ছিল কেজি প্রতি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। সেই ছোলা এখন প্রতি কেজি ৮৫ থেকে ৯৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দাম বেড়েছে ২৪ শতাংশ। রমজানে ছোলা কিনতে হবে এর চেয়েও বেশি দামে। ছোলার আমদানি ব্যয় বেশি এবং সরবরাহ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। একই চিত্র ভোজ্যতেল, চিনি, আটা-ময়দার মতো বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে। নিত্যপণ্য আমদানি এখন পর্যন্ত সন্তোষজনক নয়।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসেবে, দেশে ১৮ লাখ টনের মতো সয়াবিন ও পাম তেলের চাহিদা আছে। রোজার বাজারে ভোজ্যতেলের চাহিদা সাড়ে তিন লাখ টনের মতো। তেল সাধারণ অপরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করে পরিশোধন করা হয়। আবার বীজ আমদানি করে তেল উৎপাদন করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। দেশে গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি তিন মাসে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার টন যা এক বছর আগের এ সময়ের তুলনায় ৪৪ শতাংশ কম।
সয়াবিন বীজ আমদানি ৮৩ শতাংশ কম। চাহিদা অনুযায়ী যদি ভোজ্যতেলের আমদানি এ সময়ে না হয় তাহলে তেলের দাম অনেক বেড়ে যাবে এবং শঙ্কা দেখা দেবে। গত রোজায় টিসিবির হিসাব বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৫৮ থেকে ১৭০ টাকা, যা এখন ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকা। রোজার সময় এই দাম আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে।

দেশে চিনির চাহিদা বছরে সাড়ে ২৪ লাখ টন। রোজায় তিন লাখ টন চিনির প্রয়োজন হয়। বিগত তিন মাসে চিনি আমদানি হয়েছে ছয় লাখ ৮২ হাজার টন। বাজারে চিনির দাম বেড়েছে। সরকার চিনির দাম প্রতি কেজি ১০৭ টাকা ঠিক করে দিলেও বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। অথচ গত রোজায় প্রতি কেজি চিনি ছিল ৮০ টাকার নিচে। তেমনি ছোলার আমদানিও কমেছে। বিগত তিন মাসে ছোলা আমদানি হয়েছে ৪৩ হাজার টন যা গত বছরের এ সময়ের তুলনায় অর্ধেক। বাজারে আটা-ময়দার দাম যেমন চড়া, তেমনি গম আমদানিও কম। খেজুরের আমদানিও বেশি কমেছে। রোজায় খেজুরের চাহিদা থাকে ৫০ হাজার টনের; কিন্তু বিগত তিন মাসে আমদানি হয়েছে মাত্র ২২ হাজার টন। এসব তথ্য ও বার্তা বলছে, রমজানে পণ্য সঙ্কট থাকবে এবং দাম বাড়বে।
বাজারে মাছ-গোশতেরও অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষজন ব্রয়লার মুরগি কিনে থাকেন। কিন্তু ব্রয়লার মুরগিরও দামও প্রতি কেজি এখন ২০০ টাকা। দৈনিক পত্রিকায় রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে বাজার পরিস্থিতির যে রিপোর্ট ছাপা হয়েছে তাতে বলা হয়, শুধু ব্রয়লার মুরগি নয়, গরুর গোশতের দামও বেড়েছে। এটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৭২০ টাকা কেজি। টিসিবির হিসাবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এখন ডিমের দাম ২৩ শতাংশ বেশি। মাছের দামেও ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। তেমনি মসলার মধ্যে রসুন ও আদার দাম বেড়েছে। সবজির দাম এখন পর্যন্ত স্থিতিশীল। তবে রোজা শুরু হলে তা আর স্থিতিশীল থাকবে না। বর্তমানে শীতকালের সবজি পাওয়া যাচ্ছে।
সংবাদপত্রের আরেকটি খবর উদ্বেগজনক। তা হচ্ছে ওএমএসের চাল কেনার জন্য ট্রাকের সামনে মানুষের ভিড় বাড়ছে। প্রতিদিন লাইনে দাঁড়িয়েও অসংখ্য মানুষ ন্যায্যমূল্যে চাল কিনতে না পেয়ে খালি হাতে ফেরত যাচ্ছেন।
রমজান আসন্ন। সরকার এখনই বাজারে নজর না দিলে এবং সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে সহানুভূতিশীল না হলে জনজীবনের বিপদ ও ভোগান্তির শেষ হবে না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
ই- মেইল : abdal62@gmail.com


আরো সংবাদ


premium cement