২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বিকৃত তত্ত্ব আর তর্ক টকশোর মান ক্ষুণ্ন করে

-

অপ্রিয় সত্য কথাটি বলতে, গত প্রায় দেড় হাজার বছরব্যাপী চলে আসছে আমাদের ‘নগদের রাজনীতি’। অন্তত সেই পাকিস্তান আমল থেকেই কেবল বাম দলীয় ও জামায়াতে ইসলামী ব্যতীত ডানপন্থী প্রায় নেতাদের অতীতকে জানার নাই কোনো পড়াশোনা, যা জাতীয় ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণে অত্যাবশ্যকীয়। শুধু প্রচার বনাম স্বার্থগত অপপ্রচারে শ্রাব্য হয় আমাদের অতীত জ্ঞানের ভিত্তি। প্রচলিত টিভির টকশোতেও কখনো কখনো এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এগুলোর অবশ্য বেশ কয়েকটি সঞ্চালনকারীর দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার সাথে দায়িত্বশীল ও গুণগত মানের প্রায় সমতুল্য, আলোচকের সমন্বয়ে প্রশংসনীয় অনুষ্ঠান করলেও কিছু ঘটা ব্যত্যয়ের মুখ্য কারণগুলো হলো :
ক) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, সিনিয়র সাংবাদিক, প্রজ্ঞাবান ও স্রেফ দলীয় পদ-পদবিধারী প্রজ্ঞাহীন রাজনীতিকসহ মাঝে মাঝে ছয়জন অসম মানের আলোচকের সমন্বয়ে অনুষ্ঠান করা। দেখা গেছে, আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় সরকার ও দলের পার্থক্য এবং গণতন্ত্রের প্রকৃত সংজ্ঞা সম্ভবত না জানার কারণে বা জানা সত্ত্বেও টকশোতে বলতে এড়িয়ে যাওয়ায় কেউ কেউ প্রজ্ঞাহীনতার পরিচয় দেয়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে তর্কাতর্কিসহ আলোচকদের বিব্রত করা, অনুষ্ঠানটির সময়ের তুল্যতায় বর্ধিত আলোচকের সংখ্যানুপাতে বণ্টিত সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিকতার বিশেষজ্ঞ থাকা সত্ত্বেও বিশদ ব্যাখ্যার জন্য তাকে প্রয়োজনীয় সময় না দেয়া;
খ) দুই-একটি চ্যানেলে করা প্রশ্নের ধরনে সঞ্চালনকারী নিজেই যেন নিজের পক্ষপাতদুষ্টতার ও স্বাধীনতার পূর্ব পর যথেষ্ট তাত্ত্বিক জ্ঞান না থাকার প্রমাণ দিয়ে থাকা;
গ) কোনো বক্তব্যের প্রতি উত্তরে কেউ তত্ত্ব উপস্থাপনে উদ্ধত হলেই হয় তাকে থামিয়ে দেয়া, নয়তো সঞ্চালনকারী নিজেই তৎক্ষণাৎ তর্ক জুড়ে দর্শক-শ্রোতার শোনায় বাধা সৃষ্টি ছাড়াও সমমনা দুইজনের বিপরীতে আমন্ত্রিত একজন বিরোধীকে দিয়ে শুরু করা প্রশ্নোত্তর অন্য দুইজনকে দিয়ে খণ্ডন করানো যেন উদ্দেশ্যমূলক কৌশলী প্রচারণায় টকশোকেও সুযোগস্বরূপ ব্যবহার করা এবং
ঘ) দলীয় অনেক নেতার কখনো কখনো বিকৃত তথ্যের উপস্থাপন দর্শক-শ্রোতার সচেতনতার সহায়ক না হওয়ার আপাতত উল্লেখ্য তিনটি হলো :

১। বিগত ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাত ১০টায় ‘সময়’ টিভির টকশোতে বিএনপির এক নেতা বেগম জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেন। পাল্টা দাবিতে সহ-আলোচক এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘১৯৭১-এ ধানমন্ডিতে বেগম মুজিব বন্দী ছিলেন, শোয়ার একটি খাটও ছিল না। পাকিস্তান জেলে বঙ্গবন্ধুকে দেয়া একটি রেডিওতে তিনি হঠাৎ শুনতে পান শেখ হাসিনার গলা ও নির্যাতনের কথা।’ দাবি দু’টি সহআলোচক ও সঞ্চালনকারী মনোযোগ সহকারে শুনলেন- শুনলেন হয়তো লাখো দর্শক-শ্রোতা। কিন্তু এমন তথ্যগুলো প্রাপ্তির বইয়ের নাম জানতে ওই আলোচকদ্বয়ের মোবাইল নম্বর চেয়ে দুই দিন পরেই ২৭ তারিখে চ্যানেলটির ফেসবুকে এবং পুনরায় ২৯ তারিখে একই অনুরোধে চ্যানেলটির ৮৯ বীর সি আর দত্ত রোড, ঢাকা-১২০৫ ঠিকানায় আমার পরিচয় ও মোবাইল নম্বর দিয়ে সঞ্চালনকারীর নামে রেজিস্টার্ড ডাকে চিঠি লিখি। কপিসহ রসিদটি আজো রক্ষিত থাকলেও অজ্ঞাত কারণে হয়তো উত্তর পাইনি।
২। গত বছরের ১৫ অক্টোবর রাতের ওই একই টিভির টকশোতে বিএনপির শুরু হওয়া সম্মেলনে ব্যাপক লোক সমাগম প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘১৯৭০ সালের নির্বাচনে যে ৩০ ভাগ আওয়ামী লীগে ভোট দেয় নাই, তারাই এখন বিএনপির সাথে আছে।’ তার সহ আলোচক বিএনপির ও জাতীয় পার্টির দুইজন সংসদ সদস্য এতে মন্তব্যহীন থাকেন। প্রকৃত তত্ত্বটি হলো ওই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) মোট ভোটার ছিল ৩,১২,১৪,৯৩৫ জন। এর অপ্রদত্ত ভোটার ছিল ৪৪ শতাংশ। প্রদত্ত ৫৬ শতাংশের মধ্যে বিজয়ী দুইজন পাকিস্তানপন্থী এবং তাদের সমমনা পরাজিতদেরসহ সর্বমোট ১৪ শতাংশ ভোট আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দিয়েছিল। শর্মিলা বোস তার ‘DEAD RECKONING’
(মৃতের হিসাব-নিকাশ) বইটির ২২ পৃষ্ঠায় এই একই তত্ত্বে লিখেছেন, ‘The vote share of 75 percent of the 56 percent turnout meant that 42 percent of the total electorate in East Pakistan had spoken in favour of the Awami League.’

৩। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিরুদ্ধে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে ছিল বলে আজো আমরা অনেকে আমেরিকাকে অভিযুক্ত করি। অথচ লন্ডনস্থ কিং কলেজে গবেষণার জন্য মনোনীত বৃত্তিপ্রাপ্ত স্নাতক এবং লেখক শ্রীনাথ রাঘভানের ‘1971’A Global history of the Creation of Bangladesh নামে ২০১৩ সালে প্রকাশিত বইয়ের ২৪৪ থেকে ২৬২ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত তখনকার সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর নথিভুক্ত তত্ত্বগুলোতে পাঠানোর কারণ ভিন্ন বলা হচ্ছে। রাশিয়ার সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানকে ভূটান ও পশ্চিম পাকিস্তানকে নেপাল বানিয়ে ভারত তার প্রভাবকে অন্যত্র প্রসারিত করার বাসনা হয় আমেরিকার উদ্বিগ্নের মুখ্য কারণ, যা তার এশীয় রাজনৈতিক স্বার্থ সম্পৃক্ত। পূর্ব-পাকিস্তানের পতনের পরও পশ্চিম পাকিস্তানের ভূমি দখল (আজাদ কাশ্মির) এবং তার সামরিক শক্তি সমূলে খর্ব করার ভারতীয় পরিকল্পনার ব্যাপারে আমেরিকা যোগাযোগ করে রাশিয়ার সাথে। এরই আশঙ্কায় আগাম প্রস্তুতিতে ১০ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহর ভারত মহাসাগরে প্রেরণের নির্দেশিত সঙ্কেত ভারতীয় নৌবাহিনী পাওয়ায় সেটা পৌঁছার আগেই পূর্ব-পাকিস্তানের পতন ঘটাতে ভারত আরো তৎপর হয়ে যায়। একই সাথে আওয়ামী লীগের সাথে পাকিস্তান সরকারের একটি সমঝোতা, নয়তো পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীনতা ছাড়া পাকিস্তানের কোনো ভূমি দখলের ইচ্ছা ভারতের নেই বলে ইন্দিরা গান্ধী তার লিখিত চিঠি দিয়ে উপদেষ্টা ভিপি ধরকে পরের দিন ১১ তারিখেই পাঠান রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী কসিগিনের কাছে। ১৪ ডিসেম্বর রাশিয়ার শীর্ষ নেতৃত্ব আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে জানান ভারতের দেয়া এই নিশ্চয়তার কথা। তাই পূর্ব পাকিস্তানে ১৬ ডিসেম্বর সেনা আত্মসমর্পণ করলেই ভারত পাকিস্তান সীমান্তে পরের দিন ১৭ তারিখ থেকে একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। সংবাদটি ওই দিনই প্রেসিডেন্টকে দিতে হেনরি কিসিঞ্জার টেলিফোনে বলেন, ‘Congratulations Mr. President, you have saved Pakistan.’ (বইটির ২৬২ পৃষ্ঠার এই তথ্যের সমর্থনে ৩২৯ পৃষ্ঠায় ১০৯ ফুট নোটের Trnscription of Telephone conversation between Nixon and Kissinger, 16 december 1971, FRUS E-7, doc-191 উদ্ধৃত)


আরো সংবাদ



premium cement