১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অবশেষে আইএমএফের ঋণ অনুমোদন, স্বস্তিতে সরকার

-

বাংলাদেশের বহু প্রত্যাশিত ঋণের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। মোট ৪৭০ কোটি ডলারের এই ঋণের সুবাদে দুর্বল হয়ে পড়া রিজার্ভের বিপরীতে বিদেশী মুদ্রার একটি ‘বাফার’ তৈরির সুযোগ পাবে। সাড়ে তিন বছরের চুক্তিতে সরকারের ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিতে’ সহায়তা দিতে আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি-ইসিএফ এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি-ইএফএফ থেকে ৩৩০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে। এ ছাড়া আইএমএফের নবগঠিত রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় পাবে ১৪০ কোটি ডলার। আগামী ৪২ মাসের মধ্যে সাতটি কিস্তিতে দেয়া হবে এ ঋণ। এর মধ্যে ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিকভাবে ছাড় করা হবে। অবশিষ্ট ছয় কিস্তির প্রতিটিতে ৭০৪ মিলিয়ন ডলার করে ঋণ ছাড় করা হবে। ঋণের শেষ কিস্তি আসবে ২০২৬ সালে।
করোনা অতিমারীর প্রভাব সামলে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছিল বাংলাদেশ, কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বড় ধরনের চাপে পড়েছে; ডলারের বিপরীতে মান হারিয়ে চলছে টাকা; মূল্যস্ফীতিও পৌঁছেছে উদ্বেগজনক পর্যায়ে। এমন পরিস্থিতিতে গত জুলাই মাসে আইএমএফের কাছে ঋণ চায় বাংলাদেশ; ছয় মাসের ব্যবধানে তা অনুমোদিত হলো। সরকার মনে করে, এই ঋণ প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত করতে, দুর্বল হয়ে পড়া রিজার্ভের বিপরীতে বিদেশী মুদ্রার জন্য ‘বাফার’ হিসেবে কাজ করে সংস্কার ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণে, উৎপাদনশীলতা বাড়াতে, জলবায়ু সহনশীলতা তৈরি, তাৎক্ষণিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সমস্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় এই ঋণ কাজে আসবে। অর্থমন্ত্রী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ঋণদাতা এ সংস্থার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আইএমএফের এই ঋণ মঞ্জুরির মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতির সক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে। প্রমাণিত হলো, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক এলাকাগুলো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যা অনেক দেশের তুলনায় ভালো।’

যে বাস্তবতায় ঋণ নিচ্ছে সরকার
আইএমএফ থেকে ঋণ চাওয়ার কারণ হিসেবে সরকার বলেছে, বিশ্ববাজারে অভূতপূর্ব হারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্য ও নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। বৈশ্বিক সঙ্কটে প্রায় এক বছরে চাল, গম, ভুট্টা, সার, ভোজ্যতেলের মতো ৯টি পণ্যে বাড়তি গুনতে হয় ৭৬০ কোটি ডলার। আমদানিতে নাটকীয় উত্থান হয় দেশে। ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে আমদানি বাড়ে ৩৯ শতাংশ। বাণিজ্য ঘাটতিও দাঁড়ায় দুই হাজার ৮২৩ কোটি ডলার। চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দেয় এক হাজার ৭২৩ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৭৮ কোটি ডলার।
ঋণ চাওয়ার পেছনে সরকার আইএমএফকে আরো জানায়, প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। অন্য দিকে, জলবায়ু পরিবর্তন শতাব্দী ধরে বাংলাদেশকে বিশ্বের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশে পরিণত করবে। ফলে দেশ হারাবে মোট দেশজ উৎপাদনের ১১ শতাংশ। এর প্রভাব মোকাবেলায় ১০০ বছরের ডেলটা পরিকল্পনা এবং পাঁচ বছর মেয়াদি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা করেছে সরকার। এ জন্য জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ অর্থ লাগবে। অর্থাৎ, অর্থনীতির বহিঃখাতকে স্থিতিশীল করা, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণে অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দেয়া, আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা ও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁঁকি মোকাবেলা করে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা- এই এ চারটি মূল লক্ষ্য হচ্ছে আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়ার কারণ।

ঋণ থেকে যা আশা করছে আইএমএফ
আইএমএফ বলেছে, ‘ইসিএফ ও ইএফএফের আওতায় যেসব প্রকল্প নেয়া হবে, সেগুলো সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা অক্ষুণœœ রাখা ও ঝুঁকিতে থাকাদের সুরক্ষিত করার পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভিত তৈরিতে সহায়ক হবে।’ আইএমএফ আরো বলে, বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহের ফল হিসেবে দেশের বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কটও মোকাবেলা, পাশাপাশি বাংলাদেশের সংস্কার কর্মসূচির গতি আরো ত্বরান্বিত করতে হবে।’ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার আকাক্সক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়ক হবে।
কর ও রাজস্ব প্রশাসনের সংস্কারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের কৌশল বাস্তবায়নে টেকসই বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। সরকারি ব্যয়, বিনিয়োগ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা আরো সুসংহত করতে সংস্কার কর্মসূচি নেয়া হলে তাতে আরো দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও ভালোভাবে সরকারি অর্থ ব্যয় নিশ্চিত করা যাবে। আর্থিক খাতের দুর্বলতা কমানো, তদারকি জোরদার এবং সুশাসন ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো শক্তিশালী করার পাশাপাশি পুঁজিবাজারের যথাযথ বিকাশ ঘটানো গেলে তা সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের জোগান দিতে সহায়ক হবে। বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য কাঠামোগত সংস্কার, আর্থিক খাতের গভীরতা বৃদ্ধি করে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা আরো বাড়বে।

ঋণ প্রাপ্তিতে যে সংস্কার করতে হবে
প্রধান শর্ত তিন খাতের সংস্কার করতে হবে বাংলাদেশকে। আইএমএফের ভাষায় এগুলো হচ্ছে- গুণগত মান উন্নয়নসংক্রান্ত শর্ত-কিউপিসি, অবকাঠামোগত মান উন্নয়নসংক্রান্ত শর্ত-এসপিসি ও সাধারণ প্রতিশ্রুতি। এর মধ্যে কিউপিসি ও এসপিসির শর্ত না মানলে কিস্তি আটকে যায়। কিউপিসির মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা, বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব পদ্ধতি ঠিক করা, জিডিপির তুলনায় অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহের হার বৃদ্ধি করা ইত্যাদি। এসপিসির মধ্যে জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে পদ্ধতি কার্যকর করা, আয়কর আইন সংসদে পাস করা, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা, আদায়ের অযোগ্য খেলাপি ঋণ বিষয়ে আলাদা কোম্পানি গঠন করা, কর ছাড়ের ওপর বিশদ নিরীক্ষা করা, বাজেটের নির্দিষ্ট অংশ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ রাখা ইত্যাদি।
দুর্নীতি কমানোর পাশাপাশি জ্বালানির দামে সমন্বয় ও বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়াসহ প্রায় ৩০টি শর্ত রয়েছে আইএমএফের ঋণচুক্তিতে। সরকারি ব্যয়ের বিপুল অপচয় কমানোর পরামর্শ দিয়ে বলেছে, এটি বাজেট ব্যবস্থাপনায় একটি বড় ব্যর্থতা। জ্বালানির দাম সমন্বয়ের কথা উল্লেøখ করেছে। যদিও আইএমএফ সারের ওপর ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ সরকার নিতে রাজি হয়নি, ফলে এটি শর্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
এ ছাড়া ঋণখেলাপির সংজ্ঞায় পরিবর্তন করে যেকোনো ঋণগ্রহীতা বর্তমানের ছয়টি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতার পরিবর্তে তিন কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে তাকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করার শর্ত দেয় তারা। আইএমএফের শর্তাবলির মধ্যে বাজেট ঘাটতি ৪.৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ করা এবং রাজস্ব বাড়ানোর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কর ছাড় বাতিলের পাশাপাশি রাজস্ব প্রশাসন সংস্কারের শর্ত আরোপ করেছে। এ ছাড়াও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন জোরদার করতে, জনসাধারণের আর্থিক ও ঋণ ব্যবস্থাপনা সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে।
আইএমএফের আরেকটি শর্ত ছিল- বছরে চারবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা, কিন্তু বাংলাদেশ তিনবার মুদ্রানীতি ঘোষণায় সম্মত হয় এবং বাস্তবায়ন শুরু করে। নতুন মুদ্রানীতিতে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকারও এক বিলিয়ন ডলার কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের সঞ্চয়পত্র ও পেনশন সুদের বরাদ্দ আলাদা করার শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। প্রথম কিস্তির আগে আইএমএফের শর্ত পূরণে সরকারের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। পরবর্তী ছয় কিস্তির বেলায় প্রতিটি কিস্তির আগে সরকারের কী কী শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে এমইএফপি। বোর্ড বাস্তবায়নে সন্তুষ্ট হলেই আইএমএফ ঋণ প্যাকেজের পরবর্তী কিস্তি দেবে।

আইএমএফের ঋণে দেশের সঙ্কট কতটা কাটবে
আইএমএফের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের শর্তানুযায়ী সরকারকে প্রধানত ব্যাংক, রাজস্ব ও জ্বালানি খাত সংস্কারে হাত দিতে হবে। সংস্কার ঠিকঠাক হলে সক্ষমতা বাড়বে। অর্থনীতির ক্রান্তিকালে আইএমএফ এ ঋণ দিয়ে পাশে দাঁড়ানোয় এক ধরনের দম পাবে বাংলাদেশ। প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তি যোগ করলে আগামী এক বছরে আইএমএফ থেকে পাওয়া যাবে ১০০ কোটি ডলারের মতো। এ অর্থসঙ্কট কাটানোর জন্য যথেষ্ট না হলেও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ পেতে সুবিধা হবে।
তিন বছর ধরেই বৈশ্বিক দুই বড় ঘটনার প্রভাবে টালমাটাল দেশের অর্থনীতি। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। কমে যায় প্রবাসী আয়। এর সাথে ঠিক সময়ে যথাযথ নীতি প্রণয়ন করতে পারেনি বাংলাদেশ; যেমন- ২০১৯ সালের আমদানি ব্যয় চার হাজার ৯০০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ২০২২ সালে আট হাজার ৯০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। ডলারের দাম বেড়ে যায়, তৈরি হয় ডলারের সঙ্কটও। পণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারছিল না ব্যাংকগুলো। ঋণের অনুমোদনের সংবাদে বিভিন্ন সংস্থা ও অর্থনীতিবিদরা মতামত ব্যক্ত করেন। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক বলেন, বৃহৎ অর্থে আর্থিক ব্যবস্থাপনা এখন গভীর সঙ্কটে। আইএমএফের ঋণ সাময়িক স্বস্তি দিলেও সঙ্কটের গভীরতা এত বেশি যে, এ ঋণে তা মেটানো কঠিন। ঋণ দরকার, তার চেয়েও বেশি দরকার এখন সংস্কার। এই সংস্কার নিজেদেরই করার কথা, তা এখন করতে হচ্ছে আইএমএফের কথায়। অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, প্রবাসী আয় যা আসছে তা হয়তো দেড়গুণ করা সম্ভব, যদি আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে অর্থ আনা যায়। আইএমএফের ঋণে সরকার আশা করছে এখন অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও ঋণ দিতে চাইবে। অথচ বেশি ঋণের পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে সুসংহত করা জরুরি।
বাংলাদেশ ছোট-বড় আকার মিলিয়ে আইএমএফ থেকে মোট ১০ বার ঋণ নিয়েছে আগে। এর মধ্যে ১৯৯০ সালে নেয়া ঋণের বিপরীতে আইএমএফের শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) চালু করা। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান তা সফলভাবেই কার্যকর করেছিলেন। বাণিজ্য উদারীকরণসহ ব্যাংক খাতের সংস্কারের শর্তও ছিল তখন। এর ফলে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বাড়তে থাকে এবং আসতে থাকে বিদেশী বিনিয়োগ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রফতানিও বাড়তে থাকে। ২০১২ সালে সাত কিস্তিতে ১০০ কোটি ডলার আইএমএফ থেকে নেয়ার চুক্তি করে বাংলাদেশ। অন্যতম শর্ত নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন করা। এ আইন করতে দেরি করায় শেষের দুই কিস্তি আটকেও দিয়েছিল আইএমএফ।

আইএমএফের ঋণের সুদহার ও পরিশোধের সময়
যেসব দেশ অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে লম্বা সময় ধরে আমদানি ব্যয় ও রফতানি আয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতায় ভোগে, তাদের ঋণ দেয় ইএফএফ থেকে। ইএফএফের অধীনে বাংলাদেশ পাবে ২১৫ কোটি ডলার। আরএসএফের অধীনে পাবে ১৩০ কোটি ডলার। তিনটির গড় ঋণের সুদ হবে ২ দশমিক ৩৫ শতাংশের মতো। ইসিএফের অধীনে পাবে ১০০ কোটি ডলারের মতো। এ জন্য কোনো সুদ দিতে হবে না।
তিন ধরনের ঋণের মধ্যে আরএসএফের ১৩০ কোটি ডলার পরিশোধে সময় পাবে ২০ বছর। তবে ১০ বছরের একটা গ্রেস পিরিয়ড পাওয়া যাবে। প্রথম ১০ বছর অবশ্য কোনো ঋণ পরিশোধ করা লাগবে না। একাদশ বছর থেকে পরিশোধ করতে হবে এ অংশের কিস্তি। ইসিএফ ও ইএফএফের বাকি ৩২০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে সময় পাবে ১০ বছর। এ অর্থ দুই ভাগে পরিশোধ করা যাবে এবং আলাদা আলাদা গ্রেস পিরিয়ড থাকবে এখানেও। যেমন ইএফএফের ঋণ সাড়ে চার থেকে ১০ বছরের মধ্যে শোধ করতে হবে। এর জন্য সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ করতে হবে না। আর ইসিএফের ঋণ পরিশোধ করতে হবে না সাড়ে পাঁচ বছর পর্যন্ত।

আইএমএফের ব্যয় সঙ্কোচনের শর্তে জনগণের ওপর প্রভাব
শর্তানুযায়ী ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয় করা, বাজেট থেকে সঞ্চয়পত্রকে আলাদা করা, ব্যাংক ঋণের বর্তমান সুদহার ৯ শতাংশ তুলে দেয়া, নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা, কার্বন ট্যাক্স প্রবর্তন, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ও সুদের হারের নির্দিষ্ট সীমা প্রত্যাহার ইত্যাদি করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব পদ্ধতি ঠিক করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আয়কর আইন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন ও আদায়ের অযোগ্য খেলাপি ঋণ বিষয়ে আলাদা কোম্পানি গঠন করার কাজও চলছে। খেলাপি ঋণ প্রকৃতপক্ষে কমানোটাই সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে। বৈশ্বিক সঙ্কট ও অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থার কারণে ইতোমধ্যে দ্রব্যমূল্য হয়েছে আকাশচুম্বী। তার ওপর জ্বালানির ঘাটতি পুরোপুরি তুলে দিলে দ্রব্যমূল্য আরো বেড়ে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলবে। ঘাটতি না তুলে বরং অপচয় ও দুর্নীতি কমিয়ে সঙ্কট সামলানো যেত। জিডিপির তুলনায় দেশের রাজস্ব সংগ্রহের হার নি¤œতম। কর দেন মাত্র ১ শতাংশ মানুষ। দেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত মাত্র ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। কর ছাড়ের পরিমাণসহ হিসাব করলে দেশের রাজস্ব-জিডিপি হার ১৫ শতাংশের কাছাকাছি হবে।
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান বলেছেন, সঙ্কট যতটা গভীর, আইএমএফের এ ঋণ তার সমাধান পুরোপুরি দিতে না পারলেও সমাধানের পথে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারবে। তিনি বলেন, ঋণ একমাত্র সুষ্ঠু অর্থনৈতিক সমাধানের পথ নয়; বরং অর্থ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ দিতে হবে। বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার হচ্ছে। আর এতে উৎসাহিত হচ্ছে হুন্ডি। এগুলো বন্ধে সরকার কতটা আন্তরিক, তার ওপর নির্ভর করবে সঙ্কট কত কম সময়ে দূর হবে। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের কথাও ভুলে গেলে চলবে না।
পরিশেষে বলতে হয়, চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়া বাংলাদেশের আইএমএফের ঋণে সাময়িক স্বস্তি পাবে দেশ, তবে দীর্ঘমেয়াদে দেশ ঋণের জালে জড়িয়ে গেল। বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ এই ঋণ সাময়িক স্বস্তি দিলেও আইএমএফের ঋণ নিয়ে সঙ্কট থেকে চূড়ান্তভাবে মুক্তি পেয়েছে পৃথিবীতে, গ্রিসের মতো দু-একটি দেশ ছাড়া এমন উদাহরণ খুবই কম; সুতরাং সতর্ক হই।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : mizan12bd@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement